করোনার দ্বিতীয় ঢেউ আছড়ে পড়তেই ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে দেশ জুড়ে। প্রতিদিনই লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে দেশের সংক্রমণ। লম্বা হচ্ছে মৃত্যুমিছিলও। এই পরিস্থিতিতে ফের দেশজোড়া লকডাউনের আতঙ্ক গ্রাস করছে পরিযায়ী শ্রমিকদের। যেমন বিহারের মনোজ কুমার সিং। পেশায় ঠিকা শ্রমিক। গত বছর লকডাউনে কাজ খুইয়েছিলেন। দেনার দায়ে যখন ভিটেমাটি বেচে ফেলার জোগাড়, তখন কোনওভাবে দিনমজুরির কাজ জুটে যায়।
চলতি বছরের গোড়ার দিকের কথা। করোনার আঁচ অনেকটা থিতিয়ে এসেছে। হাতে কাজ এল বটে। কিন্তু সেটা সুদূর গোয়ায়। বাড়ি থেকে প্রায় ১৬০০ কিমি দূরের আস্তানা পাততে হবে। পেটের জ্বালায় অবশ্য এতশত ভাবার সুযোগ ছিল না মনোজের। ঘাড়ে ব্যাগ বেঁধে গোয়ায় পৌঁছে যান তিনি। তারপর শুরু হয় দিনপিছু ৬০০ টাকা মজুরির কাজ। উদয়াস্ত পরিশ্রম শেষে হাতে জমত সামান্যই। মাসের শেষে সেটা বাড়িতে পাঠিয়ে তবে নিশ্চিন্তি!
বেশ কিছুদিন আগে বাড়ির এক আত্মীয়ের বিয়ের অনুষ্ঠান ছিল। তখন কয়েকদিনের ছুটি নিয়ে বিহার ফিরে আসেন মনোজ। কিন্তু আপাতত, এখনও, তিনি আর গোয়ায় ফিরে যেতে পারেননি। চোখের নিমেষেই যেন সারা দেশে ছেয়ে গেছে করোনা। যার জেরে বিহার সরকার ফের লকডাউনের কড়াকড়ি শুরু করেছে। যানবাহন প্রায় বন্ধ। কাজটাও আর টিকল না।
আপাতত এদিক-সেদিক ছোটখাট কাজ পেলে ছুটে যান মনোজ। কোনওদিন হাতে ৩০০ কি ৪০০ টাকা আসে বটে। কিন্তু মাসের প্রায় পুরোটাই কাটে অর্ধাহারে। জমানো টাকা চেপেচুপে খরচ করছেন মনোজ। স্ত্রীকেও জানিয়েছেন, তেল-নুন-চিনি যতটা কম পারা যায়, ততটা দিতে। ফের গত বছরের দুঃস্বপ্নের স্মৃতি ফিরে আসছে। মনোজ জানেন না, কবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে। কবে ফের কাজ জুটবে তাঁর।
মনোজ কুমার সিং একা নন। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ দেশজুড়ে পরিযায়ী শ্রমিকদের একটা বড় অংশের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করেছে। একদিকে সংক্রমণ ও মৃত্যুর ভয়। অন্যদিকে ঘর চালানোর দায়। দুইয়ের চাপে দিশেহারা সকলে। বেশ কিছু রাজ্যে ইতিমধ্যে আংশিক, কোথাও কোথাও পূর্ণ লকডাউন জারি হয়েছে। কিন্তু কমবেশি সর্বত্রই যোগাযোগ ব্যবস্থার উপর কোপ পড়েছে।
আবার কোভিডের নেগেটিভ সার্টিফিকেট ছাড়া ইতিমধ্যে অনেক শহরে প্রবেশ নিষিদ্ধ। তাই দিল্লী, মুম্বইয়ের মতো কাজের নিশ্চিত ঠিকানায় থাকা শ্রমিকরা বুঝে উঠতে পারছেন না, তাঁরা বাড়ি ফিরবেন। নাকি সেখানেই থেকে যাবেন। গত বছর মার্চ মাসে কেন্দ্রের লকডাউন ঘোষণার হঠকারিতা এখনও তাঁদের স্মৃতি থেকে উবে যায়নি যে!
আহমেদাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক জিমল উন্নি পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে গবেষণা চালিয়েছেন। তাঁর সমীক্ষার রিপোর্ট বলছে, দেশের অসংগঠিত ক্ষেত্রের মজুরদের সংখ্যা প্রায় ৪১ কোটি। কিন্তু তাঁদের অধিকাংশেরই হাতের সঞ্চয় মাস গেলে ফুরিয়ে যায়। যেটুকু জমে, তা চিকিৎসা কিংবা অন্যান্য আর্থিক নিরাপত্তার জন্য যথেষ্ট নয়।
তাঁর আশঙ্কা, এই প্রবণতা আগামী দিনে ভয়ংকর চেহারা নিতে পারে। বিশেষ করে, কোভিডের মতো মহামারীর জেরে যখন হাসপাতালে বেড পাওয়া যাচ্ছে না, আক্রান্তদের ঘরে থেকে চিকিৎসার বিকল্প পথ বেছে নিতে হচ্ছে, তখন হাতে পুঁজি না থাকাটা চরম বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।
এর উলটো পিঠে রয়েছে রাষ্ট্রের বিপর্যয়। অসংগঠিত শ্রমিকেরা দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখার জন্য অনেকাংশে দায়ী। আর এখন তাঁদের হাতে কাজ না থাকাটা সামগ্রিকভাবে দেশীয় আর্থিক পরিকাঠামোর উপর আঘাত আনতে পারে। এস অ্যান্ড পি গ্লোবাল রেটিংস-এর শীর্ষ অর্থনীতিবিদ শন রোচের আশঙ্কা, যত দিন গড়াবে, এই সমস্যা আরও বাড়বে। করোনার আঁচ চলতে থাকলে অর্থনীতির ঘাটতি মেটানো কার্যত অসম্ভব হয়ে উঠবে।
সম্প্রতি সমীক্ষায় দেখানো হয়েছে, অতিমারী শুরু হতেই দেশের প্রায় সাড়ে সাত কোটি মানুষ এখনও পর্যন্ত দারিদ্র্যসীমার নীচে রয়েছেন। গত মার্চেই বেকারত্বের হার ৬.৫% থেকে বেড়ে ৮%-এ উঠেছে। শুধু তাই নয়। বেঙ্গালুরুর আজিম প্রেমজি বিশ্ববিদ্যালয়ের চালানো একটি সমীক্ষা বলছে, এখনও দেশের ২৩ কোটি মানুষ ন্যূনতম মজুরি, অর্থাৎ মাসে ৩৭৫ টাকা কমের মজুরিতে কাজ করে চলেছেন।