একসময় সম্ভ্রান্ত ও বনেদি বাড়ির পুজোয় আমজনতার প্রবেশ এবং গতিবিধি ছিল নিয়ন্ত্রিত। ফলে সর্বস্তরের মানুষ পুজোয় অংশগ্রহণ করতে পারতেন না। তাই কয়েকজন শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ মিলে ঠিক করলেন, দুর্গোৎসবের সেই প্রথা ভাঙতে হবে। বাড়ির উঠোন বা ঠাকুরদালান থেকে উৎসবকে নিয়ে যেতে হবে জনতার দরবারে। সর্বসমক্ষে। যেমনি ভাবা, অমনি কাজ। পথ চলার শুরু সেই তখন থেকেই।
১৯১৯-এ শুরু হওয়া সেই পুজোই এখন বাঙালির সাবেক বারোয়ারি। সাবেকিয়ানায় ভরপুর বাগবাজার সর্বজনীন শতবর্ষ পরেও নিজের সাবেক চরিত্র ছেড়ে বেরিয়ে আসতে পারেনি। ধূপ-ধুনোর গন্ধে ভরা পুজো প্রাঙ্গণে একচালার ওই প্রতিমা দর্শন করা মাত্রই, প্রতিটি বাঙালির মননে লাগে সাবেকিয়ানার ছোঁয়া। থিমের এই বাড়বাড়ন্তে তাই এখনও অবিচল ‘চমকহীন’ বাগবাজারের পুজো।
এবছর শতবর্ষে অন্যভাবে চমক দেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে পুজো কমিটির তরফে। না কোনও থিম নয়, পুজোর চমকের কেন্দ্রে স্বয়ং নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। শহরের অন্যতম প্রাচীন এই বারোয়ারি পুজোর সঙ্গে নেতাজির যোগাযোগ নানা সূত্রে। এ বছর দর্শনার্থীদের হাতে নেতাজির সই করা শংসাপত্রের কপি তুলে দেবে পুজো কমিটি। পাশাপাশি বাগবাজারের সাবেক প্রতিমার রেপ্লিকাও রাখা হচ্ছে পুজোমন্ডপে। চাইলে বাগবাজারের প্রতিমার ওই ক্ষুদ্র সংস্করণ বাড়ি নিয়ে যেতে পারবেন দর্শকরা।
পুজো কমিটির সাধারণ সম্পাদক গৌতম নিয়োগী বলেন, ‘শতবর্ষ উপলক্ষ্যে আমরা নানা স্মারক-সহ একটি দোকান রাখছি। যেখানে নেতাজির সই করা শংসাপত্রের কপি এবং আমদের প্রতিমার রেপ্লিকা থাকবে। রেপ্লিকা বিক্রি করা হবে। তবে যতক্ষণ শংসাপত্রের কপি থাকবে, আমরা তা বিনামূল্যে মানুষকে দেব। যাঁরা ঐতিহাসিক দলিল সংগ্রহে আগ্রহী, তাঁদের কথা ভেবে আমাদের এই পরিকল্পনা।’
গৌতমবাবু জানান, বাগবাজারের পুজো এখন যেখানে হয়, ১০০ বছর আগে সেখানে হত না। ১৯১৯ থেকে ১৯২৩ পর্যন্ত লিচুবাগান লেন, ১৯২৪-২৯ পর্যন্ত কাটাপুকুর কালীবাড়িতে পুজো হত। ১৯৩০ সালে নেতাজি কলকাতা পুরসভার মেয়র হলে বর্তমান ঠিকানায় পাকাপাকি ভাবে উঠে আসে পুজোটি। আদতে সেটি ছিল পুরসভার ধাতব বস্তুর স্টোর।
তিনি বলেন যে, ‘ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে উৎসবের সংযোগ ঘটাতে নেতাজির উদ্যোগেই এখানে অষ্টমীর দিন লাঠি-ছুরি খেলা, ব্যায়াম প্রদর্শন শুরু হয়। সেই অনুষ্ঠানকে বীরাষ্টমী বলা হয়। সেই রীতি আজও চলে আসছে।’ এ বারও রীতি মেনে সেই বীরাষ্টমী পালন করা হবে বলে জানিয়েছেন তিনি।
একইসঙ্গে তাঁর সংযোজন, ‘নেতাজি যখন পুজোর সভাপতি হন, তখন কুটির শিল্পীদের সই করা শংসাপত্র দিতেন নিজে। সেই শংসাপত্রের কপিই স্মারক হিসেবে রাখা হবে।’ রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী মদন মিত্র পুজোর উপদেষ্টামণ্ডলীতে আছেন। তাঁর কথায়, ‘শতবর্ষে নেতাজির আদর্শকে ছুঁয়ে দেখতে পাবেন দর্শকরা। সেটাই আমাদের বড় প্রাপ্তি।’ আজই ঐতিহ্যবাহী এই পুজোর উদ্বোধন করলেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের।