মোদী সরকারের করা লকডাউনের মূল্য এখনও চোকাচ্ছে অর্থনীতি। তবে এই মুহূর্তে অন্যতম সমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে বার্ধক্যে আয়ের সমস্যা। অতিমারিতে খরচের রেস্ত ছিল না পকেটে। কিন্তু অন্য সময়ে যখন থাকে তখনও অবসরের পরে কী হবে তা না ভেবেই খরচ করছে না অনেকে। রাষ্ট্রপুঞ্জের জনসংখ্যা বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, ২০২৮ সালের মধ্যেই ভারত জনসংখ্যায় চীনকে ছাড়িয়ে বিশ্বের এক নম্বরের তকমা পাবে। যা আর্থিক দিক থেকে ভারতের ক্ষেত্রে একেবারেই সুখবর নয়।
সমস্যাটা অবশ্য জনসংখ্যার নয়। এই বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দেশে বয়স্ক মানুষের সংখ্যাও যে বাড়ছে, চিন্তা তা নিয়েই। কারণ, যাঁরা বুড়ো হচ্ছেন তাঁদের হাতে কিন্তু এই বার্ধক্য যাপনের জন্য যথেষ্ট রেস্ত থাকবে না বলেই মনে করছে বিভিন্ন সমীক্ষা। এই জনসংখ্যার অঙ্কই বলছে, দেশে ৬০ বা তার বেশি বয়সের মানুষের সংখ্যা বাড়ছে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের তিন গুণ গতিতে। ২০৫০ সালের মধ্যেই বয়স্ক মানুষের (৬০ বা তার বেশি বয়সীর) সংখ্যা ছাড়াবে ৩২ কোটি আর ৮০ বা তার উপরের বয়সের মানুষের সংখ্যা গিয়ে দাঁড়াবে ৪ কোটি ৮০ লক্ষের ঘরে। দেশে ৬০ বা তার বেশি বয়সের মানুষের সংখ্যা বাড়ছে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের তিন গুণ গতিতে। আর এই এত কোটি বৃদ্ধকে তাঁদের সন্তান না দেখলে কিন্তু অবসর বাস সুখের হবে না।
প্রুডেনশিয়াল গ্লোবাল ইনভেস্টমেন্ট ম্যানেজারস বা পিজিআইএমের ভারতীয় মিউচুয়াল ফ্যান্ডের প্রধান অজিত মেনন একটি মজার কথা বলেছেন নিয়েলসনের সঙ্গে ‘অবসরের পরে আয়’ নিয়ে করা এক সমীক্ষায়। আপনি অবসর যাপনের জন্য আপনার বাড়ি কোনও আর্থিক সংস্থাকে বন্ধক দিয়ে মাসিক আয়ের ব্যবস্থা করতে পারেন। আপনার অবর্তমানে ওই বাড়ির মালিকানা বর্তাবে সেই সংস্থাটির উপর যার কাছে আপনি বন্ধক রেখেছিলেন বাড়িটি। অজিত মেনন বলেছেন, ভারতীয়রা এই বন্ধক আসলে সন্তানদের কাছে দিয়ে বসে থাকে। ভাবটা, ‘বাবা-মাকে দেখ। আমাদের যা আছে তা তো সবই তোদের।’
সমীক্ষাটি বলছে, শহরের মানুষ ক্রমাগত দৈনন্দিন খরচ বাড়াচ্ছে আর কমাচ্ছে ভবিষ্যতের জন্য করা সঞ্চয়। আয়ের ৫৯ শতাংশই যাচ্ছে আজকের খরচে, যার আবার ৩৯ শতাংশ যাচ্ছে নানান ইএমআই, বাড়ি ভাড়া ইত্যাদিতে। সঞ্চয় এবং বিনিয়োগের জন্য আয়ের থেকে সরিয়ে রাখা অংশ ক্রমাগত কমছে। ২০১১-১২ থেকে ২০১৭-১৮ সালের মধ্যে পরিবারের সঞ্চয়ের হার জাতীয় উৎপাদন বা জিডিপি-র ২৩.৬ শতাংশ থেকে কমে ১৭.৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। অপরে তো ভরসা সেই কর্মজীবনের সঞ্চয়ই। আর তা যদি কমতে থাকে তা হলে বার্ধক্যে বাঁচার রেস্ত আসবে কোথা থেকে? আগে গ্রামের মানুষ বার্ধক্য নিয়ে ভাবতেন না। যৌথ পরিবারই সেই দায়িত্ব নিয়ে নিত। কিন্তু গ্রামেও যৌথ পরিবার ভাঙছে, আর শহুরে সমস্যা হানা দিচ্ছে গ্রামের ঘরেও।
শহুরে মানুষের ক্ষেত্রে সমীক্ষা বলছে, চাকুরিজীবীরা ৫১ বছরে গিয়েই হঠাৎ যেই মনে করছেন, ‘এই রে! অবসরের সময় তো এসে গেল! খাব কী?’ আর তখনই শুরু করছেন অবসরের জন্য সঞ্চয়।এই সমীক্ষা যাঁদের নিয়ে করা হয়েছে তাঁরা গড়ে ৫০ লক্ষ টাকা নিয়ে কর্মজীবন শেষ করছেন। গড় বাৎসরিক আয়ের হিসাবে তা তার মাত্র ৮.৮ গুণ। ৫০ শতাংশের ওপর মানুষ দুশ্চিন্তা করছেন বুড়ো হলে কী ভাবে চিকিৎসা খরচ মেটাবেন তা নিয়ে। শুধু তাই নয়। এই সঞ্চয়ের কোথাও কিন্তু সেই অঙ্ক কাজ করছে না, যেখানে দাঁড়িয়ে একজন সঞ্চয়কারী আগামী দিনের সেই হিসাব করছেন যেখানে মুল্যবৃদ্ধির সমস্যা আছে, আছে হঠাৎ প্রয়োজনের খরচের জন্য কিছুটা টাকা সরিয়ে রাখার হিসাব।
সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, ৫০ শতাংশের ওপর মানুষ দুশ্চিন্তা করছেন বুড়ো হলে কী ভাবে চিকিৎসা খরচ মেটাবেন তা নিয়ে। বলছেন, সন্তানদের উপর ভরসা করে লাভ নেই। অথচ এঁরাই কিন্তু জীবনযাপন যে ভাবে করছেন তাতে মনে হতেই পারে যে সন্তানরাই বার্ধক্যের বিমা। সমীক্ষাটি বলছে, অংশগ্রহণকারীরা সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে খুব একটা আশার আলো দেখছেন না। আরও একটা মজার তথ্য উঠে এসেছে এই সমীক্ষায়। যাঁদের একের বেশি আয়ের উৎস তাঁরা কিন্তু অবসর জীবন নিয়ে অনেক নিশ্চিন্তে আছেন। আর যাঁদের সূত্র একটাই তাঁরা কিন্তু আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছেন আয়ের আরও কিছু সূত্র তৈরি করায়। চাকুরিজীবীরা ঘোর অনিশ্চয়তায় বাঁচছেন, দিশাহীন ভাবে। সঞ্চয় করলেও কী ভাবে তা করতে হবে তা নিয়ে কোনও স্পষ্ট ধারণাও তাঁদের নেই।