সাম্প্রতিক কালে সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি নতুন ট্রেন্ড শুরু হয়েছে। নানারকম কোটেশন বা মন্তব্য লিখে সেগুলিকে বিভিন্ন বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নামে চালিয়ে দেওয়া। এবার ঠিক তেমনই এক কাজ করে বিতর্কের সৃষ্টি করল খোদ মোদী সরকার। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের নির্দেশিকায় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হিন্দী ভাষা-সংক্রান্ত ‘উদ্ধৃতি’ নিয়েই বিতর্কের সূত্রপাত। হায়দ্রাবাদ কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে ‘হিন্দি পাখওয়াড়া’ (পক্ষকাল) উদযাপনের একটি পোস্টারে সেই রবীন্দ্র-উদ্ধৃতি ছড়িয়েছে সমাজমাধ্যমে। তাতে হিন্দিতে লেখা, ‘ভারতীয় ভাষাগুলি নদী। হিন্দী মহানদী।’ রবীন্দ্রনাথ ঠিক কবে, কখন এই কথাগুলি বলেছিলেন বা লিখেছিলেন, সেই সংশয়ের পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথের মুখে এমন ভাষা-তত্ত্ব প্রচারের উদ্দেশ্য নিয়েও শিক্ষাজগতের অন্দরেই প্রশ্ন উঠছে।
হায়দ্রাবাদ কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার পি সর্দার সিংহ অবশ্য জানাচ্ছেন, ‘কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশ মেনেই সব কিছু করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় নির্দেশিকাতেই রবীন্দ্র-উদ্ধৃতিটি রয়েছে।’ ভাষা নদীর মতো। উপমাটি পুরনো। বাংলা ভাষা নিয়ে এ কালের জনপ্রিয় গানও বলছে, ‘মেশে তেরো নদী, সাত সাগরের জল গঙ্গায় পদ্মায়’! কিন্তু সে নদীর কোনটি নদী, মহানদী বা উপনদী এমন তত্ত্বে ভাষাতত্ত্ববিদেরাও বিরক্ত। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাতত্ত্বের বিভাগীয় প্রধান সমীর কর্মকার যেমন বলছেন, ‘রবীন্দ্রনাথের ভাষাদর্শনে ভাষার আন্তঃসম্পর্কের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু ভাষার জগতে আধিপত্যে তাঁর বিশ্বাস ছিল না।’
তথাকথিত রবীন্দ্র-উদ্ধৃতিটি রবীন্দ্রনাথের ভাষা নিয়ে ধারণার সঙ্গে খাপ খায় বলে মনে করেন না বিশ্বভারতীর বাংলা বিভাগের শিক্ষক বিশ্বজিৎ রায়ও। তিনি বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথের ভারতবর্ষ বহু ভাষার দেশ। তিনি বিভিন্ন ভাষার গুরুত্ব মানতেন। ‘হিন্দী ভবন’ প্রতিষ্ঠা করলেও ১৯২৩এ কাশীতে উত্তর-ভারতীয় বঙ্গসম্মেলনে স্পষ্ট বলেন, ভারতবর্ষে পরস্পরের ভাবের আদান-প্রদানের জন্য ইংরেজি বা কোনও একটি ভাষাকে ওপর থেকে চাপালে চলবে না। চাই সহজ বিনিময়।’ রবীন্দ্রনাথের বিপুল রচনাসমূহের কোথায় তিনি উদ্ধৃত অংশটি উচ্চারণ করেছেন, তা নিশ্চিত নন বিশ্বজিৎ বা সমীরবাবু।
জহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে স্কুল অব সোশ্যাল সায়েন্সেসে শিক্ষাতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক মিনতি পান্ডাও বলছেন, ‘এই ভাবে আলটপকা রবীন্দ্রনাথের উদ্ধৃতির প্রয়োগ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। উদ্ধৃতি দিলে কোথায় কী প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ এমন বলেছেন, সবটা বলা উচিত ছিল। স্বাধীনতার আগে রবীন্দ্রনাথ, গান্ধী অনেকেই ভারতে সংযোগের ভাষা হিসেবে হিন্দী নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করেছেন। কিন্তু সেই প্রাসঙ্গিকতা এখন আছে বলা যায় না।’ তাঁর মতে, স্বরাষ্ট্র দফতরের নির্দেশিকায় হিন্দী পাখওয়াড়া পালনের পিছনে সরকারি ভাষা, সংযোগের ভাষা, বিশ্ব ভাষা হিসেবে হিন্দীর গুরুত্বের কথা বলতে গিয়ে আসলে অ-হিন্দিভাষী পরিমণ্ডলের বিশ্বকবির মুখে হিন্দি-প্রশস্তি বসিয়ে দেশে হিন্দি চাপানোর স্বীকৃতি খোঁজা হচ্ছে।