২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে পরিবর্তনের পক্ষে রায় দিয়েছিল গোটা বাংলা। রাজ্যের ৩৪ বছরের বাম শাসনের পতন ঘটিয়ে সে বছর ১৩ মে সূচনা হয়েছিল এক নতুন অধ্যায়ের। আর সেই পরিবর্তন এসেছিল যাঁর হাত ধরে, সেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেদিন জানিয়ে দিয়েছিলেন, ‘এই জয় মা-মাটি-মানুষের জয়।’ তারপর দেখতে দেখতে ১০ বছর পেরিয়ে গিয়েছে। তবে এক দশক পেরলেও এখনও রাজ্যের মসনদে অধিষ্ঠিত সেই মমতাই। দিন কয়েক আগেই তৃতীয়বারের জন্য মুখ্যমন্ত্রী পদে শপথ নেওয়া বাংলার অগ্নিকন্যা আজও অপরাজেয়, অপ্রতিদ্বন্দ্বী। আজও মা-মাটি-মানুষের সমর্থন যে তাঁর পাশেই রয়েছে, এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ মিলেছে ব্যালট বাক্সেই। তৃণমূলের প্রাপ্ত ভোটের হিসেব বুঝিয়ে দিচ্ছে, এই দশ বছরে মানুষের আস্থা কমা তো দূরের কথা, বরং তা বাড়তে বাড়তে এখন আকাশ ছুঁয়েছে।
তবে কোন জাদুতে ২০১৬ সালের থেকেও বেশি আসনে জয়লাভ করে বাংলায় ফের তৃণমূলেরই প্রত্যাবর্তন? আর কীভাবেই বা বাম শাসনের অবসান ঘটানো সেদিনের মমতা দশ বছর পেরিয়ে এসেও রয়ে গিয়েছেন জনপ্রিয়তার শীর্ষে? প্রসঙ্গত, গত বছরের ডিসেম্বরে যখন ভোটের প্রচার সবে শুরুর মুখে, সেই সময় তৃণমূল প্রকাশ করেছিল এক রিপোর্ট কার্ড। দলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় জানিয়েছিলেন, তাঁদের সরকার সমস্ত রকম ভাবে মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে কাজ করেছে। আর সেই কাজের খতিয়ান মানুষের কাছে পৌঁছে দেবে তৃণমূল। কিন্তু ঘটনা হল, সাধারণ মানুষের কাছে যেটা থাকে তা হল নিজের অঞ্চল দেখে বিচার। আর সেই বিচারে, এ রাজ্যের বাসিন্দারা গত দশ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে জানেন, কোন কোন প্রকল্পে কেমন ভাবে উন্নয়নের বীজ বুনেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
রাস্তা থেকে পানীয় জল। বিদ্যুৎ পরিষেবা থেকে সকলের জন্য খাদ্য। মা ক্যান্টিন। কৃষিজমির খাজনা মকুব করে দেওয়ার মতো পদক্ষেপ। কন্যাশ্রীর বিশ্বসেরার স্বীকৃতি লাভ। স্বাস্থ্যসাথী কার্ডে বিনামূল্যে চিকিৎসা। এর থেকেই স্পষ্ট, মানবোন্নয়নের সামগ্রিক গ্রাফটা কতটা ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে। আবার, মমতার কন্যাশ্রী, সবুজ সাথী থেকে স্বাস্থ্যসাথী— এই ধরনের সব প্রকল্পেই অগ্রাধিকার পেয়েছেন মহিলারা। এর মধ্যে স্বাস্থ্যসাথী কার্ড হচ্ছেই মেয়েদের নামে। তাঁর সঙ্গে যুক্ত থাকছেন পরিবারের বাকিরা। বার্তাটা স্পষ্ট। বহুবার মুখ্যমন্ত্রী তা নিজের মুখেও বলেছেন। সংসারের আসল হাল ধরে থাকেন মহিলারাই। স্বাভাবিকভাবেই এই ধরনের পদক্ষেপগুলি বাংলার মানুষের মনে এই বিশ্বাস এনেছে যে, যাঁকে তাঁরা সিংহাসনে বসাচ্ছেন, সেই মানুষটা মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে নয়, তাঁদের মেয়ে হিসাবে বিপদে আপদে দাঁড়াবে।
উল্লেখ্য, ২০১১ পূর্ববর্তী সেই অগ্নিগর্ভ সময়ে যখন সিপিএম তথা বামফ্রন্ট সরকারের জমি অধিগ্রহণ নীতিকে কেন্দ্র করে উত্তপ্ত বাংলা। সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম, নেতাই ছুঁয়ে গোটা রাজ্যেই জ্বলছে অশান্তির আগুন। তখন তার সামনে দাঁড়িয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিরলস সংগ্রামকে কুর্নিশ জানিয়েও অনেকে বলেছিলেন, বিরোধী নেত্রীর ভূমিকা অপেক্ষাকৃত সহজ। সরকারের দোষত্রুটি বের করে আক্রমণ করাই যায়। কিন্তু নিজে রাজ্যের শীর্ষপদে থেকে কাজ করা, এত মানুষের প্রত্যাশা পূরণ সহজ নয়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কি তা পারবেন? তবে এই এক দশকে তার প্রমাণ দিয়ে দিয়েছেন মমতা। একদিন রাইটার্স বিল্ডিং থেকে তাঁকে হিড়হিড় করে টেনে বের করে দেওয়ার সময় মমতা বলেছিলেন, একদিন তিনি এখানেই ফিরে আসবেন। তিনি তাঁর সেই কথা রেখেছিলেন। শুধু তাই নয়। এতদিনে যা যা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি, ইতিমধ্যে তার অধিকাংশই পূরণ করেছেন। আর তাই প্রাপ্তির ঝুলির দিকে তাকিয়েই তাঁকে তৃতীয়বারের জন্য মসনদে ফেরালেন বাংলার মানুষ।