গেরুয়া শিবিরের রামনবমীর কর্মসূচি ঘিরে রাজ্যের বেশ কয়েকটি জায়গায় অশান্তির পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। যা ঠেকাতে পদক্ষেপ করার বার্তা দিয়েছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তথা পুলিশমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে গত কয়েক বছরে শুধু বাংলা নয়, গোটা দেশেই রাম নবমীর মতো ধর্মীয় অনুষ্ঠান অনেক বেশি স্পর্শকাতর হয়ে উঠেছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সে ছবি যখন বদলেছে, তখন সাধারণ মানুষেরও দায়িত্ব বেড়েছে, প্ররোচণায় বা ফাঁদে পা না দিয়ে শান্তি বজায় রাখাটা। অবশ্য সাধারণ মানুষের দায়িত্বের কথাটা মেনে নিলেও, অশান্তির দায় সাধারণের উপর চাপাতে নারাজ সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়।
তাঁর কথায়, ‘সাধারণ মানুষ চিরকালই ভয় পায়, তারা কখনওই অশান্তি চায় না। অশান্তির পিছনে সমাজবিরোধী কিছু মানুষেরই হাত থাকে, আর সেই সব সমাজবিরোধীদের লাগাম ধরা থাকে বিভিন্ন রাজনৈতিক পার্টির হাতে। বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসবে সেই সব সমাজবিরোধীদের কাজে লাগায় দলগুলি। এটা পুরোটাই রাজনৈতিক গেম, এতে সাধারণ মানুষের কোনও রকম ইনভলভমেন্ট কোনওদিনই নেই। সাধারণ মানুষ সবসময়ই ভিকটিম। তাদের ঘাড়ে বন্দুক রাখা অনুচিত।’ সাম্প্রতিক অশান্তির আবহে শীর্ষেন্দুবাবু আরও বলেন, ‘চারপাশে যা হচ্ছে, তা আতঙ্কজনক এবং হ্যাঁ, আমি ভয় পাচ্ছি। এই সব উৎসবের উপলক্ষ কী, তা আজকাল বুঝতে পারি না। বুঝতে পারি না, কেন এইসব উৎসবকে কেন্দ্র করে নানা দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘটে যায় চারপাশে। রামনবমী বা হনুমান জয়ন্তী বা মহরম— যাই পালন হোক, তা তো শান্তিপূর্ণভাবে হওয়ার কথা, কারণ এ সবই ধর্মীয় উৎসব। ধর্মপালনে অশান্তি কেন, তা আমার কাছে রহস্য!’
অভিনেতা ও কৌতুকশিল্পী মীর আবার জোর গলায় সাধারণের শান্তিরক্ষার চ্যালেঞ্জ অ্যাকসেপ্ট করছেন। তাঁর বক্তব্য, ‘আমার মনে হয়, আমাদের রাজ্যের শুধু নয়, আমাদের দেশের মানুষ যথেষ্ট বুদ্ধিমান, তাঁরা জানেন কোনটা ঠিক, কোনটা ভুল, কোনটা অন্যায়। সুতরাং, বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টা বারবারই করে যান, কিছু মানুষকে বিভ্রান্ত করতে। কিছু মানুষ বিপথে চলে গেলেও, বেশিরভাগ মানুষ শুভবুদ্ধিসম্পন্ন। যতদিন এই সংখ্যাটা বেশি থাকবে, ততদিন এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করাটা কোনও রাজ্যের পক্ষে কঠিন নয়।’ বাংলা ব্যান্ড চন্দ্রবিন্দুর প্রধান গায়ক ও অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায় এই অশান্তি ও সাধারণ মানুষের দায়িত্ব প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘একই গ্রহে একই আকাশ, একই হাওয়ায় আমরা থাকি। এটা যেন কোনও পরিস্থিতিতেই আমরা ভুলে না যাই। আমাদের মানবিকতা বোধ যেন জাগ্রত থাকে। সব ধর্মই মানবতার বার্তা দেয়। তাই যে ধর্মেরই মানুষই হোন, এটা মনে রাখতেই হবে। তাহলে আর হিংসা-হানাহানি এ সব আর আমাদের ছুঁতে পারবে না।’
তবে সাধারণের দায়িত্ব বা চ্যালেঞ্জের বিষয়টি একেবারেই মেনে নিচ্ছেন না অভিনেতা কৌশিক সেন। তাঁর কড়া প্রতিক্রিয়া, ‘সাধারণের চ্যালেঞ্জ বা অগ্নিপরীক্ষা— এই কথাগুলো শুনতে আলঙ্কারিক। সারা দেশে যেভাবে ক্ষমতার লড়াই চলছে, সারা দেশ যেভাবে ‘পাওয়ার-হাংরি’ একটা রাজনীতি প্রত্যক্ষ করছে, তাতে চোখের নিমেষে কিছু ঘটে যেতে পারে। সাধারণের সাধ্য নেই তা রোখার। একথা নেতিবাচক হলেও কঠোর সত্যি। বরং আমরা যারা প্রিভিলেজড ক্লাস, পড়াশোনা করেছি, একটু হলেও পরিচিত— সেই আমাদের একটা বড় দায়িত্ব বর্তায় সাধারণ মানুষকে বার্তা দেওয়ার। কিন্তু দুঃখের বিষয়, বলতে বাধ্য হচ্ছি, আমাদের এই শ্রেণির বড় অংশের মধ্যেও এখন সাম্প্রদায়িক ফিলিং চলে এসেছে। কারণ ‘আমার সংস্কৃতি বিপন্ন, আমার ধর্ম বিপদের মুখে’– এই ন্যারেটিভটা খুব অঙ্ক কষেই ছড়িয়ে দিয়েছে রাষ্ট্র, আমাদের বাঙালিদের একটা বড় অংশ তা বিশ্বাসও করছি। আমরা ইনফ্লুয়েন্সড হচ্ছি।’