বুধবার পঞ্চম দফার নির্বাচনের আগে প্রচারের শেষ দিন। যদিও সাধারণত প্রচার ভোটের ৪৮ ঘন্টা আগে শেষ হয়, এবারে নির্বাচন কমিশন নজিরবিহীন সিদ্ধান্ত নিয়েছে ৭২ ঘন্টা আগেই প্রচার বন্ধ করে দেওয়ার। আজ প্রচার করলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ধূপগুড়ি, জলপাইগুড়ি, ডাবগ্রাম-ফুলবাড়িতে জনসভা সেরে নদীয়া জেলাতেও জনসভা আছে তাঁর।
কোচবিহারের কাণ্ড নিয়ে বিজেপিকে একহাত নেন মমতা। “শীতলকুচিতে চারজনকে মেরে ৭২ ঘন্টা ধরে সেখানে ঢোকা বন্ধ করে দিল। আমাকে ২৪ ঘন্টার জন্যে ব্যান করল। আজ আমি শীতলকুচিতে গিয়ে নিহতের পরিবারের সাথে দেখা করে এসেছি। গণতন্ত্রকে হত্যা করে গণতন্ত্রের কথা মানায় না।” পাশাপাশি বলেন, ” আজকে মা বোনেদের মুখে শান্তি দেখাটাই আমার সব থেকে বড় স্বস্তি। মা বোনকে ছাড়া আমি ভাবতে পারি না। আমার পায়ে চোট থাকা সত্ত্বেও আমি ১ মাস ১০ দিন ধরে প্রচার করছি। কাল ব্যান ওঠার পরেও দুটো জনসভা করেছি। একদিনও ছুটি নিই নি। একমাস আমি হাটতে পারছি না আতে আমার মানসিক যন্ত্রনা বাড়িয়ে দিয়েছে। মা বোনেদের দেখে আমি সেই দুঃখ ভুলে আছি।”
মুখ্যমন্ত্রী জানান, “বাংলাই আমাদের চোখ, কান, আমাদের সভ্যতা, সংস্কৃতি। বাংলাকে ছাড়া কোথায় যাব? রাজনীতি মানে করে খাওয়া নয়। রাজনীতি মানে মানুষের সেবা করা। আমি চাই রাজনীতিতে নতুন ছেলেমেয়েরা আসুক। তাদের আমরা শিখিয়ে যাব। যাতে বাংলাকে কখনো মাথা নত করতে না হয়। আমরাও রবীন্দ্র, নজরুল, নেতাজি, চিত্তরঞ্জনকে দেখেই শিখেছি। কাকে কখন কী কাজে লাগে আমরা জানি না। আমাকে যখন কেউ পদবী জিজ্ঞেস করে আমার খুব লজ্জা হয়। এতদিন বাংলায় কাজ করার পরে আমার পরিচয় কী? হিন্দু, মুসলিম, শিখ না খীষ্টান। যাদের বিরুদ্ধে লড়াই করছি তাদের কোন সংস্কৃতি নেই। রবীন্দ্রনাথের মতো দাড়ি রাখলেই রবীন্দ্রনাথ হওয়া যায় না।”
এরপর মমতা গেরুয়াশিবিরকে তোপ দেগে বলেন, “আমাকে কখনো মুসলিম, কখনো হিন্দু বলে ওরা। আমি বেলুড়মঠে গিয়ে দেখেছি মুসলিমদের দর্গা আছে। আমি স্বামীজিদের জিজ্ঞেস করেছি, এই হিন্দু প্রতিষ্ঠানে দুর্গাকে কেন মেনে নিয়েছেন? ওনারা বলেছেন আমরা মানার কে? শ্রীরাম কৃষ্ণের সময় থেকে আছে। আমি এদের মানব নাকি রাম কৃষ্ণকে মানব? আমি রামমোহনকে মানব। যিনি সতীদাহ রদ করেছেন। মেয়ে মানেই পুড়িয়ে দেওয়া যায় না। আমি রামকৃষ্ণ, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, গুরুচাঁদ , হরিচাঁদ, অনুকুল ছাড়া বাংলা বুঝি না। এই বিজেপির নেতারা গেরুয়া পরে। ওরা জানে না গেরুয়া মানে ত্যাগ। ওরা সবাই সেলফিস।
আমরা যেটুকু করি মন দিয়ে করি। যখন দুর্গা পুজো করি ওটা মন দিয়ে করি। মুসলমানরা দুর্গা পুজোয় যায় না? আমরা বিরিয়ানি, শেমাই খাই না? আমার বাড়ির কালী পুজোয় সবাই আসে। ধর্ম যার যার আপনার, উৎসব সবার। কল্যাণীতে আমি এইমস করা হয়েছে। কল্যাণী থেকে ডানকুনি আধঘণ্টায় চলে যাবেন। ঈশ্বরগুপ্ত ব্রিজ হচ্ছে। ৭২ হাজার কোটি টাকা এখানে বিনিয়োগ হচ্ছে। কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়, আইআইআইটি হয়েছে। ৬০ জন মসলিন শিল্পীকে ট্রেনিং দিয়েছি। তারা কাজ করছে। মুর্শিদাবাদ সিল্ক, ফুলিয়ার তাঁত সব হচ্ছে।”
মোদীকে কটাক্ষ করে তৃণমূল সুপ্রিমোর বক্তব্য, “এর আগে বাংলাদেশে আমি গেছিলাম মোদীর সঙ্গে। এবার ভোট রাজনীতি করতে আমাকে নিয়ে গেল না বাংলাদেশ। ৩০ বছর ধরে আমরা বড়মাকে দেখেছি। এখন যখন এই জায়গায় পৌছেছি লোভ হচ্ছে তোমাদের? আমি হরিচাঁদ গুরুচাঁদ বিশ্ববিদ্যালয় করে দিয়েছি, মতুয়া বোর্ড করে দিয়েছি। চাকলা ধাম সাজিয়ে দিয়েছি। অনুকুল ঠাকুরের নামে জমি চেয়েছিল দিয়েছি। নবদ্বীপে আমরা ইসকনের জন্যে ৭০০ একর জমি দিয়েছি। বিজেপি বলে হরে কৃষ্ণ হরি হরি গ্যাসের দাম হাজার টাকা করি, লোকের পকেট মারি, দাঙ্গা করি। বিজেপির নেতারা বলছে চারজন কেন আটজনকে মারল না কেন? এরা কেমন নেতা? আমার লজ্জা করে। মহুয়া খুব ভালো কাজ করে। আমার সাথে যোগাযোগ করে কাজ করে। নীলিমাকে দিয়েছি কারণ ওর বরটাকে মেরে ফেলল। তাই এক বিধবার পাশে দাঁড়াবো না?”
তরুণ প্রার্থীদের নিয়ে আশাবাদী মমতা জানান, “ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা চাই লড়াই করুক। অদিতি, সায়ন্তিকা, লাভলি, সোহম সব যুবক ,সনে প্রবীণদের মিলিয়ে টিকিট দিয়েছি। আমি ৫০ হাজার পুকুর কাটব বলেছিলাম সাড়ে তিন লাখ করে দিয়েছি। কন্যাশ্রী করে দিয়েছি। এক বাচ্চা ছেলে এসে বলেছিল শুধু মেয়েরা সাইকেল পাব আমরা পাব না? আমরা সবাইকে করে দিয়েছে ক্লাস নাইনে। বারো ক্লাসের ছেলে মেয়েদের জন্যে ১০ হাজার টাকা করে ট্যাব কেনার জন্যে দিয়েছি। আমরা কত কষ্টে কোভিড আটকালাম। বললাম ওষুধ দিন কিনে আমি রাজ্যবাসীকে দেব। দিল না। মোদী ৫০০ কোটি টাকা দিয়ে জনসভা করছে। বাইরে থেকে নেতা আনছে। যোগী এখান থেকে সভা করে গিয়ে কোভিড আক্রান্ত হল। গুজরাটে পার্টির লোক ইঞ্জেকশান দিচ্ছে। ওদের কি ট্রেনিং আছে? গুজরাটে এক অধ্যাপিকা বেড না পেয়ে মারা গেলেন। কাল অমিত শাহ মিথ্যে কথা বলে গেছে আমি তো এনআরসির কথা বলি নি? তাহলে কে বলল? ঠাকুর বাড়ির কেউ নাকি নাগরিক না তাই বলল ওরা। ঠাকুর বাড়ির সবাই নাগরিক।”
এরপর বিজেপিকে নিশানা করে মমতা বলেন, “বাংলায় ডবল ইঞ্জিন করবে। বাংলা তো বিনে পয়সায় হল, খাবার, জল, শিক্ষা সব দেয়। তুমি কী দাও? ইকনমিতে ধস নামছে। রেল, সেল, এমটিএনএল, এয়ার ইন্ডিয়া, ইন্সুরেন্স সব বিক্রি করে দিচ্ছে। আপনারা ইন্সুরেন্স করে রেখেছেন পাবেন তো? নোটবন্দী, লকডাউন, কোভিড। এই তোমার ডবল ইঞ্জিন। আমরা মরে গেলেও বাংলাকে গুজরাট হতে দেব না। বাংলা বানবগ্লাতেই থাকবে। হরিচাঁদও থাকবে পঞ্চানন বর্মাও থাকবে। রবীন্দ্রনাথও থাকবে নজরুলও থাকবে। এটাই আমার বাংলা। আমাকে চোট করে ভেবেছিল আমি বাড়িতে বসে যাব। মা বোন তাদের পা আমাকে ধার দিয়েছে। আমি তাদের পা দিয়ে চলি। ওরা বলে মমতা তপশিলিদের পছন্দ করে না। আমার সাথে যেই মেয়েটি থাকে সে তপশিলি। আমি তার হাতে খাই। আপনারা দুয়ারে দুয়ারে রেশন চান, মা বোনেরা মাসে মাসে হাত খরচা চান, আপনারা চান আপনাদের ছেলেমেয়েরা ১০ লক্ষ টাকা পড়াশোনার জন্যে ঋণ পাক? তাহলে আপনারা আমাদের ভোট দিন। সবাই ভোট দিন। না দিলে আসামে ১৪ লক্ষ বাঙালিকে ডিটেনশান ক্যাম্পে পাঠিয়েছে। আপনাদেরও পাঠাবে। উদবাস্তু ভাই বোনেদের সবাইকে আমি জমির পাট্টা দিয়ে স্বীকৃতি দিয়ে দেব।”