অ্যাডিলেডে হারের পর মেলবোর্ন টেস্ট জিতে বর্ডার গাভাস্কার সিরিজে রাজকীয় প্রত্যাবর্তন করেছিল ভারত। এবার সিডনি টেস্টেও দুরন্তভাবে ফিরে এল টিম ইন্ডিয়া। প্রায় হারের দিকে ঝুঁকে পড়া ম্যাচ বাঁচালেন অজিঙ্ক রাহানেরা। ম্যাচ ড্র হওয়ায় সিরিজ এখনও ১-১। স্বাভাবিকভাবেই আসন্ন ব্রিসবেন টেস্ট আরো রোমাঞ্চকর হয়ে উঠল।
রবিবার দ্বিতীয় ইনিংসে ৬ উইকেটে ৩১২ রানে ইনিংসের সমাপ্তি ঘোষণা করে পাহাড়প্রমাণ ৪০৭ রানের লক্ষ্যমাত্রা ভারতের দিকে ছুঁড়ে দেয় অজিরা। এমতাবস্থায় ব্যাট করতে নেমে রোহিত–গিল বেশ ভালভাবেই দ্বিতীয় ইনিংস শুরু করেন। কিন্তু চতুর্থ দিনের খেলা শেষ হওয়ার আগেই দুই ওপেনার আউট হন। গিল ৩১ ও রোহিত ৫২ রানে ফিরে যান। যথরীতি রাহানে–পূজারা জুটির দিকে তাকিয়ে ছিল ভারতীয় ভক্তকুল। হাতে আট উইকেট। টেস্টের শেষ দিনে জয়ের জন্য প্রয়োজন ৩০৯ রান। হ্যাজেলউড–লিঁও–স্টার্ক–কামিন্সের মতো বোলার রয়েছেন বিপক্ষ দলে। এমন পরিস্থিতিতে আবার পঞ্চম দিনের শুরুতেই আউট অধিনায়ক অজিঙ্ক রাহানে। এমন পরিস্থিতিতে জয়ের আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলেন ভারতীয় সমর্থকেরা। কিন্তু হাল ছাড়ার পাত্র নন দেশের ক্রিকেটাররা। চোট পাওয়া ঋষভ পন্থ, চেতেশ্বর পূজারা, পায়ে টান ধরা হনুমা বিহারী এবং রবিচন্দ্রন আশ্বিন- এই চার মূর্তি সিডনিতে শুধু ম্যাচই বাঁচালেন না, দলকে প্রায় জয়ের কাছাকাছিও পৌঁছে দিয়েছিলেন। শেষপর্যন্ত অবশ্য ম্যাচ ড্র হল। কিন্তু এই ড্র’ওযে জয়ের মতোই গৌরবময়। পন্থ–পূজারা আউট হয়ে যাওয়ার পরে আশ্বিন–হনুমার দুর্ভেদ্য দেওয়ালসম পার্টনারশিপ। তাঁরা মনে করিয়ে দিলেন রাহুল দ্রাবিড়ের কথা। আজ যে ভারতীয় ক্রিকেটের ‘দ্য ওয়াল’-এর জন্মদিন। অদ্ভুত সমাপতনে স্মরণীয় হয়ে রইল সিডনি টেস্ট।
এসসিজিতে শুরু থেকেই ম্যাচের রাশ ছিল অজিদের হাতে। চালকের আসনে বসে পড়েছিলেন স্টিভ স্মিথরা। তার উপরে চোট বড়সড় ধাক্কা দিয়েছিল ভারতীয় শিবিরকে। আঙুল ভাঙেন রবীন্দ্র জাদেজা। কনুইয়ে চোট পান ঋষভ পন্থ। পঞ্চম দিনের শুরুতেই আউট হন ভারত অধিনায়ক রাহানে। বাড়তে থাকে চাপ। এই অবস্থায় পালটা মারের খেলা শুরু করেন পন্থ। শুরুতে বেশ কয়েকবার সুযোগ দিলেও পরে গিয়ার বদলান বাঁ হাতি ব্যাটসম্যান। পন্থের আক্রমণাত্মক ব্যাটিং সাজঘরের পরিবেশ বদলে দেয়।আত্মবিশ্বাস এনে দেয় বাকিদের মনে। উলটোদিকে ক্রিজ আঁকড়ে পড়ে থাকেন পূজারা। শেষপর্যন্ত এই জুটি ভাঙেন লিঁও। শতরান মাঠে ফেলে আসেন পন্থ (৯৭)। সাহসী ইনিংস খেলে তাঁকে নিয়ে বিস্তর সমালোচনার জবাব দিলেন পন্থ। বরাবরের মতো স্থিতধী পূজারা। স্তম্ভের মতো ক্রিজে দাঁড়িয়ে থেকে অজি বোলারদের মোকাবিলা করছিলেন তিনি। শেষমেশ ২০৫ বল খেলে ৭৭ রানে আউট হন পূজারা।
স্বভাবতই, পন্থ-পূজারা আউট হওয়ার পর ম্যাচ হারার আশঙ্কা তৈরি হয়। দিনের খেলা তখনও অনেকটাই বাকি। জয় তখনও অনেক দূর। এই পরিস্থিতিতে এক অনন্য লড়াইয়ের সাক্ষী থাকল ক্রিকেটবিশ্ব। সেই লড়াইয়ের দুই নায়ক হনুমা বিহারী এবং রবিচন্দ্রন অশ্বিন। বিহারী ব্যাট করলেন সাড়ে তিন ঘণ্টার উপরে। তিন ঘণ্টার উপর ক্রিজে সময় কাটালেন অশ্বিন। রান নিতে গিয়ে হ্যামস্ট্রিংয়ে টান ধরে বিহারীর। এরকম পরিস্থিতিতে দ্রুত রান নেওয়া যায় না। পা অনেক সময় বিশ্বাসঘাতকতা করে বসে ব্যাটসম্যানের সঙ্গে। এত প্রতিবন্ধকতার মধ্যে লড়াই করে গেলেন হনুমা বিহারী। ১৬১ বলে করলেন ২৩ রান। ভীষণ দরকার ছিল উইকেটে টিকে থাকা। উইকেট গেলেই রক্তের স্বাদ পেয়ে যেত অস্ট্রেলিয়া। চাপ বাড়াত ভারতের উপরে। তাতে ভেঙেও পড়তে পারত ভারতের ব্যাটিং। এখানেই বিহারী জিতে গেলেন। রবিচন্দ্রন অশ্বিনও দাঁত কামড়ে পড়ে থাকলেন উইকেটে। ১২৮ বলে ৩৯ রান করলেন। কখনও কখনও রক্ষণও মনে ছাপ ফেলে যায়। তারও একটা সৌন্দর্য থাকে। টেস্ট ক্রিকেট তো এরকমই। সবকিছুর পরীক্ষা দিতে হয়। বিহারী-অশ্বিনের জমাটি ডিফেন্স ভাঙতে পারেননি স্টার্করা। যদিও উইকেটের পিছনে বিহারীর ক্যাচ ফেলেন টিম পেইন। সেই ক্যাচ ধরলে হয়তো বদলেও যেতে পারত ম্যাচের ফলাফল।
প্রসঙ্গত, একাধিক খেলোয়াড়ের চোট–আঘাত থেকে শুরু করে ম্যাচ চলাকালীন অজি সমর্থকদের বর্ণবিদ্বেষী মন্তব্য, এমনকী ম্যাচের আগে কোয়ারেন্টাইনের বিধিভঙ্গ নিয়ে অজি সংবাদমাধ্যমের একাধিক অভিযোগ। টিম ইন্ডিয়ার ফোকাস নড়িয়ে দেওয়ার কম চেষ্টা করেনি অস্ট্রেলিয়া। এরকম পরিস্থিতিতে সিডনি দেখল এক দুরন্ত লড়াই ও ফিরে আসার সাতহাকন। বলাই বাহুল্য ব্রিসবেনে চতুর্থ টেস্টে আরও আত্মবিশ্বাসী হয়েই যে নামবেন রাহানেরা।