বৃহস্পতিবার দিনশেষের শহরে মেট্রোর আগুন নিয়ে তৈরি হওয়া আতঙ্কে কার্যত দিশেহারা হয়ে পড়েন নিত্যযাত্রীরা। গতকাল বিকেল ৪টে ৫৬ মিনিট নাগাদ দমদমগামী একটি এসি মেট্রোর কামরা থেকে ধোঁয়া বেরোতে দেখেন যাত্রীরা। টানেলের মধ্যেই মেট্রোটির প্রথম দুটি কামরার তলায় আগুন লেগে যায়। মুহূর্তের মধ্যে ধোঁয়ায় ঢেকে যায় চারিদিক। ছড়িয়ে পড়ে আতঙ্ক। ধোঁয়ায় শ্বাসকষ্ট শুরু হলে বেশ কয়েকজন যাত্রী অসুস্থ হয়ে পড়েন। ট্রেনটি স্টেশনে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে ছুটে আসেন মেট্রো কর্মীরা। তড়িঘড়ি যাত্রীদের নামিয়ে আনেন তাঁরা। ভেঙে ফেলা হয় জানলার কাচও। খবর পেয়ে পৌঁছয় দমকলের একটি ইঞ্জিনও। বৃহস্পতিবারের সন্ধ্যায় এমন ভয়াবহ অভিজ্ঞতার সাক্ষী হল কলকাতা মেট্রো।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, এ দিন বিকেল ৪টে ৫৬ মিনিট নাগাদ দমদমগামী ওই এসি মেট্রোটি রবীন্দ্র সদন স্টেশন ছেড়ে ময়দানের দিকে রওনা দেয়। প্ল্যাটফর্ম পেরিয়ে সুড়ঙ্গে ঢোকামাত্রই ট্রেনটির প্রথম এবং দ্বিতীয় কামরার তলা থেকে বীভৎস আওয়াজ আসতে থাকে। সেই আওয়াজ কিসের তা বোঝার আগেই যাত্রীদের নজরে আসে, কামরার দু’দিকের তলা থেকে লাল আগুনের শিখা বেরোচ্ছে। তার মধ্যে দিয়েই ছুটে চলে মেট্রো। মুহূর্তের মধ্যেই ওই দুই কামরা ধোঁয়ায় ভরে যায়। বাইরে বেরোতে না পেরে তখন যাত্রীরা কামরার মধ্যে ভুগতে থাকেন প্রাণভয়ে।
ঘটনার খবর পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে শেক্সপিয়র সরণি এবং পার্ক স্ট্রিট থানার পুলিশ কর্মীরা ময়দান স্টেশনে পৌঁছন। পৌঁছয় দমকলের তিনটি ইঞ্জিনও। সন্ধ্যা ৫টা ২২ মিনিট অর্থাৎ প্রায় ২৬ মিনিট পর যাত্রীদের চালকের কেবিনের দিক দিয়ে সুড়ঙ্গপথে প্ল্যাটফর্মে নিয়ে আসা হয়। ঘটনার পরেও উদ্ধার হওয়া যাত্রীদের মধ্যে প্রবল আতঙ্ক রয়ে যায়। প্রত্যেকেই মনে হয়েছে, সাক্ষাৎ মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে এসেছেন তাঁরা।
প্রায় ১৫ বছর ধরে মেট্রোয় যাতায়াত করছেন মধ্যমগ্রামের প্রভাস গোপ। সিইএসসি কর্মী প্রভাসবাবু অন্যদিনের মতো এ দিনও কালীঘাট স্টেশন থেকে মেট্রোতে উঠেছিলেন। তিনি ছিলেন ৩ নম্বর কামরায়। ৪৬ বছরের প্রভাসবাবু বাইরে বেরিয়ে এসেই স্টেশন চত্বরের মধ্যে একটা চাতালে বসে পড়েন। চোখ মুখে তখনও আতঙ্ক। মুখ হাঁ করে শ্বাস নিচ্ছিলেন। একটু ধাতস্থ হয়ে বাড়িতে ফোন নিজের সুস্থ থাকার খবরটা দিলেন। তার পর বললেন, ‘আজ মৃত্যুকে খুব কাছে থেকে দেখলাম।’
প্রভাসবাবুর মতোই হাল কুঁদঘাটের শ্যামল চট্টোপাধ্যায়ের। তিনি যাচ্ছিলেন চাঁদনি চক। তাঁর চোখে মুখে আতঙ্ক। বাইরে দাঁড়িয়ে ঘন ঘন শ্বাস নিচ্ছিলেন। বিশ্বাস করতে পারছিলেন না, বেঁচে ফিরেছেন। শ্যামলবাবু বললেন, ‘আমি কেবল প্রার্থনা করছিলাম, যাতে জীবন্ত পুড়ে মারা না যাই। এর পর আরআমি মেট্রোতে চড়তে পারব না।’
মেট্রো থেকে বেরিয়ে আসা যাত্রীদের অভি়জ্ঞতা ভয়াবহ। অনেকেই জানিয়েছেন, তাঁরা সাক্ষাৎ মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছেন। শ্বাসকষ্টে ভোগা অন্তত ৪১ জন যাত্রীকে এ দিন এসএসকেএম হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। তাঁদের মধ্যে ৭ জন সেখানে ভর্তি রয়েছেন। মেট্রোর জানলার কাচ ভাঙতে গিয়ে জখম যাত্রীও ভর্তি রয়েছেন ওই হাসপাতালে।
গতকাল সন্ধ্যায় ঘটনাস্থলে পৌঁছন কলকাতা পুলিশের কমিশনার রাজীব কুমার। তাঁর সঙ্গে ছিলেন অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার জাভেদ শামিম এবং যুগ্ম কমিশনার প্রবীণ ত্রিপাঠী। পৌঁছন দমকলের ডিজি জগমোহনও। সন্ধে সাড়ে ৬ নাগাদ মহানায়ক উত্তমকুমার থেকে সেন্ট্রাল অংশটুকু বাদ দিয়ে বাকি অংশে ফের মেট্রো পরিষেবা স্বাভাবিক হয়ে যায়। পরে রাত আটটার পর প্রথমে দমদম থেকে কবি সুভাষগামী মেট্রো চালু হয়। তার পর কবি সুভাষ দমদমের মধ্যেও স্বাভাবিক হয় পরিষেবা। যদিও মানুষ আতঙ্ক কাটিয়ে উঠতে না পারার ফলে রাতের দিকে মেট্রোতে তুলনামূলক ভিড় কম ছিল।
অন্যদিকে, এই ঘটনার ফলে যাত্রীরা বাস বা অন্যান্য যানবাহনে বাড়ি ফেরার চেষ্টা করেন তার ফলে সেখানেও মাত্রাতিরিক্ত ভিড় ছিল সেখানেও নাকাল হতে হয়েছে তাঁদের। লোকজন বাসের জন্য এদিক ওদিক ছুটছে। এমন সময় হঠাৎই একটা পুলিশ ভ্যান এসে হাজির, যার গায়ে লেখা স্পেশাল মেডিকাল ফোর্স। পুরো খালি সেই ভ্যান মুহুর্তের মধ্যে ভরে যায় যাত্রীতে। আসলে যাত্রীদের হয়রানি কম করার জন্যই প্রশাসনের তরফে স্পেশাল মেডিকেল ফোর্স লেখা পুলিশ ভ্যানের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। বিপদের মুহূর্তে অমন একাধিক পুলিশ ভ্যান খেপে খেপে যাত্রীদের পৌঁছে দিয়েছে তাঁদের গন্থব্যে। কোনও ভ্যান গেছে গড়িয়া অবধি৷ কোনওটা বা অন্যকোথাও।