গত বছর থেকেই মোদী সরকারের আইন মন্ত্রী বলে আসছেন, বিচারপতি নিয়োগের কলেজিয়াম ব্যবস্থার অবসান দরকার। শুধু তাই নয়। অর্থহীন জনস্বার্থ মামলা এবং জামিনের আবেদনও সুপ্রিম কোর্টের শোনা উচিত নয় বলেই দাবি তাঁর। যার ফলে কেন্দ্রের সঙ্গে দিন দিন বিচারালয়ের বিরোধ ক্রমেই প্রসারিত হচ্ছে। বিচারপতি নিয়োগ নিয়ে সরকারের সঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের সেই বিবাদের নিষ্পত্তি হওয়ার আগেই এবার নয়া বিবাদের সূচনা হয়েছে আদালতে সরকারের পেশ করা সিল খাম নিয়ে। একাধিক মামলায় মোদী সরকার তাদের বক্তব্য সিল করা খামে ভরে আদালতে জমা করেছে। আর সরকারের এই সিদ্ধান্ত নিয়েই হালে একাধিক মামলায় প্রশ্ন তুলেছেন প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়। সিল করা খাম ফিরিয়ে দিয়ে সরকার আইনজীবীকে সাফ বলেছেন, কথায় কথায় সিল করা খাম জমা করবেন না। প্রশ্ন তুলেছেন, সরকারের কীসের এত গোপনীয়তা।
প্রশ্ন হল, সিল করা খাম আসলে কী এবং কেন প্রধান বিচারপতি এই ব্যাপারে আপত্তি তুলেছেন। সরকারি-বেসরকারি সব নথিপত্রই মুখবন্ধ খামেই পেশ করা হয়। কিন্তু সরকারি দফতর, আইন-আদালতে এখনও ব্রিটিশ আমলের নিয়ম মেনে মুখবন্ধ খামের ওপরই গালা আটকে দেওয়া হয়। এর অর্থ খামের প্রাপক ছাড়া দ্বিতীয় কেউ সেটা খুলতে পারবে না। আদালতে গালা দিয়ে সিল করা খামে কোনও নথি পেশ করার অর্থ একমাত্র বিচারপতি সেটি খুলে নথিতে চোখ বোলাতে পারবেন। কিন্তু এজলাসে রিপোর্টের বক্তব্য নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে পারবেন না। অর্থাৎ বিচারপতিরও হাত-পা বেঁধে দেওয়া হয় সিল করা খাম পেশ করে। অতীতে টু-জি মামলা, রাফাল বিমান কেনার মামলায় সরকারের বক্তব্য সিল করা খামে পেশ করা হয়েছিল। তৎকালীন প্রধান বিচারপতিরা আপত্তি করেননি।
সুপ্রিম কোর্ট এতদিন এই নিয়ে আপত্তি না তুললেও সেটা যে ন্যায় বিচারের পরিপন্থী এই আলোচনা বিচার মহলে ছিল। মোদী সরকার জাতীয় স্বার্থ, জাতীয় নিরাপত্তা ইত্যাদি কারণ দেখিয়ে বিভিন্ন মামলায় সিল করা খামে সরকারের বক্তব্য আদালতে পেশ করেছে। ফলে সরকারের নানা পদক্ষেপের কারণ সরকারিভাবে দেশবাসী জানতে পারছে না। এমনকী মামলাকারীও না। প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড় এই ব্যাপারে একের পর এক মামলায় কঠোর অবস্থান নিয়েছেন। আদানি মামলায় তিনি সরকারের সিল করা খাম খুলতে অস্বীকার করে তা সরকারি আইনজীবীর হাতে ফিরিয়ে দেন। তাঁর বক্তব্য, এটা ন্যায় বিচারের পরিপন্থী। সরকার গোপনীয়তার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে চাইছে। আদালত তাতে যুক্ত হতে পারে না। বিচারের অন্যতম শর্ত হল তা স্বচ্ছ হতে হবে।
প্রধান বিচারপতির এমন অবস্থানের পরও সরকার দমেনি। এ মাসের গোড়ায় পেস্টিসাইড উৎপাদনকারীদের লাইসেন্স প্রদান সংক্রান্ত মামলায় প্রধান বিচারপতি জানতে চান, কেন কিছু কোম্পানির উপর সরকার নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে হলফনামা সহকারে তা আদালতকে জানাতে হবে। প্রধান বিচারপতির নির্দেশ শোনা মাত্র সরকারি আইনজীবী তাঁকে জানান, সরকার কারণ অবশ্যই জানাবে। তবে সেই হলফনামায় চোখ বোলাতে পারবেন শুধু বিচারপতি। এজলাসে তা নিয়ে আলোচনা করা যাবে না। প্রধান বিচারপতি সঙ্গে সঙ্গে জানিয়ে দেন, তিনি সিল করা খাম গ্রহণ করবেন না। গত সপ্তাহে কেরালার মিডিয়া ওয়ান সংস্থার লাইসেন্স বাতিলের মামলাতেও একই কারণে ফের প্রধান বিচারপতির রোষের মুখে পড়েছিলেন সরকারি আইনজীবী।