আজ গোবলয়ে এক মজার জিনিস হলো। জানিনা কজন বাঙালি এর সাক্ষী থাকতে পেরেছেন আমাদের দুজনকে ছাড়া। তবে নিশব্দে হলেও হলো। আর এটা হওয়ার দরুন মনে এক অদ্ভুত প্রশান্তি।
আজ সন্ধেবেলা সিনেমা দেখতে গেছিলাম নয়ডার একটি সিনেমা হলে। নয়ডা দিল্লি জাতীয় রাজধানী অঞ্চলের অংশে হলেও এর সাথে উত্তর প্রদেশেরও যোগ আছে। অর্থাৎ খাঁটি উত্তর ভারতের এক সিনেমা হলে একটি হিন্দি ছবি দেখতে গেছি।
ইদানীং বিশাল পর্দায়, ঠান্ডা হলে, নরম সিটে বসে পপকর্ন মচমচিয়ে মশলা সানি বউদি হোক বা ফুল্টু শাহরুখের হিট ছবি দেখার আগে বাধ্যতামূলক জাতীয় সংগীত বাজবেই৷ আর সেটা বাজবে একটা বিকট হিন্দি উচ্চারণে। কারণ একটাই সিডি সব সিনেমা হলে পরিবেশিত হয়েছে।
আজ ও সেরকম একটা সময় আসে। আমার সামনে তিনজন সুপুরুষ বসেছিলেন, পিছনেও হবে হয়তো। পাশে পাম্মি আন্টি গোছের এক নারী ও তার ‘ও জী সুনতে হো’। খালি পেটে হলে ঢোকার বিড়ম্বনা মুছে যায় এসব জায়গায় যদি আপনার কাছে আমেরিকায় খরচা করার মতো রেস্তো থাকে এবং মনে মনে আপনি নিজেকে চলমান বাজারেরই একটা অংশ মনে করতে পারেন। মানে ওই ২০টাকার জল ৬০টাকায় কিনে, ৫০টাকার পপকর্ন ২৮০টাকায় কিনে। ভাবতেই পারেন আপনি ও ফিল গুড ইন্ডিয়ান। তেলের দাম নিয়ে না হয় হলের থেকে বেরিয়ে ভাবলেন।
তো এরকমই এক সময় এক সময় আমার হাতে পপকর্ন আর কোক যেথায় মুচকি হাসছে আংকেল স্যামের মতো, তখনই মিষ্টি আদেশ এলো সিট ছেড়ে উঠে পরার। আমার হাতে পপকর্ন আর কোক। সবে বসেছি সিটে৷ বিদিকিচ্ছিড়ি অবস্থা। গোটা হল দাঁড়িয়ে গেছে। বউও। জনগণমন শব্দবন্ধ উচ্চারিত ও হয়েছে। আশেপাশের মানুষের ইতিউতি চাওয়া। যেন ইউএপিএ আইনের আসামি। কি লজ্জা৷ সটান উঠে পড়লাম সামান্য পপকর্ন ছলকিয়ে।
হুঁ হুঁ বাওয়া, আমাদের বেস তৈরি করে দিয়েছে বিদ্যাসাগর, বিবেকানন্দ, ডেরোজিও, এন্ড্রুজ। হয়তো ডিএনএ তে সামান্য অংশতে উড়ে এসে জুড়েও বসেছে। দিলাম খুলে তার পাঠ। উদ্দাত্ত কন্ঠে শুরু করলামঃ জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে, ভারতো ভাগ্য বিধাতা। কোন বিধাতা কী লিখেছে এর পরে জানি না। গেয়ে চলেছি। একে বাঙালি তার ওপর বাঙাল। মাভৈ মাভৈ!
সে বড় অসম লড়াই। ওদিকে দামী সাউন্ড সিস্টেমে বেজে চলেছে ‘ জ্যানা গ্যানা মানা আধিনায়াকা জায়া হে, ভারত ভাগ্যা ভিধাতা!’ আর আমি শুদ্ধু বাংলাতে গোটা গোটা অক্ষরে গাইছি ‘জনোগণোমনো-অধিনায়কো জয় হে, ভারতো ভাগ্য বিধাতা’।
আশেপাশের সবাই দেখছে, কেউ কেউ হেসে ও ফেলছে। কী শালা মাল ঢুকেছে। বাংগালী হোগা! কেউ কিন্তু শালা গাইছে না। আমি একা বাঙালি বাচ্চা গাওয়ার চেষ্টা করছি আমার দেশের গান। আমার রাষ্ট্র গান। আমার মাতৃভাষায়। যে ভাষায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছে এ গান। গেয়েছে এ গান।
ইউরেকা মোমেন্টের মতো আজ এটা খেলে গেল। সত্যি তো। আমাদের সরকার আমাদের বাংলাভাষার একটা গান দেশের গান বানিয়েছে, রোজ সিনেমা দেখতে এলে বাজায় নিজের মতো ভুল ভাবে, চায় আমরা গাই, সুরে সুর মেলাই, মেরুদন্ড সোজা করে দাঁড়াই। তা সে গান তো আমার রবি ঠাকুরের গান। আমার বাংলা গান। ও গান আমি গলা খুলে গাইবো না? আলবাত গাইবো। আমার উচ্চারণে, আমার মতো করে। এতে কে কি বলতে আসবে? আসলেই বলবেন, আগে গোটা গানটা কবির উচ্চারণে গেয়ে শোনান। তারপর বন্দে মাতরম গানটার সবকটা লাইন পরিষ্কার করে উচ্চারণ করুন। দেখবেন পারবে না।
বাংলার অবদান দেশের স্বাধীনতায় কি কি ভাবে এসেছে, তা সুযোগ পেলেই বলুন। কারা কারা লড়েছে তাদের নাম ও। এগুলো সব মুছে দিয়ে ভুলিয়ে দিয়ে একটা নতুন আগডুম বাগডুম কল্পকাহিনি ইতিহাস হিসেবে চালানোর চেষ্টা হচ্ছে।
গোটা গানটা শেষ হওয়ার পরে পাশের পাম্মি আন্টি সদৃশ্য নারী আমার বাংলা উচ্চারণে জনগণমন গাওয়া শুনে আমাকে প্রশ্ন করেছিল, আপ বাংগালী হো? আমি দামী পপকর্ন মুখে তুলে উদাস ভাবে উত্তর দিয়েছিলাম,
“হাঁন জী। ম্যে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জনগণমন, সব বাঙালি হে। তবে বাংগালী নেহি”।
এরপর মহিলা আমায় প্রাদেশিক, দেশদ্রোহী বা আরবান নকশাল ভেবেছিল কিনা জিজ্ঞেস করা হয়নি।
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)