চলে গেলেন অভিনেত্রী স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত। হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে কলকাতার এক বেসরকারি হাসপাতালে বুধবার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন তিনি। দীর্ঘ দিন ধরে কিডনির সমস্যায় ভুগছিলেন তিনি। ডায়ালিসিস চলছিল তাঁর। ২১ দিন আইসিইউতেও ভর্তি ছিলেন স্বাতীলেখা। চলতি বছর ২২ মে ৭১-এ পা দিয়েছিলেন বর্ষীয়ান অভিনেত্রী। মঞ্চ দাপানো সেই অভিনেত্রীর পথ চলা হঠাৎই থমকে গেল বুধবার। সত্যজিৎ রায়ের বিখ্যাত ছবি ‘ঘরে বাইরে’ দিয়ে সেলুলয়েডে অভিষেক ঘটে স্বাতীলেখার। ছবিতে অভিনয় করেছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, ভিক্টর বন্দ্যোপাধ্যায়ও। ‘বিমলা’ চরিত্রে অভিনয় নিয়ে আজও প্রশংসায় পঞ্চমুখ বাংলা ছবির দর্শক। সেই থেকে সৌমিত্র ও স্বাতীলেখার জুটিকে পছন্দ করেছিলেন অনুরাগীরা। কিন্তু তার পরে মঞ্চের বাইরে দেখা যায়নি তাঁকে। দীর্ঘ ৩১ বছর পরে সৌমিত্রের সঙ্গে জুটি বেঁধেই পর্দায় ফিরেছিলেন তিনি। প্রযোজক-পরিচালক নন্দিতা রায় ও শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের হাত ধরে বড় পর্দায় দেখা যায় তাঁকে। ‘বেলাশেষে’ ছবিতে সৌমিত্র-স্বাতীলেখার রসায়ন দেখে আপ্লুত হয় দর্শকরা। ফের ‘বেলাশুরু’ ছবিতে অভিনয় করেন তাঁরা। কিন্তু ছবি মু্ক্তি পাওয়ার আগেই চলে গেলেন নায়ক-নায়িকা। গত বছর নভেম্বর মাসে মৃত্যু হয় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের। বুধবার চলে গেলেন স্বাতীলেখাও।
উল্লেখ্য, ‘ঘরে বাইরে’ ছবিতে সেই সময় দাঁড়িয়ে সন্দীপ-বিমলার চুম্বন দৃশ্য ঝড় তুলেছিল দর্শকমহলে। সেই যুগে বাংলা ছবিতে চুম্বন জল-ভাত ছিল না। স্বাতীলেখা বলেছিলেন, “কিন্তু জানো, আমার কোনও অসুবিধা হয়নি। ৭-৮ বার টেক দিতে হয়েছিল। বারবার ওঁর শালে আমার হাত চাপা পড়ে যাচ্ছিল। কিন্তু ওই দৃশ্যে শাঁখা পলা দেখানোটা খুব দরকার ছিল, অর্থাৎ এয়ো-স্ত্রী র চিহ্ন। সৌমিত্রবাবু এত সহজ করে দিলেন বিষয়টি, নবাগতা আমি কত সহজেই করে ফেললাম বিষয়টি। এখনও মনে পড়ে।” ১৯৭০ সালে ইলাহাবাদে মঞ্চজীবন শুরু করেছিলেন স্বাতীলেখা। মঞ্চজীবনে পেয়েছেন বিভি করন্থ, তাপস সেন এবং খালেদ চৌধুরীর মতো ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্য। ১৯৭৮ সালে ‘নান্দীকার’ নাট্যদলের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধেন তিনি। সেখানেই আলাপ ও প্রেম হয় নাট্যব্যক্তিত্ব রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্তের সঙ্গে। তার পরে বিয়ে এবং সংসার। ভারতীয় নাট্যজগতে তাঁর অবদানের জন্য সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমি পুরস্কারও পেয়েছিলেন প্রয়াত অভিনেত্রী। তাঁর কন্যা সোহিনী সেনগুপ্তও একই ভাবে নাট্য ও পর্দার জগতে নিজের পরিচয় তৈরি করেছেন। মঞ্চে ‘শঙ্খপুরের সুকন্যা’, ‘মাধবী’, ‘পাতা ঝরে যায়’ ইত্যাদিতে তাঁর প্রতিভার স্বাক্ষর রেখাছিলেন স্বাতীলেখা। নান্দীকার-এর বেশ কিছু নাটকের সঙ্গীত পরিচালকের দায়িত্বও পালন করেছেন তিনি।
স্বাতীলেখার প্রয়াণে গভীর শোকজ্ঞাপন করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শোকবার্তায় মমতা জানিয়েছেন, “বিশিষ্ট অভিনেত্রী স্বাতীলেখা সেনগুপ্তের প্রয়াণে আমি গভীর শোক প্রকাশ করছি। তিনি আজ কলকাতায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। বয়স হয়েছিল ৭১ বছর। থিয়েটারে তাঁর অভিনয় জীবন শুরু। সত্যজিৎ রায়ের ‘ঘরে বাইরে’ ছবিতে তাঁর অভিনয় দর্শক চিরদিন মনে রাখবেন। স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত অভিনীত উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র ‘ধর্মযুদ্ধ’, ‘বেলাশেষে’, ‘বরফ’ ইত্যাদি। তিনি সংগীত নাটক অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড, ওয়েস্ট বেঙ্গল থিয়েটার জার্নালিস্টস অ্যাসোসিয়েশন অ্যাওয়ার্ড-সহ বহু সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। তাঁর প্রয়াণে অভিনয় জগতে এক বিশাল শূন্যতার সৃষ্টি হল। আমি স্বাতীলেখা সেনগুপ্তর স্বামী রুদ্রপ্রসাদ ও কন্যা সোহিনী সেনগুপ্ত-সহ তাঁর অগণিত অনুরাগী ও আত্মীয়স্বজনকে আন্তরিক সমবেদনা জানাচ্ছি।” মায়ের প্রয়াণে ভেঙে পড়েছেন স্বাতীলেখা-কন্যা সোহিনী সেনগুপ্ত। এক সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যমকে এবিষয়ে জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, “দীর্ঘদিন ডায়াবেটিস ছিল। ম্যাসিভ কিডনি ফেলিওর হল। ২৫ দিন আইসিইউতে ছিলেন। আজ চলে গেলেন। সবাই আমাকে ফোন করছেন। তাঁদের অনেক ধন্যবাদ। মা যেন সবার মনে থাকেন।”