‘মহীনের ঘোড়াগুলি’র জনপ্রিয় গানের লাইন থেকে ‘আবার বছর কুড়ি পরে’ ছবির নামকরণ। চিন্তাটি অভিনব, কিন্তু গল্পের কাঠামো, বিষয়, প্রয়োগের ভাবনায় কি তেমন অভিনবত্ব পাওয়া গেল? স্কুল লাইফের বন্ধুত্বের বাঁধুনিটাই একজন সংবেদনশীল মানুষের কাছে জীবনের সেরা সময়।
বয়স বাড়লে কিংবা সাফল্যের শিখরে উঠলে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ে, একা হয়ে যায়। এটাই জীবনের ধর্ম। সেই একাকীত্বের মুহূর্তে মনে পড়ে অতীতের স্মৃতি। ছোটবেলার বন্ধুদের, সেই হারানো সময়গুলো ফিরে পেতে বড্ড ইচ্ছে করে। শ্রীমন্ত সেনগুপ্তর এই প্রথম ছবি সেরকমই একাকীত্বের বোঝা বুকে চেপে রাখা চার – পাঁচ বন্ধু-বান্ধবীর স্মৃতি হাতড়ে বেরানোর গল্প দেখিয়েছে।
স্কুলবয়স থেকেই অরুণ (আবির চট্টোপাধ্যায়), বনি (অর্পিতা চট্টোপাধ্যায়), দত্ত (রুদ্রনীল ঘোষ), নীলা (তনুশ্রী চক্রবর্তী) এবং জয়ন্ত (অতিথি শিল্পী মীর) বন্ধু। ঘরের দরজা বন্ধ করে অ্যাডাল্ট ফিল্ম দেখতে গিয়ে মায়ের কাছে ধরা পড়েছে, রাতের অন্ধকারে ছাদে প্রথম মদের স্বাদ নিতে গিয়ে বাবার কাছে বকুনি শুনেছে। কিন্তু তাদের বন্ধুত্ব ছিল অটুট। এমনকী অরুণ-বনির প্রেম এবং বিয়েও হয়।
এখন প্রথম চারজন প্রতিষ্ঠিত, কিন্তু সবার জীবনেই কিছু না কিছু শূন্যতা রয়েছে। অরুণ থাকে বেঙ্গালুরুতে। ডিভোর্সের পর ডেন্টিস্ট বনি একাই থাকে কলকাতায়। দত্ত মাঝারি মাপের সেলসম্যান। স্ত্রী আছে। তবে নিঃসন্তান। নীলার বিয়ে হয়েছে দিল্লীতে এক অবাঙালি পরিবারে। গৃহবধূর জীবন তার। জয়ন্তর সঠিক খবর কেউই জানে না। হঠাৎই একদিন অরুণ কলকাতায় এসে দত্তর সঙ্গে দেখা করে।
তার আগে অবশ্য দেখানো হয়েছে, অরুণ কীভাবে বেশ কিছু সহকর্মীর চাকরি খেয়ে নিজের পদোন্নতি করে নেয়। অরুণ এবং দত্ত মদ্যপানে বেহিসেবি। অনেকদিন পর প্রথম দেখাতেই তারা ঠিক করে সেই পুরোনো দিনের চার/পাঁচ জন আবার মিলিত হবে। কোথায়? যেখানে দাঁড়িয়ে যৌবনে প্রথম প্রেমের পাখনা মেলেছিল সেই উত্তর বাংলার তাকদায়।
যেমনি ভাবা তেমনি কাজ। অরুণ এবং দত্ত দু’জনই পরদিন সকালে পৌঁছে যায় নীলার বাড়ি। সেখান থেকে সোজা তাকদায় বনিদের বাংলো বাড়িতে ভায়া বাগডোগরা। প্লেনের টিকিট, গাড়ির ভাড়া, হোটেল বুকিং এসব কীভাবে হল, কে করল, দয়া করে চিত্রনাট্যকার বা পরিচালককে জিজ্ঞেস করবেন না। এগুলো সব সিনেমাটিক লাইসেন্স। চারজন এককাট্টা হবার পর প্রত্যেকের জীবনের একঘেয়ে গল্প শুরু হয়ে যায়।
তারপর আবার বাংলো বাড়ি বিক্রি নিয়ে বিস্তর জলঘোলা হল। অদৃশ্য পঞ্চম বন্ধু জয়ন্ত সেজে মীর ঢুকে পড়ে আরও এক কেলেঙ্কারি! বাকিরা আনন্দে, রাগে তার জামাকাপড় ছিঁড়ে সে এক বিচিত্র কাণ্ড! পুরনো বন্ধুত্ব ও হারানো সময়ের রেশ যেন ওলটপালট হয়ে গেল। অথচ, রূপঙ্কর এবং অনিন্দ্যর দু’টি গানে বেশ স্মৃতিমেদুর পরিবেশ তৈরি হয়েছিল।
অতীত ও বর্তমানকে নিয়ে সময়ের খেলাটি কিন্তু বেশ সুন্দর করেই সাজিয়েছিলেন শ্রীমন্ত। আসলে, শক্তি চাটুজ্জের বাজার করতে বেরিয়ে চাইবাসা চলে যাওয়ার মতো ঘটনা থেকে টেক অফ করলেও, পরিচালক শক্তির বাউন্ডুলে মেজাজ ধরে রাখতে পারেননি। রেশ কেটেছে বারবার।
অথচ ভাবনায় নিশ্চয়ই অভিনবত্ব ছিল। ভাবনাকে চিত্ররূপ দিতে গিয়ে বেসামাল হয়েছেন। আবার মাঝে মাঝে ভাল কাজের ঝিলিকও আছে। বিশেষ করে শেষ দৃশ্যে দুই ভিন্ন বয়সের চরিত্রগুলোকে একই ফ্রেমে নিয়ে আসা বা কয়েকটি জায়গায় অতীত ও বর্তমানের চরিত্রকে পাশাপাশি রাখার প্রায়োগিক ভাবনার প্রশংসা করতে হয়।
অভিনয়ে আবির, অর্পিতা, রুদ্রনীল, তনুশ্রী তাঁদের নিজস্ব ধারা ও ঘরানা বজায় রেখেছেন। আবির মাতাল হিসেবে বেশ বেমানান। আবার রুদ্রনীল একটু বাড়াবাড়ি করলেও মাতাল হয়ে তিনি স্বাভাবিক। মাথা ভরতি পরচুলা কেন দেওয়া হল অভিনেতাকে? বোঝা গেল না। সবমিলিয়ে ‘আবার বছর কুড়ি পরে’ দু-তিন সপ্তাহ পরে দেখা যাবে কিনা সেটা নিয়ে সন্দেহ থাকছে।