“ভগিনীগণ! চক্ষু রগড়াইয়া জাগিয়া উঠুন- অগ্রসর হউন! বুক ঠুকিয়া বল মা, আমরা পশু নই। বল ভগিনী, আমরা আসবাব নই। বল কন্যে, আমরা জড়াউ অলংকার-রুপে লোহার সিন্দুকে আবদ্ধ থাকিবার বস্তু নই; সকলে সমস্বরে বল আমরা মানুষ।”
১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রাশিয়া সাম্রাজ্যের তৎকালীন রাজধানী পেট্রগ্রাডে বস্ত্র কারখানায় কর্মরত মহিলারা তাদের অধিকারের দাবীতে পথে নামল রুশ সম্রাট নিকোলাস (দ্বিতীয়) র বিরুদ্ধে এবং মানবতার ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হলো। নাম হলো “ফেব্রুয়ারি বিপ্লব”। তাদের নানান দাবীর মধ্যে এক অন্যতম দাবী ছিল নারীদের জন্য ভোটাধিকার।
আন্দোলনের তীব্রতা রাশিয়ার সাম্রাজ্য পতনের সূচনা ঘটাল, সম্রাট পদত্যাগ করলেন এবং সাত দিনের মধ্যে রাশিয়ার সরকার নারীদের জন্য ভোটাধিকার ঘোষণা করলো। ৮ঐ মার্চের, ১৯১৭ সেই ঐতিহাসিক দিনকে অক্টোবর বিপ্লব পরবর্তী ভ্লাদিমির লেনিনের বলসেভিক সরকার সোভিয়েত উনিয়নের “নারী দিবস” হিসেবে ঘোষণা করলো। ১৯৭৭ সালে ইউনাইটেড ন্যাশন জেনারেল এসেম্বলি ৮ঐ মার্চ দিনটিকে “বিশ্ব নারী দিবস” হিসেবে পালন করার জন্য সকল রাষ্ট্রের কাছে আবেদন করে।
বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে যখন পাশ্চাত্যের দেশগুলিতে নারীদের জন্য সমানাধিকারের ঝড় বয়ে যাচ্ছে তখন পরাধীন ভারতের সমাজের নারীদের অনগ্রসর পরিস্থিতি, শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে সমানাধিকারের দাবী নিয়ে কলম ধরলেন এক বঙ্গ নারী রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। একের পর এক উপন্যাস, প্রবন্ধ, ছোট গল্প, কবিতা এমন কি বিজ্ঞান কল্পকাহিনী লেখার মাধ্যমে সেই যুগের নারীদের পরিস্থিতি সমাজের সামনে তুলে ধরলেন। নারী শিক্ষার পক্ষে সওয়াল করলেন, কর্মক্ষেত্রে নারীদের সুযোগ ও সমান উপার্জনের দাবী জানালেন, সমাজের অমানবিক ধর্মীয় নীতি যা নারীদের অনগ্রসরতার মূলে তা তীব্র ভাষায় সমালোচনা করলেন।
রোকেয়া খাতুনের জন্ম অবিভক্ত বাংলার রংপুরের পায়রাবন্দ গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলমান পরিবারে। তাদের পারিবারিক ভাষা ছিল উর্দু। এ ছাড়া তাঁরা আরবি ও ফারসি ভাষায় কথা বলতেন ও চর্চা করতেন। কিন্তু রোকেয়া ও তাঁর দিদি করীমুন্নেসা আরবি, ফার্সির পরিবর্তে বাংলা শিখতে চেয়েছিলেন যা তাঁর পরিবারের একদম অপছন্দ ছিল। তাঁরা ছিলেন উচ্চবিত্ত জমিদার পরিবার আর বাংলা ছিল সাধারণ মানুষের ভাষা। কিন্তু তাঁর বড় দাদা ইব্রাহিম সাবের তার দুই বোনকেই বাংলা শেখায় এবং দুজনেই পরবর্তী কালে প্রতিষ্ঠিত লেখিকা হন।
১৮ বছর বয়সে রোকেয়ার বিবাহ হয় ভাগলপুরের ডেপুটি মেজিস্ট্রেট খান বাহাদুর সাখাওয়াত হোসেনের সাথে। উনি ছিলেন অত্যন্ত শিক্ষিত ও উদার মানসিকতার ব্যক্তি এবং রোকেয়া সাখাওয়াতকে তাঁর বাংলা ও ইংরাজি শিক্ষা চালিয়ে যেতে বলেন এবং লেখা-লেখির কাজে অনেক উৎসাহ দেন। ১৯০২ সালে তাঁর প্রথম রচনা ‘পিপাসা’ প্রকাশ পায় ‘নবপ্রভা’য়। ১৯০৪ সালে তাঁর প্রথম বই ‘মতিচূর’এর প্রথম খন্ড প্রকাশিত হয় এবং দ্বিতীয়টি প্রকাশিত হয় ১৯২২ সালে। ‘মতিচূর’-এর প্রথম খন্ডে ৭টি এবং দ্বিতীয়টিতে ১০টি প্রবন্ধ সংকলিত হয়েছে। এর মধ্যে দু-একটি প্রবন্ধ বাদে প্রায় সবগুলো প্রবন্ধই নারী জাগরণ মূলক। এরমধ্যে ‘স্ত্রী জাতির অবনতি’, অর্ধাঙ্গী’, ‘বোরকা’, ‘সুলতানার স্বপ্ন’, ‘নারীসৃষ্টি’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ। এ সব প্রবন্ধে রোকেয়ার নারীমানসের বিভিন্ন দিক ফুটে উঠেছে।
সেই যুগ ছিল বাংলা সাহিত্যের আধুনিকতার প্রারম্ভ কাল। বাঙালি সমাজ সাহিত্য-সংস্কৃতি ও শিক্ষা-দীক্ষায় ধীরে ধীরে আধুনিক হয়ে উঠছে। কিন্তু এই বাঙালি সমাজের একাংশ (মুসলিম সমাজ) তখনও বাংলা শিক্ষা-দীক্ষায় অনেক পিছিয়ে। এর বিবিধ কারণও রয়েছে। অনেক বাঙালি গোঁড়া মুসলমান মনে করতেন বাংলা ও ইংরাজি শেখা পাপ। তাদের অধিকাংশের পরিবার মূলত উচ্চবিত্তদের মধ্যে উর্দু, আরবী ও ফারসী ভাষার চর্চা ছিল; কথোপকথনও করতেন ঐ ভাষাতেই। এক শ্রেণীর মুসলমান বাঙালিদের বাংলা ভাষার প্রতি এমন মনোভাব সেই মধ্যযুগ থেকেই চলে আসছিল। সমাজের এমন এক বৈরী পরিবেশে রোকেয়া সাখাওয়াত লেখনী ধারণ করেছিলেন। সেই সময়ে বাংলার মুসলমান সমাজে তিনিই একমাত্র লেখিকা যিনি নারীদের বিভিন্ন ব্যথা-বেদনা ও সমস্যার কথা তাঁর লেখনীতে সুচারুরূপে তুলে ধরেন। চারপাশের নারীসমাজের অজ্ঞতা, নির্জীবিতা, নিগৃহীতা অবলোকন করে তিনি অস্থির হয়ে উঠেছিলেন আর তার প্রতিকার স্বরূপ তিনি শক্ত হাতে কলম তুলে নেন।
১৯০৯ সালে তাঁর স্বামী সাখাওয়াত হোসেন প্রয়াত হন। তিনি তাঁর জীবনকালে বেগম রোকেয়াকে মুসলমান মেয়েদের শিক্ষার্থে একটা স্কুল খোলার জন্য উৎসাহিত করেছিলেন এবং কিছু অর্থ দিয়ে সাহায্যও করেছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পাঁচ মাস পর প্রয়াত স্বামীর স্মৃতিতে রোকেয়া সাখাওয়াত উচ্চ বিদ্যালয় স্থাপন করেন , নাম রাখেন “সাখাওয়াত মেমোরিয়াল হাই স্কুল”। মাত্র পাঁচ জন ছাত্রীকে নিয়ে এই স্কুল ভাগলপুরে শুরু করেন এবং পরবর্তী কালে ১৯১১ সেই স্কুল স্থানান্তরিত হয়ে চলে আসে কলকাতায়।
সেই যুগের সমাজে মুসলমান মহিলাদের স্থান ও শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে চর্চা ও জাগরণ তৈরি করার স্বার্থে ১৯১৬ সালে রোকেয়া সাখাওয়াত স্থাপন করেন আঞ্জুমান-এ-খাওয়াতিন-এ-ইসলাম (ইসলামিক উওমেন্স এসোসিয়েশান বা ইসলামিক মহিলাদের সংগঠন)। এটি প্রথম সংগঠন যেটি বাংলায়ে মুসলমান নারী শিক্ষা ও সমানাধিকার নিয়ে কাজ শুরু করে। ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর তাঁর জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত রোকেয়া সাখাওয়াত সমাজে মহিলাদের অগ্রগতির জন্য লড়াই করে গিয়েছিলেন। ২০০৪ সালে ব্রিটিশ সংবাদ মাধ্যম বিবিসি সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালিদের তালিকায় ষষ্ঠ স্থান দেন রোকেয়া সাখাওয়াতকে।
সমাজে নারীদের পরিস্থিতির উন্নতির স্বার্থে ঊনবিংশ শতকে যে লড়াই রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর শুরু করেছিলেন বিংশ শতকে রোকেয়া সাখাওয়াত সেই কাজ বহু দূর এগিয়ে নিয়ে যান। আজকের বর্তমান সমাজে যেখানে এখনো অনেক ক্ষেত্রে নারীরা সমাজে, কর্মক্ষেত্রে, পরিবারে তাদের সমানাধিকার থেকে বঞ্চিত, আজ থেকে একশো বছর আগে রোকেয়া সাখাওয়াত সেই যুগের নারীর অধিকার নিয়ে সওয়াল করেছিলেন, নারীদের শিক্ষার পক্ষে কলম ধরেছেন, ধর্মের নারী বিরোধী আচার-বিচারকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছেন। তাই আজ ৯ঐ ডিসেম্বর তাঁর জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী পালন করা হোক বাংলা জাতির “জাতীয় নারী দিবস” হিসেবে।
“আমরা উপার্জন করিব না কেন? আমাদের কী হাত নাই, না পা নাই, না বুদ্ধি নাই? কি নাই? যে পরিশ্রম আমরা স্বামীর গৃহকার্যে ব্যয় করি, সেই পরিশ্রম দ্বারা কি স্বাধীন ব্যবসা করিতে পারিব না?”বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের এই প্রশ্ন, এই অক্লান্ত লড়াই হয়ে উঠুক আজ নব প্রজন্মের নারীদের বীজ মন্ত্র।
( মতামত লেখকের ব্যক্তিগত )