যোগী আদিত্যনাথের আমলে আকচারই উত্তরপ্রদেশে এনকাউন্টারে বা পুলিশি সংঘর্ষে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে থাকে। এ নিয়ে বারবারই সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে ‘ট্রিগার হ্যাপি’ যোগীর পুলিশকে। তবে শুধু যোগী রাজ্য নয়, বিগত কয়েক দশকের ব্যবধানে মণিপুরের মালোম (২০০০) ও নাগাল্যান্ডের মোন জেলায় (২০২১) সেনাবাহিনীর গুলিতে বেশকয়েক নিরীহ নাগরিকের মৃত্যুতে ফের বিতর্ক দানা বাঁধে। বিভিন্ন বিরোধী দল ও মানবাধিকার সংগঠন পুলিশ বা সেনার গুলিতে মানুষের মৃত্যুর ঘটনাকে ‘ভুয়ো সংঘর্ষ’ বলে অভিযোগ করে উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত দাবি করে। কিন্তু পরবর্তী এনকাউন্টার না হওয়া পর্যন্ত, প্রায় প্রতিবারই থিতিয়ে যায় অভিযোগ, উত্তেজনা।
জাতীয় মানবাধিকার পর্ষদের তথ্য বলছে, ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত দেশে পুলিশি সংঘর্ষে মৃত্যু সংক্রান্ত ৬৫৫টি মামলা নথিভুক্ত হয়েছে। এর মধ্যে ছত্তীসগড় (১৯১) ও উত্তরপ্রদেশ (১১৭) রয়েছে যথাক্রমে প্রথম ও দ্বিতীয় স্থানে। উত্তরপ্রদেশ পুলিশের স্পেশাল ডিজি (আইনশৃঙ্খলা) প্রশান্ত কুমার সর্বভারতীয় সংবাদ সংস্থাকে জানিয়েছেন, ১৮৩ জন দাগি আসামি গত ছ’বছরে পুলিশের গুলিতে মারা গেছে। অবশ্য উত্তরপ্রদেশ পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭-র মার্চে যোগী আদিত্যনাথের নেতৃত্বে বিজেপি লখনউ-এর মসনদে আসীন হওয়ার পর পুলিশি সংঘর্ষজনিত ১০ হাজার ৯০০টি ঘটনা ঘটেছে।
পুলিশের গুলিতে আইন-বহির্ভূত ভাবে সাধারণ মানুষ বা কোনও মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তির মৃত্যুকে সচরাচর প্রশাসনের পক্ষ থেকে ‘পুলিশি সংঘর্ষ’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, এমন অভিযোগ দীর্ঘদিনের। যদিও, ভারতীয় দণ্ডবিধি, কোড অফ ক্রিমিনাল প্রসিডিওর কোথাওই ‘পুলিশি সংঘর্ষ’ শব্দবন্ধটি ব্যবহৃত হয়নি। এর কোনও স্পষ্ট আইনি সংজ্ঞাও এখনও পর্যন্ত নেই। ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পুলিশের তরফে এই ধরনের সংঘর্ষের ফলে হত্যাকে ‘আত্মরক্ষার্থে’ হত্যা বলে দাবি করা হয়। সম্প্রতি তেলেঙ্গানায় দিশা গণধর্ষণ কাণ্ডে চঞ্চলগুদা জেলে বন্দি অভিযুক্তদের ক্ষেত্রে এই ‘যুক্তি’ দেওয়া হয়।
তবে এসবের অনেক আগে থেকেই এই এনকাউন্টার নিয়ে বহু চর্চা চলছে। ইশরাত জাহান (২০০৪) থেকে সোহরাবুদ্দিন শেখ (২০০৫), বাটলা হাউস (২০০৮) থেকে বিকাশ দুবে (২০২১)– ভারতে পুলিশি সংঘর্ষের আইনি বৈধতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে বারবার প্রশ্ন উঠেছে, উঠেছে বিতর্কও। ১৯৯৭ সালে আইন-বহির্ভূত হত্যা প্রসঙ্গে জাতীয় মানবাধিকার পর্ষদের তরফে জারি করা নির্দেশিকায় বলা হয়, পুলিশি সংঘর্ষে কোনও মৃত্যুর ঘটনা ঘটলে সঙ্গে সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থানায় সেই মৃত্যুকে সংঘর্ষে মৃত্যু হিসেবে নথিভুক্ত করতে হবে। পর্ষদকে ঘটনাটি সম্পর্কে জেলার পুলিশ প্রধানের পক্ষ থেকে জানাতে হবে ঘটনার ৪৮ ঘন্টার মধ্যে। চারমাসের মধ্যে ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত করে পর্ষদকে প্রথম রিপোর্ট দিতে হবে। ঘটনার বিশদ বিবরণ উল্লেখ করে দ্বিতীয় রিপোর্ট দিতে হবে পরের তিনমাসের মধ্যে।
এর পরে ২০১২ সালে ওম মিশ্র বনাম ঝাড়খণ্ড সরকার মামলার রায় ঘোষণায় সুপ্রিম কোর্ট জানায়, আইন-বহির্ভূত হত্যা দেশের ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার আওতায় একেবারেই আসে না। শুধু তাই নয়, শীর্ষ আদালতের বক্তব্য ‘বিরলের মধ্যে বিরলতম’ এই অপরাধ এক অর্থে ‘ঠান্ডা মাথায় পরিকল্পিত খুন’। এই ধরনের হত্যা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের সমতুল্য। শীর্ষ আদালতের নির্দেশিকা অনুযায়ী যে কোনও এনকাউন্টারের ঘটনার পরেই পুলিশের তরফে এফআইআর দায়ের করতে হবে, তারপর সিআইডি বা অন্য কোনও তদন্তকারী সংস্থার হাতে তুলে দিতে হবে নিরপেক্ষ তদন্তের দায়িত্বভার। জাতীয় বা রাজ্য মানবাধিকার পর্ষদকেও এই সংক্রান্ত তথ্য জানাতে হবে। পুলিশি সংঘর্ষে মৃত ব্যক্তির পরিবারকে যথাযথ ক্ষতিপূরণ দিতে হবে এবং এই ঘটনায় সাহসিকতার জন্য কোনওরকম রাষ্ট্রীয় পুরস্কার দেওয়া যাবে না।