কথায় আছে, পুরনো চাল ভাতে বাড়ে। এ প্রবাদই যেন আরও একবার প্রমাণ হল এবার। বয়স প্রায় আশি ছুঁইছঁই। কিন্তু অভিনবত্বে এখনও তরতাজা। অত্যাধুনিক নানা নবীন সেতু-প্রযু্ক্তির ভিড়েও আপৎকালীন প্রয়োজনে চাহিদা মেটানোর ব্যাপারে অদ্বিতীয় বেইলি ব্রিজ। তাই চেতলা খালের উপরে অস্থায়ী সেতু তৈরির জন্য বেছে নেওয়া হল এই অস্থায়ী চরিত্রের সেতুকেই।
মাঝেরহাট ব্রিজ ভেঙে পড়ার পর কলকাতা-বেহালা সংযোগ তলানিতে ঠেকেছিল। নিউ আলিপুর দিয়ে যাঁরা ডায়মন্ড হারবার রোডে উঠতে চান, তাঁদের নিত্য ভুগতে হচ্ছিল যানজটে। ক্রমেই দুর্গম হয়ে উঠছিল বেহালা। সেই ঝঞ্ঝাট ঘোচাতে এ বার ভরসা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইউরোপ-আমেরিকায় জনপ্রিয় হয়ে ওঠা মিলিটারি প্রযুক্তির এই সেতু। চেতলা ও মাঝেরহাটকে নিউ আলিপুরের সঙ্গে জুড়তে চেতলা ক্যানাল রোড ও হুমায়ুন কবীর সরণির মধ্যে খালের উপর পাশাপাশি তৈরি হবে একজোড়া বেইলি ব্রিজ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অত্যাধুনিক এই প্রযুক্তির যুগেও আপৎকালীন সেতুর প্রয়োজন মেটাতে ব্রিটিশ মিলিটারি ইঞ্জিনিয়ার ডোনাল্ড বেইলির নকশাই সবচেয়ে বড় ভরসা। আর সেই ভরসাতেই এখন প্রশাসনের আশা, খালপাড়ের প্রাথমিক কিছু কাজ মেটার পর দু’ সপ্তাহের মধ্যে অস্থায়ী এই সেতুটি বানিয়ে ফেলতে পারবে গার্ডেনরিচ শিপ বিল্ডার্স।
বেইলি ব্রিজ তৈরির এই সরকারি সিদ্ধান্তকে দু’হাত তুলে স্বাগত জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। শিবপুর আইআইইএসটি-র সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক সুব্রত চক্রবর্তী বলেন, ‘এর চেয়ে ভালো সিদ্ধান্ত কিছু হতে পারে না। চট করে বানিয়ে ফেলা যায়। প্রয়োজন ফুরোলে খুলেও ফেলা যায়। তড়িঘড়ি ওই এলাকার যানজট কমিয়ে পরিবহণ ব্যবস্থাকে মসৃণ করার জন্য বেইলি ব্রিজের কোনও বিকল্প হয় না।’ তবে তাঁর পরামর্শ, এই ব্রিজের ভার বহন করার ক্ষমতার দিকে চেয়ে যান নিয়ন্ত্রণ করাটা অত্যন্ত জরুরি। পুলিশ সূত্রে খবর, ছোট গাড়ি যাতায়াতের জন্যই তৈরি হচ্ছে এই দু’টি সেতু, যা ৮৭-৯০ টন পর্যন্ত ওজন বহনে সক্ষম। আদিগঙ্গার উপর এই ব্রিজটি ব্যবহার করে নিউ আলিপুর থেকে আলিপুর রোড ও আলিপুর অ্যাভিনিউ পৌঁছনো সহজ হবে। ফলে মাঝেরহাট ব্রিজের অবর্তমানেও রাজা সন্তোষ রোড হয়ে সহজেই চেতলা পৌঁছে যাওয়া যাবে তারাতলা বা বেহালা থেকে।
কেন এই ২০১৮ সালেও এত প্রাসঙ্গিক ১৯৪০-এর বেইলি ব্রিজ? যাদবপুর বিশ্বিবদ্যালয়ের নির্মাণ ও প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক পার্থপ্রতিম বিশ্বাসের বক্তব্য, ‘আধুনিক কোনও প্রযুক্তিই বেইলি ব্রিজের মতো করে চটজলদি সেতুবন্ধন করতে পারে না। এই ব্রিজগুলি ছোট, অস্থায়ী, কিন্তু অত্যন্ত উপযোগী। যে নকশা ও প্রযুক্তি অনুসরণ করে এই সেতু নির্মাণ করা হয়, তা সরল এবং যুগান্তকারী। ছোট ছোট কাঠামো জুড়ে সেতুটি বানাতে ক্রেন পর্যন্ত দরকার পড়ে না।’ তিনি জানান, কয়েক বছর আগে কলকাতা থেকে শান্তিনিকেতন যাওয়ার পথে গুসকরার কাছে একটি ব্রিজ ভেঙে যাওয়ার পর সেখানেও তৈরি করা হয়েছিল বেইলি ব্রিজ। নতুন ব্রিজ মেরামত হয়ে গেলে বছর দেড়েক পরে খুলে ফেলা হয় সেটি। এই ধরনের সেতু উত্তরবঙ্গ-সহ পাহাড়ি এলাকায় আকছার দেখা যায়। অনেক জায়গায় অবশ্য তা স্থায়ী সেতু হিসেবেই ব্যবহার করা হয়। নকশার গুণে তাতেও জীর্ণ হয় না সেতু।
প্রসঙ্গত, ব্রিটিশ মিলিটারি ইঞ্জিনিয়ার ডোনাল্ড বেইলি ১৯৩০-এর দশকে এই সেতুর নকশা বানিয়েছিলেন, তবে সেটা নিছক শখেই। ১৯৪০ সালে ক্রাইস্টচার্চ, হ্যাম্পশায়ারে বেইলি ব্রিজ প্রথম বারের জন্য পরীক্ষামূলক ভাবে ব্যবহার করা হয়। এই ব্রিজ দ্রুত তৈরি হয় বলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ১৯৪১ থেকে এই ব্রিজ দেদার ব্যবহার শুরু করে ব্রিটিশ সামরিক বাহিনী। পরে যুদ্ধের প্রয়োজনে দারুণ জনপ্রিয় হয়ে ওঠা বেইলি ব্রিজ ব্যবহার শুরু করে কানাডা ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর অসামরিক প্রয়োজনেও সারা বিশ্বে বহুল ব্যবহার শুরু হয় বেইলি ব্রিজের।
চেতলা খালের উপরে অস্থায়ী সেতু তৈরি করবে গার্ডেনরিচ শিপ বিল্ডার্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ার্স। বুধবার সংস্থার চেয়ারম্যান ও ম্যানেজিং ডিরেক্টর বিপিনকুমার সাক্সেনা বলেন, ‘মঙ্গলবার রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয়েছে। ১০-১২ দিনের মধ্যে সেতু নির্মাণ করে দেওয়া সম্ভব।’ বিপিনকুমার আরও জানান, মাঝেরহাটে চেতলা বোট ক্যানালের উপরে ৮০ ফুট লম্বা ও সা়ড়ে ৪ মিটার চওড়া দু’টি বেইলি ব্রিজ তৈরির কথা বলা হয়েছে। সংস্থা সূত্রের খবর, এগুলি প্রি ফ্যাব্রিকেটেড ইস্পাত সেতু। বিভিন্ন অংশ জুড়ে ভিতের উপরে বসিয়ে দিলেই সেতু তৈরি হয়। আলাদা করে ঢালাই বা নির্মাণের দরকার হয় না। এক-একটি সেতু প্রায় ৮৭ টন ভার বহনে সক্ষম। তার উপর গিয়ে গাড়ি অনায়াসে যেতে পারবে। দু’টি সেতুর জন্য রাজ্য সরকারকে প্রায় ২ কোটি টাকা দিতে হবে।