আসামে এখন ভোটের ভরা বাজার। তবে রাজ্যে এতদিন যাঁদের ভোটাধিকার ছিল, এনআরসি-র জেরে বর্তমানে নিজভূমে পরবাসী হয়ে গিয়েছেন তাঁরা। যেমন স্বামী, ছেলে ও ছয় মেয়েকে নিয়ে ভালই দিন কাটাচ্ছিলেন মিনারা বেগম। আচমকা এক দিন পুলিশ জানায়, তিনি ‘বিদেশি’। একতরফা রায় দিয়েছে ফরেনার্স ট্রাইবুনাল। তাঁর মা-বাবা-ভাইয়ের নামেও গ্রেফতারির নোটিস এসেছে৷ খবরটা মিনারার বাবার বাড়িতে পৌঁছতে সময় লাগেনি। সেই যে মা-বাবা-ভাই পাড়া থেকেই উধাও হলেন, আজও ফেরেননি। বছর পঞ্চাশের মিনারার পক্ষে তাই আর ভারতীয় নাগরিকত্বের কোনও কাগজ জমা করা সম্ভব হয়নি। যেতে হয় ডিটেনশন সেন্টারে। সঙ্গে তাঁর সাত মাসের শিশুকন্যা। দশ বছর বন্দীজীবন কাটানোর পরে গত বছর করোনার দৌলতে জামিনে মুক্তি পেলেও আবার কবে কোন ডিটেনশন সেন্টারে তুলে নিয়ে যাওয়া হবে, সেই উৎকণ্ঠা নিয়েই দিন কাটাচ্ছেন তিনি।
কাছাড় জেলার উধারবন্দের মিনারার মতো ভোটার তালিকা থেকে নাম কাটা গিয়েছে সিদ্দেক আলিরও। তিনি জানান, ১৯৬৫ সাল থেকে ভোট দিয়েছেন। ২০১৬ সালেও ইভিএমে বোতাম টিপেছেন। কিন্তু ২০১৮-র ২০ এপ্রিল পুলিশ তাঁর ভাড়াবাড়ির দেওয়ালে নোটিস সেঁটে দিয়ে যায়। সিদ্দেক তা খেয়ালই করেননি। পরে শুনলেন, সেটিই ছিল ‘বিদেশি’ তকমা দেওয়ার নোটিস। ৫ জুন ফরেনার্স ট্রাইবুনালে গিয়ে নাগরিকত্বের প্রমাণপত্র দেখাতে বলা হয়েছিল। না যাওয়ায় একতরফা রায়ে ডিমা হাসাও জেলার হাতিখালির সিদ্দেক আলিকে ‘বিদেশি’ বলে ঘোষণা করা হয়েছে। সে রাতেই পুলিশ তাঁকে তুলে এনে শিলচর ডিটেনশন সেন্টারে পাঠিয়ে দেয়। দিনমজুর বৃদ্ধের পক্ষে ওই রায়কে চ্যালেঞ্জ জানানো সম্ভব হয়নি। ১৯৬৫-র ভোটার তালিকা পড়েই রইল।
তবে এ তো গেল আম নাগরিকদের কথা। নাম কাটার আতঙ্ক তাড়া করে বেড়ায় আসামের দু’বারের বিধায়ক আতাউর রহমান মাঝারভুইয়াকেও। ভোটার তালিকায় অবশ্য তাঁর নামের পাশে ডি বসেনি। এখনও ফরেনার্স ট্রাইবুনালে মামলা শুরু হয়নি। কিন্তু ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর প্রকাশিত জাতীয় নাগরিকপঞ্জী (এনআরসি)–তে তাঁর নাম ওঠেনি। সরকার এই এনআরসি গ্রহণে অস্বীকার করায় নির্বাচন কমিশন আতাউরের মতো ১৯ লক্ষ ৬ হাজার ৬৫৭ জন ‘বাদ পড়া’ ভোটারের সকলের ভোটাধিকার অক্ষুন্ন রেখেছে। আতাউর জানান, ১৯৭১-র আগের নথি চাইছিলেন এনআরসি কর্তৃপক্ষ। তাঁর নিজের নামেই এমন কত কাগজ! সব জমা করেছেন। পরে আসল নথিও দেখান। এরপরেও বিদেশির তালিকায় ঠেলে দেওয়া হল। তাঁর দুই মেয়ে, এক ছেলে। তিনি বিস্মিত, ওই নথিতেই এক মেয়েকে ভারতীয় বলে মেনে নিয়েছেন কর্তৃপক্ষ।
দু’বারের এআইইউডিএফ বিধায়ক বর্তমানে কংগ্রেস নেতা। তাঁর কথায়, ‘ভোট এলে ঘরে বসে থাকা যায় না। শুক্রবারও কাটিগড়া এবং বড়খলায় দুটি সমাবেশে বক্তৃতা করে এলাম। কিন্তু কখনও নিজের ভোটটাই যদি না থাকে! স্রেফ ভাবা যায় না।’ আতাউর আরও বলেন, ‘অপেক্ষায় আছি, ফরেনার্স ট্রাইবুনালে কবে এনআরসি-ছুটদের শুনানি শুরু হবে। দ্রুত শুরু এবং নিষ্পত্তি হলে বাঁচি।’ তিনি বিশেষ একটি ধর্মের মানুষ বলেই কি ‘বিদেশি’র তালিকায় নাম? এমন প্রশ্নও উঠছে। আবার, এনআরসিতে নাম থাকার পরও রেহাই নেই কাটিগড়ার মঞ্জু মালাকারের৷ স্ত্রী এবং তিন পুত্রেরও নাম আছে এনআরসিতে৷ ঠাকুরদার ১৯৫৬ সালের নথি যত্নে রাখার ফল মিলেছে এমন যখন ভাবছিলেন, তখনই এক দিন পুলিশ এসে জানিয়েছে তাঁকে ‘বিদেশি’ বলে সন্দেহ করা হচ্ছে৷ ফরেনার্স ট্রাইবুনালে গিয়ে হাজিরা দিতে হবে৷ তাঁর বিস্ময়, ‘আমার তো এনআরসিতে নাম রয়েছে!’