প্রায় তিনশো বছরের প্রাচীন কাঁথির কিশোরনগর গড়ের জমিদার রাজা যাদবরাম রায়ের পুজো সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পুজোর জৌলুস হারিয়েছে। তবে হারায়নি ঐতিহ্য। নিয়ম মেনে আজও হোমাগ্নি জ্বালানো হয় আতস কাচে সূর্যের আলো ফেলে।
এই পুজোর ঘট হয় পশ্চিমমুখী। পুজোয় মেতে ওঠে গোটা গ্রাম। শোনা যায়, নরোত্তম বর নামে এক মাঝির কণ্ঠে চণ্ডীমঙ্গল গান শোনার জন্য স্বয়ং দেবীদুর্গা পশ্চিমমুখী হয়েছিলেন। তারপর থেকে সেভাবেই ঘট স্থাপন করা হয়ে থাকে।
জমিদার বংশের সদস্যদের কাছে শোনা যায় সেই কাহিনি। জানা গিয়েছে, তখন যাদবরামের রায়ের দুর্গাপুজো শুরু হয়েছে বেশ কয়েক বছর। একবার দুর্গাপঞ্চমীর গভীর রাতে দেবী নিজে কিশোরনগর থেকে ছ’মাইল দূরে মশাগাঁ গ্রামের খালের ঘাটে ষোড়শীর বেশে উপস্থিত হন।
ঘাটের মাঝি নরোত্তম বরকে অনুরোধ করেন কিশোরনগর গড়ের পুজো দেখতে নিয়ে যাওয়ার জন্য। নৌকোয় খাল পার করে দেওয়ার জন্য আকুতি মিনতি করতে থাকেন দেবী। নরোত্তম খাল পার করে দিলে কড়ির বদলে ষোড়শী তাঁকে দেন একটি পুঁথি।
সেই সময় নিরক্ষর নরোত্তম বলেন, ‘‘মূর্খ আমি। পুঁথি কোন কাজে লাগবে?’’ ষোড়শী বলেন, ওই পুঁথি নিয়ে কিশোরনগর গড়ে গিয়ে দুর্গামন্দিরে গান করতে। সেই মতো নরোত্তম দুর্গাপুজোয় চণ্ডীমঙ্গল গাইতে যান।
রাজা যাদবরাম রায় জাত্যাভিমানে তাঁকে মন্দিরে উঠতে দেননি। মনের দুঃখে নরোত্তম মন্দিরের পিছনে পশ্চিমদিকে বসে চণ্ডীমঙ্গল গান শুরু করেন। আর ঠিক তখনই দেবীর বোধন ঘট পুব দিক থেকে পশ্চিমমুখে ঘুরে যায় আপনা আপনি। নিজের ভুল বুঝতে পারেন রাজা।
সেই থেকে পশ্চিমমুখী ঘটেই দেবীদুর্গার আরাধনা হয়ে আসছে। দুর্গাষষ্ঠী থেকে দশমী পর্যন্ত কিশোরনগর গড়ে মেলা বসে। সাধারণ মানুষের কাছে তা ‘গড়ের মেলা’ হিসেবে পরিচত। কিন্তু করোনা সেই মেলা বসার ক্ষেত্রেও বাদ সেধেছে। গত বার থেকে সেই মেলাও আর বসে না। তবে করোনা মিটলে সেই ‘গড়ের মেলা’ স্বমহিমায় ফেরার আশায় রয়েছেন সকলে।
তবে প্রাচীন ঐতিহ্য অনুসারেই দুর্গাপুজো হয়ে আসছে। নরোত্তম বরের বংশধরেরা আজও আসেন। গড়ের পুজোয় চন্ডীমঙ্গল গান করেন। সময় বদলে গিয়েছে। গড়ের ঝাড়লণ্ঠন, নাটমন্দির, নহবত খানা হারিয়ে গিয়েছে কবেই। তবু আজও পঞ্চমুণ্ডির আসনে, পুরনো আটচালা মন্দিরেই এখনও পুজো হয়। সেই জাঁকজমক নেই।