কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের চারশো বছর পূর্তি উপলক্ষে শিকাগোতে এক বিরাট বিশ্বমেলার আয়োজন করা হয়েছে। পৃথিবীর বহু দেশের শিল্পসম্ভার, বাণিজ্যসম্ভার, বস্ত্র ও ধাতুদ্ৰব্য, সব মিলিয়ে এক মহা প্রদর্শনী, তার সঙ্গে রয়েছে বহুবিধ আমোদপ্রমোদের ব্যবস্থা। এই বিশ্বমেলারই এক অংশে এক ধর্ম সম্মেলন আহুত হয়েছে। পৃথিবীর সমস্ত ধর্মের প্রতিনিধিরা সেখানে এক মঞ্চে বসে মত বিনিময় করবেন। বিশ্বমেলার চেয়েও এই ধর্মসভা বেশ গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। ধর্ম মানেই রেষারেষি, ধর্ম মানেই পরমত অসহিষ্ণুতা। যদিও সব ধর্মেই আছে এক পরমেশ্বরের কথা এবং মানুষ মাত্রেই সেই পরমেশ্বরের সন্তান, কিন্তু তা হলে যে আলাদা আলাদা ধর্মের অস্তিত্ব বজায় রাখাটাই অর্থহীন, তা ধর্মীয় নেতাদের মাথায় ঢোকে না। পৃথক পৃথক ধর্মের অস্তিত্ব মুছে দিয়ে একটি মাত্র মানবধর্ম প্রচার করলে যে এতগুলি ধর্মগুরুর গুরুগিরি মুছে যায়। তাই প্রকৃতপক্ষে ছোট-বড় মিলিয়ে পৃথিবীতে এখন অনেকগুলি ধর্মমত, তাদের প্রত্যেকের আলাদা আলাদা সর্বশক্তিমান পরমেশ্বর, সেই পরমেশ্বরের সন্তান-সন্ততিদের সংখ্যা নিজ সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমিত। এক সম্প্রদায়ের ধর্মগুরুরা অন্য ধর্মগুলিকে নস্যাৎ করার জন্য কাল্পনিক অভিযোগ, অসত্য এমনকী কুৎসিত, কদর্য, হিংস্র ভাষা প্রয়োগ করতেও দ্বিধা করে না। আহ্বান জানানো হয়েছে পৃথিবীর প্রায় সমস্ত উল্লেখযোগা ধর্মের প্রতিনিধিদের। ইহুদি, মুসলমান, বৌদ্ধ, তাও, কনফুসিয়ান, শিন্টো, পারস্যের অগ্নি উপাসকদের ধর্ম, ক্যাথলিক, গ্রিক চার্চ, প্রটেস্টান্ট ইত্যাদি। এমনকী থিয়োসফিস্ট ও ব্রাহ্মদেরও ডাকা হয়েছে। শুধু হিন্দু ধর্ম বাদ। হিন্দু ধর্মটা আবার কী? এ দেশের লোক কিছুই জানে না, শুধু কিছু কিছু বমন উদ্রেককারী গল্প শুনেছে। হিন্দু মেয়েরা স্বামীর সঙ্গে জ্বলন্ত চিতায় পুড়ে মরে, মায়েরা নিজের সন্তানদের নদীতে কুমিরের মুখে জুড়ে দেয়, হিন্দুদের মধ্যে ব্রাহ্মণ নামে এক বিচিত্র প্রাণী আছে, অন্য কেউ তাদের ছুঁয়ে দিলেই তারা তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠে, সেই লোকদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়, জগন্নাথের রথের চাকায় হাজার হাজার লোক চাপা পড়ে …। এই কোনও গল্পই পুরোপুরি মিথ্যে নয়। কিন্তু এর বাইরেও যে হিন্দু ধর্মে মহৎ কোনও চিন্তা বা আদর্শ আছে, তা হিন্দুরাই ভুলে গেছে। হিন্দুদের নাকি ‘বেদ’ নামে একটি ধর্মগ্রন্থ আছে, তা হিন্দুরাই পড়ে না, পড়লেও বুঝতে পারত না অবশ্য, সেই বই পাওয়াই যায় না বলতে গেলে। মহা জলধিতে বেদ একবার সুপ্ত হয়েছিল, এখনও প্রায় সেই অবস্থা। কোনও হিন্দু প্রতিনিধিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। জানালেই বা কে আসত? হিন্দুদের মধ্যে অসংখ্য দলাদলি, তাঁদের মুখপাত্র কে হবে? সে রকম কেউ নেই। অন্যান্য প্রতিনিধিদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল যে তাঁদের নিজ ব্যয়ে জাহাজে আসতে হবে। শিকাগো শহরে পৌঁছবার পর তাঁদের আহার ও আশ্রয়ের দায়িত্ব নেবে সম্মেলন কর্তৃপক্ষ। কোনও হিন্দুকে আমন্ত্রণ জানাবার প্রশ্নই ওঠে না আরও এই কারণে যে, কোনও নিষ্ঠাবান হিন্দু তো জাহাজেই চাপবে না। সমুদ্রে পাড়ি দেওয়া তাঁদের ধর্মে নিষিদ্ধ! বহু শতাব্দী ধরে হিন্দুরা কুপমণ্ডুক, তাঁরা সমুদ্রকে ভয় পায়, সমুদ্র চিনল না বলে তাঁরা পৃথিবীকেও চিনল না। তাঁরা শুধু ঘরে শুয়ে শুয়ে প্রাচীন কালের মহিমা নিয়ে জাবর কাটতে পারে। আমন্ত্রিত বক্তা-অতিথি ছাড়াও শ্রোতা এবং দর্শক হিসেবেও নিজেদের উদ্যোগে এসেছে বহু দেশের মানুষ। ভারত থেকে এ রকম একটা দল আসবার একটা কথা উঠেছিল বটে। বোম্বাইয়ের মেসার্স কারসেটজি সোরাবজি অ্যান্ড কোম্পানি নামে এক জাহাজ কোম্পানির পারসি মালিকরা একটা ‘হিন্দু জাহাজ’ ছাড়ার প্রস্তাব দিয়েছিল। এ জাহাজে পুরোপুরি হিন্দুয়ানি বজায় রাখবার জন্য হিন্দু ব্রাহ্মণ রাঁধুনি, হিন্দু মোদক, হিন্দু পরিচারক, হিন্দু তত্ত্বাবধায়ক আর অ্যালোপ্যাথিক ডাক্তারের বদলে হিন্দু কবিরাজ রাখা হবে। পুরো যাত্রাপথে খাদ্যদ্রব্যে মাছ-মাংসের ছোঁয়া থাকবে না, সব নিরামিষ, চাল-ডাল-আলু বেগুনও নিয়ে যাওয়া হবে দেশ থেকে, আর থাকবে অনেকগুলি জালা ভর্তি গঙ্গাজল। যাওয়া-আসাও আমেরিকায় বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণ সমেত মোট চার মাসের জন্য ব্যয়ও এমন কিছু বেশি নয়, প্রথম শ্রেণীর তিন হাজার টাকা, দ্বিতীয় শ্রেণীর আড়াই হাজার ও পরিচারকদের জনা দেড় হাজার মাত্র। কিছু রাজা-মহারাজা-জমিদার এ পরিকল্পনা সমর্থন করেছিলেন, বাংলার মহারাজকুমার বিনয়কৃষ্ণ দেব বাহাদুর, মহামহোপাধ্যায় মহেশচন্দ্র ন্যায়রত্ন, রায়বাহাদুর কৈলাসচন্দ্র মুখার্জি প্রমুখ কয়েকজন উৎসাহী ছিলেন যাওয়ার ব্যাপারে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত যথেষ্ট যাত্রী পাওয়া গেল না, জাহাজ কোম্পানি পরিত্যাগ করলেন পরিকল্পনাটি।
এগারোই সেপ্টেম্বর সোমবার সকাল দশটায় বিশ্বমেলার হল অফ কলম্বাসে এই ধর্মসভার উদ্বোধন। আমন্ত্রিতরা বাইরে থেকে সারবদ্ধ হয়ে একশো ফুট লম্বা মঞ্চের ওপর এসে দাঁড়ালেন, নেপথ্যে ঘণ্টাধ্বনি হতে লাগল। মঞ্চের ঠিক মাঝখানে একটি লোহার সিংহাসন, তাতে বসবেন আমেরিকার ক্যাথলিকদের সর্বপ্রধান ধর্মর্যাজ কার্ডিনাল গিবস। তাঁর দু পাশে তিন সারিতে তিরিশটি করে কাঠের চেয়ার অন্যদের জন্য। খ্রিস্টানদের কার্ডিনাল বলে কথা, তাঁকে তো সিংহাসন দিতেই হবে। বক্তাদের মধ্যে ভারতীয় আছেন বেশ কয়েকজন। বৌদ্ধ ধর্মের প্রতিনিধি ধর্মপাল, জৈন ধর্মের বীরচাঁদ গান্ধী, থিওসফিস্ট জ্ঞানেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী ও অ্যানি বেশান্ট, ব্রাহ্ম সমাজের বি বি নাগরকর ও প্রতাপচন্দ্র মজুমদার প্রমুখ। প্রতাপচন্দ্র মজুমদার দশ বছর আগে একবার আমেরিকা ঘুরে গেছেন, তিনি সুবক্তা ও সুপুরুষ। কেশব-শিষ্য প্রতাপচন্দ্র একেশ্বর ব্রাহ্ম ধর্মের সঙ্গে খ্রিস্ট ধর্মকে মেশাতে পারেন চমৎকারভাবে, তাই তিনি এ দেশে আগে থেকেই কিছুটা জনপ্রিয়। এখানে ঢোকার সময়েই প্রতাপচন্দ্র দেখলেন, তাঁদের সঙ্গে সঙ্গে আসছে বিচিত্র পোশাক পরা এক ব্যক্তি। অন্য সকলেই খয়েরি ধরনের চাপা রঙের পোশাক পরে এসেছেন, আর এই লোকটার গায়ে একটা ক্যাটকেটে কমলা রঙের হাঁটু পর্যন্ত ঢোলা আলখাল্লা, কোমরে কোমরবন্ধ, মাথায় ওই রঙেরই এক বিরাট পাগড়ি। প্রতাপচন্দ্র ভুরু কুঁচকিয়ে ভাবতে লাগলেন, এ মূর্তিমানটি আবার কে? কোন দেশের। মুখখানা কচি, বয়েস বেশি নয়, সকলের মধ্যে বয়ঃকনিষ্ঠ, এ আবার কোন ধর্মের লোক। অন্য ভারতীয়রাও এই অচেনা ব্যক্তিটিকে লক্ষ করেছেন। ধর্মপাল ফিসফিস করে প্রতাপচন্দ্রকে বললেন, হিন্দু, হিন্দু। শেষ মুহূর্তে নাকি একজন হিন্দু এসে ঢুকেছে। কৌতূহলে প্রতাপচন্দ্রর ভুরু কুঁচকে গেল। হিন্দু? দেশে থাকতে তিনি কোনও হিন্দু প্রতিনিধির কথা ঘুণাক্ষরেও শোনেননি। হিন্দুদের পক্ষ নিয়ে কেউ যাবে না, এ রকমই বরং শুনে এসেছেন। এ লোকটা কোথা থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসল? এর গায়ের আলখাল্লাটা ঠিক গেরুয়া নয়, হিন্দু সন্ন্যাসী কখনও সিল্কের চকচকে কমলা রঙের পোশাক পরে? সাধুরা আবার এত বড় পাগড়ি পরতে শুরু করল কবে থেকে? পাগড়িটা দেখলে মনে হয় কোনও রাজসভার দেওয়ান। প্রতাপচন্দ্র নিচু গলায় ধর্মপালকে জিজ্ঞেস করলেন, কোথাকার হিন্দু, নেপালের নাকি? ধর্মপাল বললেন, না, না, শুনেছি তো মাদ্রাজ, নাকি কলকাতার! কলকাতার? সেখানে এমন কোনও ধর্মীয় সম্প্রদায়ের নেতা থাকতে পারে, যাঁকে প্রতাপচন্দ্র চেনেন না? হতেই পারে না। এ কোনও জালিয়াত নাকি? প্রতাপচন্দ্র মনের মধ্যে হাতড়াতে লাগলেন। না, একে আগে কখনও দেখেছেন বলে তো মনে পড়ে না। অথচ এ ছোকরাটি তাঁকে চেনার ভান করে হাসছে। পুরো ব্যাপারটা তলিয়ে দেখতে হবে, ধর্ম সম্মেলন জালিয়াতির জায়গা নয়, এ যদি সে রকম কিছু হয় তা হলে সেটা ফাঁস করে দেওয়া তাঁর অবশ্যকর্তব্য। বলে কি না কলকাতা থেকে এসেছে? ও বোধ হয় জানে না, কলকাতা তথা বাংলার একমাত্র প্রতিনিধি তিনি, তাঁকে এখানকার অনেকেই আগে থেকে চেনে, তিনি কর্মসমিতির অন্যতম সদস্য, তিনি কিছু টের পেলেন না, আর কলকাতা থেকে একজন হিন্দু প্রতিনিধি হঠাৎ এখানে এসে উদয় হল? দর্শকরা যে এই কমলা রঙের পোশাক পরিহিত অতিথিটির মুখের কথা শোনার জন্য আগ্রহে অধীর হয়ে আছে, তা উদ্যোক্তারা টের পেয়ে গেছেন। অন্য সকলে একরকম, আর এ ব্যক্তিটি সম্পূর্ণ আলাদা, সুতরাং কৌতূহল তো হবেই। পরিচালকদের একজন এর কাছে এসে জিজ্ঞেস করছেন, এর পরের বার আপনি বলবেন তো? যুবকটি অমনি ছটফটিয়ে উঠে বলছে, না, না, আর একটু পরে। আর একটু পরে। এ রকম দু-তিনবার হল। দূর থেকে সব লক্ষ করছেন প্রতাপচন্দ্র। মুখ খুললেই ছোকরাটির বিদ্যেবুদ্ধির পরিচয় পাওয়া যেত, কিন্তু ও বারবার এড়িয়ে যাচ্ছে, তাতেই সন্দেহ আরও ঘনীভূত হচ্ছে। অনুষ্ঠান পরিচালক ডক্তর ব্যারোজ প্রতাপচন্দ্রের বন্ধুস্থানীয়। একবার তিনি প্রতাপচন্দ্রের পাশে এসে দাঁড়িয়ে সহাস্যে বললেন, মজুমদার, এর পরে আপনার পালা। আপনি তো খুব সুবক্তা, আপনি ফাটাবেন জানি।প্রতাপচন্দ্র নিজের কাগজপত্র গুছিয়ে নিতে নিতে জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা, ওই যে পাগড়ি পরা যুবকটিকে দেখছি, উনি কে? ডক্তর ব্যারোজ বললেন, উনি তো আপনারই দেশের লোক। আপনি ওঁকে চেনেন না? দু দিকে প্রবলভাবে মাথা নেড়ে প্রতাপচন্দ্র বললেন, না, আমি ওঁকে আগে কখনও দেখিনি। কী নাম? ডক্তর ব্যারোজ বললেন, কী নাম, কী নাম, দাঁড়ান দেখছি, এই যে, বেশ শক্ত উচ্চারণ করা, সোয়া … সোওযামী ভিভ কান! প্রতাপচন্দ্র ভুরু উত্তোলন করে রইলেন। সোওয়ামী না হয় বোঝা গেল যে স্বামী। কিন্তু ভিভ কান? এ রকম নাম তিনি সাত জন্মে শোনেননি। বাঙালির আবার এ রকম উদ্ভট নাম হয় নাকি? ধর্মপালের কাজকর্ম কলকাতা কেন্দ্রিক হলেও তিনি কলকাতার বুদ্ধিজীবী মহলের সঙ্গে তেমন সম্পৃক্ত নন। আর জ্ঞানেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী বাঙালি বটে কিন্তু এলাহাবাদের অধিবাসী। জ্ঞানেন্দ্রনাথ বসেছেন মঞ্চের অন্য দিকে, কাছাকাছি থাকালে তাঁর সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করা যেত।
নরেনের রূপান্তর এবং আমেরিকার এই ধৰ্ম মহাসম্মিলনে উপস্থিতির পশ্চাৎপট অনেকটা রূপকথার মতন অবিশ্বাস্য শোনায় তো বটেই, প্রায় যেন অলৌকিকত্বের ধার ঘেঁষে যায়। সেই নরেন, আর এই নরেন! বরানগর মঠের সেই ছিন্নক পরিহিত ভিক্ষাজীবী এক বাউণ্ডুলে যুবক, আর আমেরিকার এই মহতী জনসভায় সম্মানিত অতিথি। বরানগরের সেই জীর্ণ পোড়ো বাড়ি, সাপখোপ, শেয়ালের উৎপাত আর প্রতিবেশীদের তর্জনগর্জন। শ্রীরামকৃষ্ণ নেই, মাসের পর মাস দশ-বারোজন ভক্ত তবু কায়ক্লেশে জড়ামড়ি করে এখানে পড়ে আছে। আত্মীয়-স্বজনরা বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যাবার জন্য টানাটানি করে মাঝে মাঝে, তবু তারা মঠ ছেড়ে যায় না, যদিও তারা নিজেরাও জানে না যে তাদের ভবিষ্যৎ কী? এখানে তারা নানান শাস্ত্র পাঠ করে, কখনও ঘণ্টার পর ঘন্টা কীর্তন গানে মেতে থাকে। রাত জেগে হইহুল্লোড় কবে, কিন্তু এইভাবেই কি দিন কাটবে? গৃহী ভবা অর্থসাহায্য করে, আবার সংসারের নানা কাজের ব্যস্ততায় মাঝে মাঝে ভুলেও যায়। তখন এঁরা ভিক্ষে করতে বাধ্য হয়। সেই ভিক্ষা পাক হয় বটে কিন্তু থালা বাসন কিছু নেই। একদিন কলাপাতা কাটতে যাওয়ায় বাগানের মালির কাছে গালাগালি খেতে হয়েছিল বলে এখন ভেঙে আনে বড় বড় মানকচু পাতা, সেই পাতায় ঢালা হয় সবটা ভাত, তার সঙ্গে শুধু লঙ্কার ঝোল, সবাই একসঙ্গে গোল হয়ে বসে সেই ভাত আর ঝোল তুলে তুলে খায়। এতে কৃচ্ছ্রসাধনা হচ্ছে বটে, কিন্তু এর পরিণাম কী? শরীরগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে, এর পর রোগব্যাধি, তারপর মৃত্যু! সবাই বলাবলি করছে, এই ছেলের দল নিতান্ত পাগলামিতে মেতেছে, বরানগরের এই মঠ টিকিয়ে রাখার আর দরকার নেই, যে যার ঘরে ফিরে যাক না। ক্রমে দল ভাঙতে লাগল, নৈরাশ্যে নয়, গৃহীদের উপদেশে নয়, আত্মীয়-স্বজনের অনুরোধ-কান্নাকাটিতে, আহার-শয়নের কষ্টের জন্যও নয়, নিছক একঘেয়েমির কারণে। এক একজন মঠ ছেড়ে চলে যেতে লাগল, বাড়ি ফিরল না, বেরিয়ে পড়ল তীর্থযাত্রায়। নরেনের পারিবারিক সঙ্কট খুব তীব্র, আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে মামলামোকদ্দমা চলেছে তো চলছেই, মাঝে মাঝে সে দিনের বেলা বাড়ি যায়, মামলা তদারকি করে, রাত্তিরে মঠে ফিরে আসে। মায়ের কষ্ট সে দেখতে পাবে না। মাকে সে সবরকম সাহায্য করতে চায়, কিন্তু এ কথাও সে জানিয়ে দিয়েছে যে সে আর কখনও গৃহী হবে না, ঘর তার জন্য নয়। সাপ আর সন্ন্যাসীর কোনও নিজস্ব বাসা থাকে না। নিক্ষিপ্ত তীর আর ফেরে না। এক সন্ধেবেলা নরেন কলকাতা থেকে বনগরের মঠে ফিরে এসে শুনল যে এক গুরুভাই সারদা গোপনে মঠ ছেড়ে কোথায় যেন চলে গেছে। শুনেই খুব উতলা বোধ করল নরেন। সারদার বয়েস বেশ কম। প্রায় বালক বলা যায়, সে একা একা কোথায় যাবে, কী বিপদে পড়বে কে জানে। কিছুক্ষণ পরে সারদার একটা চিঠি পাওয়া গেল নরেনকে লেখা। সে লিখেছে যে, পায়ে হেঁটে বৃন্দাবন যাবার অভিপ্রায়ে সে বেরিয়ে পড়েছে। ইদানীং সে স্বপ্ন দেখে ভয় পাচ্ছিল। স্বপ্নে সে মা বাবা আর বাড়ির লোকজনদের দেখতে পায়, তাঁরা যেন হাতছানি দেয়। এ তো মায়ার হাতছানি। এর মধ্যে দু’বার সে বাড়িতে ছুটে চলেও গিয়েছিল। তারপর সে ঠিক করেছে, এই মায়াপাশ কাটাতেই হবে। একবার সন্ন্যাসী হয়ে আবার সে গৃহী হতে পারবে না। তাই সে চলে যাচ্ছে বহু দূরে। কয়েক দিন নরেন খুব চিন্তিত হয়ে রইল। সারদার ঘটনাটা তার মনে একটা জোর ধাক্কা দিয়েছে। সারদা চলে গেছে শুনে সে এত বিচলিত হয়ে পড়েছিল কেন, সারদা তাঁর কে? সন্ন্যাসীর আবার কোনও বন্ধন থাকে নাকি? নিজের সংসার ছেড়ে এসে সে কি এই মঠের সংসার চালাচ্ছে? এখানে অনেক সমস্যার সমাধান করতে হয় তাঁকেই। সন্ন্যাসীর পক্ষে এক জায়গায় বেশি দিন থাকা মানায় না। বহতা জল আর রমতা সাধু, এরাই পবিত্র থাকে। এবার নরেনকেও বেরিয়ে পড়তে হবে। সে এ দেশটাকে চিনতে চায়।
কারুকে কিছু না জানিয়ে নরেন একদিন মঠ ছেড়ে চলে গেল। তারপর শুরু হল তাঁর পরিব্রাজক জীবন। পিছুটান নেই, সামনেও নির্দিষ্ট কোনও অভীষ্ট নেই। শুধু চলা, কখনও পায়ে হেঁটে, কখনও ট্রেনে। অঙ্গে গেরুয়া কৌপীন, হাতে একটি লম্বা লাঠি আর কমণ্ডলু, আর একটা পুঁটলিতে খানকতক বই। পড়ার নেশা সে ছাড়তে পারে না। পড়ার ব্যাপারে তাঁর বাছবিচার নেই, সে যেন বেদান্ত পড়ে, তেমনি জুল ভার্ন-এর রোমাঞ্চকর উপন্যাসও পড়ে। কোথাও কেউ ভাল ভাল খাবার দিলে সে বিনা দ্বিধায় পেট পুরে খায়, আবার কোনওদিন একমুঠো ছাতু জুটলে তাই সই। পয়সার কোনও বালাই নেই, কেউ ট্রেনের টিকিট কেটে দিলে সে ট্রেনে চাপে, সেরকম কেউ না দিলে সে হাঁটে। কিছুর জন্য ব্যস্ততা তো নেই তাঁর। নরেন কাশীর বিশ্বনাথ মন্দির যেমন দেখতে যায়, তেমনি সে আগ্রার তাজমহলও দেখতে যায়। গাজীপুরের পওহারি বাবার মতন তপঃক্লিষ্ট সাধুর কাছে যেমন সে গিয়ে পড়ে থাকে, তেমনি বারাণসীতে পণ্ডিতপ্রবর ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গেও তর্কে মাতে। ভক্তির জন্য সে জ্ঞানকে ছাড়েনি, আবার জ্ঞানের জন্য সে সৌন্দর্যবোধও বিসর্জন দেয়নি। বেশ কিছুকাল ঘোরাঘুরির পর এক জায়গায় অসুস্থ হয়ে পড়ল নরেন। শরীরের ওপরে নিপীড়নের মাত্রা বেড়ে গিয়েছিল, এবার শরীর বুঝি যায় যায়। এক নবলব্ধ শিষ্য পরিবার তাঁকে পৌঁছে দেয় কলকাতায়। বরানগরের মঠে শশী, রাখাল, বাবুরাম, লাটুদের সেবায় সাহচর্যে সুস্থ হয়ে উঠল সে, কিছুদিন আনন্দে কাটল, কিন্তু পথ যাঁকে একবার টেনেছে, সে আর ঘরে থাকবে কী করে? বাঙালিরা ছড়িয়ে আছে সারা ভারতে। ডাক্তার, উকিল, সাংবাদিক, স্কুল মাস্টার, রেলের স্টেশন মাস্টার অধিকাংশই বাঙালি। বাঙালিরা আগে ইংরিজি শিখেছে, তাই এই সব জীবিকায় তাঁরা অগ্রণী। অনেক জায়গাতেই নরেনের থাকার জায়গা জুটে যায়। কোথাও কোথাও হঠাৎ হঠাৎ নরেনের প্রেসিডেন্সি কলেজের বন্ধুরও সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। তাঁরা সব প্রতিষ্ঠিত, উচ্চ চাকুরে, আর নরেনের ধূলিধূসরিত খালি পা, ময়লা চিটচিটে গেরুয়া বসন, কোটরে বসা দুই চোখ, মাথার চুলে জট। নরেনের কলেজি বন্ধুরা নরেনকে চিনতে পেরে স্তব্ধবাক হয়ে যায়। এক স্থানে আশ্রয় পেলে সেই আশ্রয়দাতাই পরবর্তী কোনও স্থানের পরিচিত ব্যক্তির ঠিকানা দিয়ে দেয়। ক্রমে নরেনের পরিচিতের সংখ্যা বাড়ে। রাস্তার ধারে মুচি কিংবা উচ্চপদস্থ রাজপুরুষও বন্ধু হয় তাঁর। ট্রেনে যাওয়ার সময় নরেনের চেহারা দেখে ও দু’একটি কথা শুনেই আকৃষ্ট হয় সহযাত্রীরা। নরেন গৌরবর্ণ সুপুরুষ, তাঁর মুখে কখনও দীন ভাব ফোটে না, সে নিঃস্ব হলেও কারুর কৃপাপ্রার্থী নয়। তা ছাড়া নরেনের ইংরিজি পরিষ্কার, ওজস্বিনী। ইংরিজি বলা সাধু এ দেশে কেউ আগে দেখেনি। এ সাধু শুধু ইংরিজি বলে না, প্রাচ্য পাশ্চাত্যের ধর্ম ও দর্শন সম্পর্কে অগাধ জ্ঞান এবং চিন্তা-ভাবনায় আধুনিক। ট্রেনের কামরাতেই একবার নরেনের সঙ্গে মহারাষ্ট্রের প্রসিদ্ধ জননেতা বালগঙ্গাধর তিলকের সঙ্গে পরিচয় হয়। তিলক রামকৃষ্ণ পরমহংসের নাম শোনেননি, নরেন সম্পর্কে কিছুই জানেন না, শুধু তাঁর কথা শুনে মুগ্ধ হয়ে নিজের বাড়িতে ডেকে এনে স্থান দিলেন কয়েক দিনের জন্য।
ক্রমে এই শিক্ষিত, তরুণ, সুদর্শন সন্ন্যাসীর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে উচ্চ মহলে। রাজস্থান ও দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন রাজপরিবার তাঁকে অতিথি হিসেবে পেয়ে ধন্য হয়। আলোয়ার, কোটা, খেতড়ি, রামনাদের রাজা, হায়দারাবাদের নিজাম, অন্যান্য ভারতীয় রাজন্যবর্গের মধ্যে যিনি প্রধান হিসেবে গণ্য, সেই মহীশুরের রাজার সঙ্গেও তাঁর বন্ধুত্ব হয়। প্রত্যেকেই নরেনের বিদ্যাবুদ্ধির পরিচয় পেয়ে বিস্মিত। তাঁরা বুঝতেই পারে না, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক কৃতী পুরুষ এরকম পাগলের মতন ঘুরে বেড়ায় কেন? আলোয়ার রাজ্যের মহারাজ একদিন তো জিজ্ঞেস করেই ফেললেন, স্বামীজি, আমি তো শুনেছি আপনি বিদ্বান ও মহাপণ্ডিত। ইচ্ছে করলেই প্রচুর অর্থ উপার্জন করতে পারেন। তবু আপনি ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন করে ঘুরছেন কেন? নরেন সহাস্যে বলল, আগে আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দিন তো। আপনি রাজকার্যে অবহেলা করে প্রায়ই জঙ্গলে গিয়ে সাহেবদের মন জন্তু-জানোয়ার শিকার ইত্যাদি আমোদ-প্রমোদে সময় কাটান কেন? মহারাজ থতমত খেয়ে বললেন, হ্যাঁ, ওসব করি বটে, তবে কেন করি তা বলতে পারি না। ভাল লাগে, ভাল যে লাগে তা নিঃসন্দেহে বলতে পারি। নরেন বলল, আমারও ভাল লাগে বলেই আমি ফকির সেজে এখানে সেখানে ঘুরে বেড়াই। আর একজন নরেনকে জিজ্ঞেস করেছিল, আপনি গেরুয়া পরেন কেন? গেরুয়া কাপড়ের কী বৈশিষ্ট্য আছে? নরেন সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল, সাধারণ লোকের মতন জামা-কাপড় পরলে আমি খুব বিপদে পড়তাম। দেশে তো ভিখারির অভাব নেই। পথের ভিখারিরা আমাকে ভদ্দরলোক মনে করে ভিক্ষা চাইত। কিন্তু আমি তো নিজেই একজন ভিক্ষুক, আমার হাতে একটা পয়সাও থাকে না। আবার কোনও প্রার্থীকে ফিরিয়ে দিতেও কষ্ট হয়। তাই গেরুয়া পরি। আমাকেও ভিক্ষুক মনে করে ভিখারিরা পয়সা চায় না। কোনও কোনও রাজা নরেনের সঙ্গে দু’চারদিন আলাপ-আলোচনা করে এতই মুগ্ধ হয় যে তাঁরা নরেনকে রাজগুরু পদে বরণ করে ধরে রাখতে চায়। কিন্তু নরেন যে রমতা সাধু, তাঁর শিকড় গাড়তে নেই। সব অনুরোধ-উপরোধ অগ্রাহ্য করে, রাজভোগ ছেড়ে সে আবার নেমে পড়ে পথে। আজ সে রাজার অতিথিসদনে রাত কাটাচ্ছে, পরদিন কোনও গাছতলায়। কেউ কিছু উপহার দিলেও সে নেয় না। অনেকে জোর করে পকেটে টাকা গুঁজে দিতে চায়, নরেন প্রত্যাখ্যান করে, খুব পীড়াপীড়ি শুনলে বলে, আপনি বরং পরবর্তী গন্তব্যের জন্য আমার একটা ট্রেনের টিকিট কেটে দিন। মহীশুরের মহারাজ বহু মূল্যবান সোনা রুপোর দ্রব্য দিতে চেয়েছিলেন, একেবারে কিছু না গ্রহণ করলে অশিষ্টতা প্রকাশ পায়, কোনও ধাতু দ্রব্যই সে নিতে পারে না, শেষ পর্যন্ত সে শুধু একটা চন্দন কাঠের ছোট হুঁকো নিয়ে পুঁটুলিতে রাখল। আর সব ছাড়লেও তামাকের নেশা নরেন কিছুতেই ছাড়তে পারেনি। আমেরিকাতে এসেও একটা চুরুটের দাম আট আনা দেখে সে আঁতকে উঠেছিল। দিনে সাত-আটখানা চুরুট তো তাঁর লাগেই।
আমেরিকায় পাড়ি দেবার ইচ্ছেটা তার মনে একটু একটু করে দানা বাঁধছিল, মনঃস্থির করতে অনেক সময় লেগেছে। হরিদ্বার-হৃষিকেশ থেকে দ্বারকা, ত্রিবাম থেকে সেতুবন্ধ রামেশ্বর, হিমালয় থেকে কন্যাকুমারী, সারা ভারতবর্ষ এফোঁড় ওফোঁড় করে ঘুরে বেড়াল নরেন। পর্যটনে শুধু তো প্রকৃতির রূপ দেখা হয় না, মানুষই প্রধান দ্রষ্টব্য। মানুষ, মানুষ, অসংখ্য মানুষ। রাজা-মহারাজা আর ক’জন? সচ্ছল চাকুরিজীবী, ব্যবসায়ীই বা কত? অধিকাংশই তো দরিদ্র, নিপীড়িত জনসাধারণ। দুবেলা আহার জোটে না, মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই। দারিদ্র্যের এমনই কুম্ভীপাক যে কেউ বিদ্যা শিক্ষার সুযোগ পায় না, শিল্প-সংস্কৃতি নিয়ে মাথা ঘামায় না, ধর্মের মর্মও বোঝে না। যে মহান ভারতের ঐতিহা নিয়ে আমরা গর্ব করি, তার অবস্থা এখন এত নিম্নস্তরে এসে পৌঁছেছে! তিরিশ কোটি মানুষ, তার মধ্যে শতকরা একজন মাত্র ইংরেজি শিক্ষিত। ইদানীং সেই শিক্ষিতদের মধ্যেও বেকারের সংখ্যা প্রচুর। তাঁরা কৃষিভিত্তিক সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন, আবার ইংরেজি শিখেও জীবিকার সংস্থান করতে পারে না। ইংরেজের শাসনের প্রধান উদ্দেশ্য শোষণ, ভারতীয়দের নিজস্ব সম্পদ বলতে আর কিছু নেই। এইরকম অবস্থায় ধর্মেরও অধঃপতন হয়। জ্ঞান মার্গ, ভক্তি মার্গ, যুক্তি মার্গ সব চুলোয় গেছে, এখন শুধু ছুঁৎ মার্গ! জাত-পাতের হাজার বিভেদ। হিন্দু ধর্মে ধর্মান্তর নেই, অন্য দেশে তারা ধর্ম প্রচার করতে যায়নি, অন্য ধর্মের মানুষদের হিন্দু ধর্মের আশ্রয়ে টেনে আনেনি কখনও, বরং নিজেদের ধর্মের মানুষদেরই জাতিচ্যুত করেছে। অপমান করে দূরে ঠেলে দিয়েছে। এক এক সময় নরেনের মনে হয়েছে, চুলোয় যাক ধর্ম! যে ধর্ম মানুষের অপমান করে, তা আবার ধর্ম নাকি! দেশের দারিদ্র্য দূর করা, অসহায় মানুষদের সেবা করাই তো এখন প্রকৃত ধর্ম।
বরানগর মঠ ছাড়বার চার বছর পর নরেন সারা ভারত পরিভ্রমণ করে কন্যাকুমারীর এক শিলাতটে বসল। সামনে বিশাল নীল জলধি, পিছনে সমগ্র ভারতবর্ষ। সে একা একা বসে কাঁদল কিছুক্ষণ। এর পর সে কী করবে? বেদাস্ত চা আর জপতপ করে কাটিয়ে দেবে বাকি জীবন? তাঁর মনে পড়ছে অগণিত ক্ষুধার্ত মানুষের মুখ। সারা দেশ রসাতলে যাক, শুধু নিজের আত্মিক উন্নতি হলেই হল, এই তো ভেবে এসেছে এতকাল সন্ন্যাসীরা। কিন্তু এই ধর্মচর্যা তো নিতান্ত স্বার্থপরতারই নামান্তর। তাঁর গুরু রামকৃষ্ণ পরমহংসও বারবার বলেছেন, খালি পেটে ধর্ম হয় না। মোটা ভাত, মোটা কাপড়ের বন্দোবস্তু চাই। সমুদ্রে নেমে সাঁতার দিতে লাগল নরেন। অদূরে একটা পাথরের টিবি জেগে আছে সমুদ্রের বুকে। সেই পাথরে উঠে নরেন মহাসমুদ্রের দিকে পেছন ফিরে যেন দেখতে পেল ভারতের মহা জনসমষ্টি। অভুক্ত, অর্ধনগ্ন। এদের উদ্ধার করতে না পারলে ধর্মপ্রচার নিতান্ত অপপ্রয়াস। কীভাবে এঁদের উন্নতি করা সম্ভব? বিজ্ঞান ছাড়া গতি নেই। বৈজ্ঞানিক কারিগরি ও যন্ত্রপাতি নির্মাণে পশ্চিম দেশগুলি অনেক এগিয়ে গেছে। সেই কারিগরি নিয়ে আসতে হবে ভারতে। কিন্তু তারা দেবে কেন? ইংরেজরা তো কিছুতেই দেবে না। অন্য দেশগুলির কাছেও ভিক্ষুকের মতন হাত পাতালে তারা ঘৃণায় প্রত্যাখ্যান করবে। ভিক্ষুককে কেউ রেয়াত করে না। চাই বিনিময়। ওদের কাছ থেকে কিছু নিতে হলে ওদেরও কিছু দিতে হবে। এই রিক্ত, হীনবল ভারতের দেবার মতন কী আছে? স্বর্ণ নেই, শস্য নেই, শুধু এখনও রয়ে গেছে কিছু আধ্যাত্মিক জ্ঞান ও দর্শন। পশ্চিমের মানুষ এখন আধ্যাত্মিক ব্যাপারে নানান দ্বিধা, সংশয় ও নৈরাশ্যে ভুগছে। তাদের কাছে গিয়ে বলা যেতে পারে, তোমরা আমাদের উদরের অন্ন দাও, আমরা তোমাদের মানসিক খাদ্য দেব। পশ্চিম দেশে গিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে এ কথা বলা যাবে না। শিকাগোতে যে বিশ্ব ধর্ম সম্মেলন হচ্ছে, সেই মঞ্চই প্রকৃষ্ট স্থান, সেই মঞ্চে দাঁড়িয়ে এই বক্তব্য পৌঁছে দেওয়া যেতে পারে অনেকের কাছে। এর আগে বিভিন্ন স্থানে যখন বিদেশ যাত্রার প্রসঙ্গ উঠেছে, তখন অনেক রাজা-মহারাজা নরেনকে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু নরেন ঠিক করল, যদি ভারতের প্রতিনিধি হয়েই তাঁকে যেতে হয়, তা হলে ভারতের মানুষই তাকে চাঁদা করে পাঠাবে। সাধারণ মানুষের চাঁদা দেওয়ার সঙ্গতি নেই, টাকা তুলতে হবে মধ্যবিত্তদের কাছ থেকে। মাদ্রাজে কিছু শিক্ষিত তরুণ যুবক তাঁর খুব অনুরক্ত হয়ে পড়েছিল, এদের মধ্যে পেরুমল আলাসিঙ্গা নামের যুবকটি তাঁর বিশেষ ভক্ত। মাদ্রাজে ফিরে এসে নরেন আলাসিঙ্গাকে তাঁর অভিপ্রায়ের কথা জানাতেই সে খুব উৎসাহিত হয়ে উঠল। মাদ্রাজের এই যুবকদের নরেন সম্পর্কে বদ্ধমূল ধারণা জমে গেছে যে এই তেজস্বী তরুণ সন্ন্যাসী অসাধারণ কিছু কীর্তি রেখে যাবে। বাংলার কেউ কিছু জান না, গুরুভাইদের সঙ্গেও নরেনের অনেক দিন যোগাযোগ নেই, দক্ষিণ ভারতে চাঁদা তোলা হতে লাগল তাঁর জন্য। শেষ পর্যন্ত অবশ্য টাকা উঠল না, জাহাজ ভাঙা ও আনুষঙ্গিক খরচ আছে, আমেরিকায় কতদিন থাকতে হবে তারও ঠিক নেই, বাধ্য হয়েই সাহায্য নিতে হল রাজাদের কাছ থেকে। অনেকেই কিছু কিছু সাহায্য করলেন, সবচেয়ে উদার হস্ত প্রসারিত করে দিলেন খেতরি রাজা অজিত সিং। এই অজিত সিং তো নরেনের প্রায় শিষ্য ও সখা বনে গেছে। বহুকাল ধরে সে অপুত্রক ছিল, নরেনের আশীর্বাদে তার একটি উত্তরাধিকারী এসে গেছে, এ জন্য তাঁর কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। অজিত সিং-ই নরেনের পোশাকের পরিকল্পনা করে দিলেন। দরিদ্র সন্ন্যাসীর বেশে গেলে পশ্চিমে কেউ গ্রাহ্য করবে না, আগে ওদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা চাই। এবং সন্ন্যাসী নরেনের নাম কী হবে? বরানগরের মঠে বিরজা হোমের পর রামকৃষ্ণ পরমহংসের শিষ্যরা আনুষ্ঠানিকভাবে সন্ন্যাস নিয়েছিল। নরেনই গুরুভাইদের এক একজনকে এক একটি নতুন নাম দিয়েছিল, রাখালের নাম হল ব্রহ্মানন্দ, বাবুরামের নাম প্রেমানন্দ, কালী প্রসাদ হল অভেদানন্দ, লাটু হল অদ্ভুতানন্দ …। নরেনের ইচ্ছে ছিল সে নাম নেবে রামকৃষ্ণানন্দ, কিন্তু আগেভাগেই শশী ওই নামটা চেয়ে বসল। তখন নরেন নিজের নাম নিল বিবিদিষানন্দ। যেমন বিদঘুটে নাম, মানে বোঝা যায় না, উচ্চারণ করার তেমনই অসুবিধে। ভ্রমণের সময় সেটা বদলে সে সচ্চিদানন্দ করে নিল, কখনও-সখনও চিঠিতে লিখত বিবেকানন্দ। খেতড়ির রাজা অজিত সিং শেষ নামটাই পছন্দ করলেন। স্বামী বিবেকানন্দ। খেতড়ির রাজা আর একটি দারুণ উপকার করেছিলেন। নরেন সন্ন্যাসী হোক বা নাই হোক, সে কখনও মাকে ভুলতে পারবে না, মায়ের কষ্টও সহ্য করতে পারবে না। সমুদ্র পাড়ি দেবার পর সে আবার কবে ফিরতে পারবে না পারবে তার ঠিক নেই, বিদেশে বেঘোরে প্রাণটাও যেতে পারে, তখন মায়ের কী হবে? খেতড়ির রাজা নরেনের এই দুশ্চিন্তা টের পেয়ে তাঁর মায়ের জন্য মাসোহারা আর তাঁর ছোট ভাইদের শিক্ষার ব্যবস্থার জন্য নির্দিষ্ট সাহায্য পাঠাবার প্রতিশ্রুতি দিলেন। মাদ্রাজি ভক্তরা জাহাজের দ্বিতীয় শ্রেণীর টিকিট কেটে দিয়েছিল, খেতড়ির রাজা সেটাকে প্রথম শ্রেণীতে উন্নীত করে দিয়েছেন। দীন হীনের মতন নেটিভের পোশাকে এই শ্রেণীতে যাওয়া যায় না, নরেন গেরুয়া ছেড়ে ট্রাউজার ও লম্বা কোট পরেছে, পায়ে মোজা ও বুট জুতো। যে মুষ্টিমেয় কয়েকজন তাঁকে বিদায় জানাতে এসেছিল, তাঁরা সবিস্ময়ে দেখল, খালি পায়ে যে সারা ভারত ঘুরেছে, সেই সন্ন্যাসী এই পোশাকেও বেশ অভ্যস্ত। বিদায়ের ক্ষণে নরেন বিশেষ কোনও কথা বলতে পারল না। গম্ভীরভাবে পায়চারি করতে লাগল শুধু। গুরুভাইরা কিছু জানে না, সারা ভারতেও বিশেষ কেউ জানে না, কোনও সংবাদপত্রেই তাঁর নাম উল্লেখ নেই, তবু তাঁর কাঁধে এক বিশাল দায়িত্ব। কয়েকজন শুভার্থী অনেক ভরসা নিয়ে তাঁকে পাঠাচ্ছে, সেই জড়বাদী, ভোগবাদীদের দেশে গিয়ে এ দায়িত্ব সে পালন করতে পারবে তো? সমুদ্রযাত্রা নিয়ে কয়েকজন আপত্তি জানিয়েছিল, নরেন তাঁদের কথা ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়েছে। মাদ্রাজি ব্রাহ্মণদের সে দাপটের সঙ্গে জিজ্ঞেস করেছিল, কোন শাস্ত্রে সমুদ্রযাত্রার নিষেধ আছে, আমাকে দেখান তো? তরুণ ভক্তদের সে বলেছে, কোনও শাস্ত্রে যদি এমন কথা থাকেও তো সে শাস্ত্র বদলাতে হবে। যে সমস্ত সামাজিক লোকাচার এ যুগের উপযুক্ত নয়, সেগুলো ছুঁড়ে ফেলে দেবে। পুরুতদের কথা একদম মানবে না। সমুদ্র নরেনের ভাল লাগে। যে জলরাশির পরপর দেখা যায় না, তার যেন এক অজানা রহস্যের হাতছানি আছে। এতকাল হিন্দুরা সেই হাতছানি উপেক্ষা করে রইল কীভাবে? তাতেই তো অন্য জাতিগুলি এত এগিয়ে গেল!
নরেনের জাহাজ এসে পৌঁছল কানাডার ভ্যাঙ্কুভার বন্দরে। সেখান থেকে ট্রেনে শিকাগোয় আসতে তিন দিন লেগে গেল। টাকা পয়সা হু হু করে খরচ হয়ে যাচ্ছে, নতুন দেশে যে পাচ্ছে সে-ই ঠকাচ্ছে, স্টেশনের কুলিরা পর্যন্ত। জাহাজে ওঠার সময় নরেনের সম্বল ছিল প্রায় হাজার তিনেক টাকা মাত্র, এখন সন্ন্যাসী হয়েও তাঁকে টাকার হিসেব রাখতে হচ্ছে, ব্যয় করতে হচ্ছে টিপে টিপে। শিকাগো পৌঁছবার পর নরেন বুঝতে পারল, কী আহাম্মকির কাজই না সে করেছে! আমেরিকায় একটা ধর্ম সম্মেলন হচ্ছে শুনেই হুট করে সেখানে চলে আসা যায়? এ যেন, উঠল বাই তো কটক যাই! আগে থেকে কিছু যোগাযোেগ করা হয়নি, কোনও আমন্ত্রণপত্র নেই, এমনকী কোনও পরিচয়পত্র পর্যন্ত নেই। কোনও ধর্ম সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করতে গেলে তার প্রমাণ দিতে হবে না? সমগ্র হিন্দু সমাজের মুখপাত্র হিসেবে নরেনকে কে নির্বাচন করল? সে কি গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল! আমেরিকায় সব কিছু নিয়ম মেনে চলে, তাঁকে এখানে পাত্তাই দেবে না কেউ! যে-সব শুভার্থীরা তাঁকে এখানে পাঠাল, তাঁদেরও কারুর মাথায় এসব কথা আসেনি? আরও ভয়ংকর ব্যাপার, নরেন শিকাগোয় এসে জানল, সম্মেলন শুরু হতে এখনও এক মাস দেরি আছে। আর কোনও দেশের প্রতিনিধি এখনও এসে পৌঁছয়নি, তাঁরা আসবে সম্মেলনের তিনদিন আগে। এই এক মাস নরেন থাকবে কোথায়, খাবে কী? ভিক্ষে করতে গেলেই এখানে জেলে পুরে দবে। সম্মেলনে আবেদনপত্র জমা দেবার শেষ তারিখও পার হয়ে গেছে, উদ্যোক্তাদের আতিথ্যও সে কোনওক্রমে পাবে না। শিকাগোর সাউথ ওয়াশ এভিনিউতে দাঁড়িয়ে নরেন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে শীতে কাঁপছে। এ দেশের আবহাওয়া সম্পর্কেও কোনও খোঁজখবর নিয়ে আসেনি সে। বাংলায় ছটি ঋতু, পশ্চিমের লোকেরা তার মধ্যে দুটি ঋতুর নামই জানে না। এ দেশে একটি ঋতুই প্রধান, তার নাম শীত। এই শীতের ধারপাশ ঘেঁষে কখনও গ্রীষ্ম, কখনও বসন্ত, কখনও শরৎ উঁকি মেরে যায়। কিন্তু ওইসব ঋতুতেও যদি হঠাৎ জাঁকিয়ে বৃষ্টি নামে, থামোমিটারের পারাও অনেক বেশি নেমে যায়, হু হু করে ছুটে আসে হিমেল হাওয়া। নরেন কোনও গরম জামাকাপড়ই আনেনি। অচেনা দেশ, একটি মানুষও চেনা নেই। সঙ্গে যা টাকা আছে তাতে দেশে ফেরার জাহাজ ভাড়াও কুলোবে না, অসহায় অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে তিরিশ বৎসর বয়স্ক এক যুবক। রাস্তার লোক ফিরে ফিরে তাকাচ্ছে। তাঁরা কেউই আগে কোনও ভারতীয় দেখেনি, এই কিম্ভুতকিমাকার পোশাক পরা মানুষটি যেন অন্য গ্রহের প্রাণী। আস্তে আস্তে তাঁকে ঘিরে জুটে গেল একদল বালক ও কিশোর। তাঁরা অদ্ভুত স্বরে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কী বলছে তা বোঝা যায় না। চারদিকে ঘুরে ঘুরে হাততালি দিয়ে নাচতে লাগল তাঁরা। তাতেও নরেনের কোনও প্রতিক্রিয়া হচ্ছে না দেখে তাঁরা রাস্তা থেকে ইট কুড়িয়ে কুড়িয়ে ছুঁড়ে মারতে লাগল। এই হয়েছে আর এক জ্বালা! রাজা অজিত সিং খুব ভালবেসে নরেনের জন্য এই গাঢ় কমলা রঙের রেশমি পোশাক তৈরি করে দিয়েছেন, যাতে সকলের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়। জাহাজ থেকে নামার পর নরেন ট্রাউজার্স-কোট বদল করে এই ভারতীয় পোশাক পারে নিয়েছিল। দৃষ্টি আকৃষ্ট হচ্ছে ঠিকই। ফলটা হচ্ছে বিপরীত। বয়স্ক লোকেরা শুধু বক্র দৃষ্টিতে তাকায়, বাচ্চারা সহ্য করতেই পারে না, ঢিল মারে। মালপত্র তুলে নিয়ে দ্রুত হাঁটতে লাগল নরেন, বাচ্চারা পেছন পেছন তাড়া করে এল! যেন পাগল তাড়াচ্ছে। শেষ পর্যন্ত ছুটতে হল নরেনকে। ছুটতে ছুটতে সে একটা হোটেলের দরজায় পৌঁছে গেল। এ দেশে পয়সা থাকলেই হোটেলে আশ্রয় পাওয়া যায় না। সভ্যতার অগ্রগতির মধ্যেও অদ্ভুত একটা পরিহাস আছে। যে-সমাজ এক দিকে খুব উদার, সেই সমাজই অন্য দিকে গোড়া। এক দিকে যুক্তিবাদী, অন্য দিকে অন্ধ। যাঁরা মানবতার নামে জয়ধ্বনি দেয়, তাঁরাই আবার ধর্মের তফাত কিংবা গায়ের সাদা কালো রঙের তফাত ভুলতে পারে না। নিজের দেশে নরেন একজন গৌরবর্ণ পুরুষ, পশ্চিমিদের চোখে সে কালো। আমরা ক্যাটক্যাটে সাদা ও কুচকুচে কালোর মাঝখানে অনেকগুলি রং দেখতে পাই, সাহেবরা পারে না। তাঁদের চোখের দোষ আছে। কালো লোকদের জন্য হোটেলে জায়গা নেই। কেউ ভদ্র ভাষায় প্রত্যাখ্যান করে, কেউ মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দেয়। কেউ বা নরেনের পোশাক দেখে বিকট মুখভঙ্গি করে, যেন চোখের সামনে রয়েছে এক অদ্ভুত জানোয়ার। নরেন দারুণ বিষণ্ণ, ক্লান্ত ও শীতার্ত, মাথা গোঁজার জন্য একটা ঘর পেতেই হবে, না হলে সে হয়তো মরেই যাবে। একটা রেল স্টেশনের স্নানঘরে ঢুকে নরেন পোশাক বদলে আবার প্যান্ট-কোট পরে নিল। তারপর সস্তার হোটেলের বদলে গেল একটা বড় হোটেলে। এখানে বিভিন্ন দেশের মানুষ আসে, ঘর ছাড়া খুব বেশি। যত টাকাই লাগুক, তাকে তো বাঁচতে হবে আগে। দু-তিনদিন সেই হোটেলে থেকে নরেন কিছুটা ধাতস্থ হয়ে নিল। বোঝার চেষ্টা করল দেশটাকে। চুরুটের দাম আট আনা, সব জিনিসেরই দাম এখানে অত্যন্ত বেশি। এখানকার ধনীরা বিপুল ধনান, মধ্যবিত্তদের সংখ্যাই সর্বাধিক, গরিবও আছে বটে, কিন্তু তাঁরা কেউ অনাহারে থাকে না, কিছু না-কিছু কাজ সবাই পায়। নরেনের যা সম্বল তাতে সে এখানে দিন পনেরোর বেশি টিকতে পারবে না। সে সন্ন্যাসী, তাঁর চাকরি খোঁজার প্রশ্নই ওঠে না, তা হলে সে কীসের ভরসায় এ দেশে এসেছে?
অনেকেই এই অবস্থায় ভেঙে পড়ে। প্রথম প্রথম ঘোর বিদেশে এসে অনেকেরই দেশের জন্য খুব মন কেমন করে, ইচ্ছে করে তখনই ফিরে যেতে। সহায়-সম্বল না থাকলে অন্য যে-কেউ যে-কোনও উপায়ে ফেরার জন্য জাহাজঘাটায় ধরনা দিত। কিন্তু নরেন যে সে ধাতুতে গড়া নয়। তাঁর প্রধান সম্বল আত্মবিশ্বাস, জেদ, গোঁয়ার্তুমি। এত দূর এসে সে পরাজিত হয়ে ফিরে যাবে? ধর্ম সম্মেলনে জায়গা পাওয়া যাবে না তাতে কী হয়েছে, অন্যভাবেও তো আমেরিকানদের কাছে তাঁর বক্তব্য পৌঁছে দেবার চেষ্টা করা যায়। কোনওক্রমে দাঁতে দাঁত চেপে কয়েক মাস এখানে টিকে থাকতে পারলে একটা কিছু উপায় বার করা যাবেই। আলাসিঙ্গাকে চিঠি লিখলে সে আরও কিছু টাকা চাঁদা তুলে পাঠাতে পারবে না? অজিত সিংকেও অগত্যা লিখতেই হবে। নরেন একা একা ঘুরে বেড়ায়। বিশ্ব শিল্পমেলার প্রদর্শনী এক এলাহি ব্যাপার, দশ দিনেও দেখে শেষ করা যাবে না। আমেরিকায় সব কিছুই বিরাট বিরাট, রাস্তাগুলি অত্যন্ত চওড়া, মস্ত মস্ত সব বাড়ি, শিল্পমেলাও তো বিশাল হবেই। কিন্তু এসব দেখেও নরেন খুব একটা হতচকিত হয় না, আমেরিকায় এসে সে সবচেয়ে বিস্মিত হয়েছে নারীদের দেখে। বস্তুতঃ এ দেশে এসেই যেন প্রথম নারীদের দেখল নরেন। দেশে থাকতে সে জননী, ভগিনী বা মাসি-পিসিদের দেখেছে, কিন্তু নারী কোথায়? ভারতের নারীরা তো সব অন্তঃপুরে থাকে। সে হতভাগ্য দেশের প্রায় অর্ধেক জনসংখ্যাই তো গৃহবন্দিনী। আর এ দেশে পথে-ঘাটে সর্বত্র নারী। স্বাস্থ্যবতী, সপ্রতিভ মহিলারা দোকানপাট করছে, ব্যবসা চালাচ্ছে, কোনও কাজেই তাঁরা পিছিয়ে নেই। আগে কত শোনা গিয়েছিল এই ধনবানদের দেশে সব সময় বিলাসের স্রোত বয়ে যায়, নারীরা এ দেশে শুধু ভোগের সামগ্রী। কিন্তু ভোগ-বিলাসের স্রোতে সব সময় ভেসে থাকলে এ দেশটার এত উন্নতি হল কী করে? কিছু কিছু লাস্যময়ী রমণী যে নেই তা নয়, কিন্তু অধিকাংশ নারীই স্বাবলম্বিনী, নম্র, ভদ্র, যে-কোনও দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত। এই বিশাল নারী বাহিনীই যেন দেশটাকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে। এ দৃশ্য অভূতপূর্ব, এ অভিজ্ঞতা অপার বিস্ময়কর। সেইরকম একজন নারীই নরেনের ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে দিল।
কয়েক দিন পর হোটেল ছেড়ে দিয়ে নরেন চেপে বসল বস্টনগামী ট্রেনে। সে শুনেছে শিকাগোর তুলনায় বস্টনে থাকার খরচ কম। লালুভাই নামে এক ভারতীয় তাঁর সহযাত্রী, তাঁর সঙ্গে গল্পগুজব করছে, এক কোণ থেকে একজন মাঝবয়েসী মহিলা উঠে এসে সামনে দাঁড়ালেন। ভুক্ত তুলে জিজ্ঞেস করলেন, মাপ করবেন, ভদ্রমহোদয়রা, আপনারা কোন দেশের লোক? নরেন বলল, আমরা ভারতীয়। মহিলাটি আরও অবাক হয়ে বললেন, ভারতীয়রা ইংরিজিতে কথা বলে? তাঁরা এত ভাল ইংরেজি জানে? প্রবাসে বিভিন্ন প্রদেশের ভারতীয় পরস্পরের সঙ্গে ইংরিজিতে কথা বলতেই বাধ্য হয়, তা ছাড়া উপায় নেই। নরেন হেসে বলল, আমরা সংস্কৃত ভাষাতেও কথা বলতে পারি, কিন্তু তা তো আপনি বুঝবেন না। সংস্কৃত ভাষার নাম শুনেছেন। সংস্কৃত ভাষা কিন্তু ইংরিজি ভাষার মাসি কিংবা দিদিমার মতন এক আত্মীয়া। মহিলার নাম ক্যাথরিন এবট স্যানবন, তিনি বেশ ধনবতী আবার ভালমতন লেখাপড়াও জানেন। কথায় কথায় তাঁর সঙ্গে ভাব জমে গেল। বস্টনে নামবার সময় তিনি নরেনকে বললেন, আপনি এখানে হোটেল খুঁজবেন কেন, আমার সঙ্গে চলুন না, আমার একটা ফার্ম হাউস আছে, সেখানে স্বচ্ছন্দে থাকতে পারবেন। আমার বন্ধু-বান্ধবরা কেউ কখনও ভারতীয় দেখেনি, আপনার সঙ্গে আলাপ করলে খুশি হবে। নরেনের আপত্তি করার কোনও প্রশ্ন নেই, তাঁর তো হোটেল খরচ বেঁচে গেল। টাকা বাঁচানোই তার প্রধান চিন্তা। ক্যাথরিনের গোলাবাড়িটি যেমন খুব বড় তাঁর পরিচিতদের সংখ্যাও অনেক। তাঁরা দলে দলে ছুটে আসে এক ভারতীয়কে দেখতে। ক্যাথরিনের অনুরোধে নরেনকে মাথায় পাগড়ি ও আলখাল্লা পরে বসতে হয়, স্থানীয় আমেরিকানদের চোখে সে যেন এক চিড়িয়াখানার প্রাণী। বিনা পয়সায় খাওয়া থাকা, নরেন মেনে নেয়। কিন্তু এই প্রাণীটি আবার কথা বলে, তাও ইংরিজিতে, এবং সে মিনমিন করে ভিক্ষেও চায় না। অনেক মজার কথা বলে, এক এক সময় আমেরিকানদের সম্পর্কে কড়া কথা বলতেও ছাড়ে না। ক্যাথরিনের বন্ধুরা অবশ্য সবাই নিচ্ছুক অজ্ঞ কৌতূহলী নয়, তাঁদের মধ্যে কিছু শিক্ষিত ব্যক্তিও আছে। তাঁরা দেখল এই অদ্ভুত লোকটা বাইবেল পড়েছে, অনেক বই পড়েছে, তাঁদের কারুর কারুর চেয়ে অনেক বেশি জ্ঞানী। ক্রমে নরেনের ভূমিকা বদল হয়, কৌতূহলের বদলে সে অনেকের শ্রদ্ধা আকর্ষণ করে। তখন বিভিন্ন জায়গায় তার বক্তৃতার ব্যবস্থা হয়। মহিলারাই বেশি উৎসাহী, বিভিন্ন মহিলা ক্লাব থেকে তাঁর ডাক পড়ে। কিছু কিছু খ্যাতি ছড়াতে থাকে এই “ব্রাহ্মণ সন্ন্যাসী”র। এই সূত্রেই পবিচয় হয় হেনরি রাইটের সঙ্গে। তিনি হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রিক ভাষার অধ্যাপক, প্রাচ্য দর্শন বিষয়ে আগ্রহী, তিনিও নরেনকে নিয়ে গিয়ে নিজের বাড়িতে রাখলেন কয়েক দিন এবং নরেনের বিদ্যাবত্তার পরিচয় পেয়ে দারুণ শ্রদ্ধান্বিত হয়ে পড়লেন। আচার-ব্যবহারেও এই সন্ন্যাসী সম্পূর্ণরূপে সংস্কারমুক্ত, সকলের সঙ্গে এক টেবিলে বসে খানাপিনা করেন। ধর্ম মহাসভায় যোগদান বিষয়ে নরেন সম্পূর্ণ আশা ত্যাগ করেছিল, অধ্যাপক হেনরি রাইটই তাঁকে আবার উদ্দীপিত করলেন। উৎসব কমিটির সেক্রেটারির সঙ্গে হেনরি রাইটের পরিচয় ছিল, তিনি সেই সেক্রেটারিকে একটা চিঠিতে লিখলেন, এই সন্ন্যাসীকে অবশ্যই বক্তৃতার সুযোগ দেওয়া উচিত, ইনি এমনই একজন বিজ্ঞ ব্যক্তি, আমাদের এখানকার সবকটি অধ্যাপককে একত্র করলেও এর সমকক্ষ হবে না। প্রায় অলৌকিক যোগাযোগ বলতে গেলে। অধ্যাপক হেনরি রাইট নরেনের পরিচয়পত্র লিখে দিলেন, শিকাগোয় যাতে থাকার ব্যবস্থা হয় সে চিঠি দিলেন সঙ্গে, এমনকী শিকাগো যাবার ট্রেনের টিকিট কিনে দিলেন পর্যন্ত।
এত সুযোগ পেয়েও নরেন একটা গণ্ডগোল করে ফেলল। শিকাগোতে ট্রেন থেকে নেমে পকেটে হাত দিয়ে দেখল পকেটে তিনখানা চিঠির মধ্যে রয়েছে মাত্র একখানা। শুধু তাঁর পরিচয়পত্রটি রয়েছে, কিন্তু বারোজ নামে যে ব্যক্তিটি তাঁর থাকার ব্যাবস্থা করে দেবে, তাঁর নামে চিঠিটিও উধাও, তার ঠিকানাও নরেন জানে না। মহাসভার অফিসের ঠিকানাও গেছে হরিয়ে। এখন এই গোলোকধাঁধার মতন শহরে সে কোথায় যাবে? বৃষ্টি পড়ছে খুব, নরেন স্টেশনের বাইরে এসে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। সম্মেলন সমাস বলে এ শহরে বহু অতিথি এসে গেছে, বড় বড় সব হোটেল ভর্তি। একটু বাদে বৃষ্টির মধ্যে খুঁজতে বেরিয়ে নরেন কোনও হোটেলেই জায়গা পেল না কিংবা প্রত্যাখ্যাত হল। উপায়ান্তর না দেখে সে ফিরে এল রেল স্টেশনে, শীত থেকে বাঁচবার জন্য সে ঢুকে পড়ল একটা খালি কাঠের বাক্সের মধ্যে। সেই বাক্সের মধ্যে কুঁকড়ে-মুকড়ে শুয়ে রইল নরেন। এ দেশের দরিদ্রতম ব্যক্তিও এমনভাবে রাত কাটায় না। নরেনের বুকটা খুব দমে গেছে। তীরে এসে তরী ডুববে? এতটা সুযোগ পেয়েও সে সব হারাল? এখন আর হাভার্ডে ফিরে গিয়ে অধ্যাপক রাইটের কাছ থেকে নতুন করে পরিচয়পত্র লিখিয়ে আনার সময় নেই, সম্মেলন শুরু হয়ে যাবে এক দিন পরেই। কিন্তু হাল ছাড়লে তো চলবে না। পর দিন সকালেই সে বেরিয়ে পড়ল, যেমনভাবেই হোক ধর্মসভার কার্যালয়ে পৌঁছাতেই হবে তাঁকে। সে এক একটা বাড়ির দরজায় ঘা দিয়ে জিজ্ঞেস করতে লাগল, ধর্ম মহাসভার অফিসটা কোথায় আমাকে একটু বলে দেবেন? বিরাট লেক মিসিগানের তীরবর্তী এই বাড়িগুলিতে ধনীদের বাস। অনেকে ধর্ম মহাসভা সম্পর্কে কিছু জানে না। অনেকে ধারণা হল এই লোকটি পাগল। একটা কালা আদমি, ময়লা পোশাক, দাড়ি না কামানো মুখ, সে বিড়বিড় করে কী বলছে। অবাঞ্ছিত বেড়াল কুকুরের মতন ভৃত্যরা দূর দূর করে তাঁকে তাড়িয়ে দিতে লাগল। অনেকক্ষণ এ রকম চেষ্টা করার পর বিফল মনোরথ হয়ে নরেন বসে পড়ল রাস্তায়। এর পরেই স্বর্গ থেকে দেবদূতীর আগমন। বিপদ ভঞ্জনে এগিয়ে এল আর এক নারী। এক প্রাসাদের তিনতলার জানলায় দাঁড়িয়ে এক অপরূপা রমণী অনেকক্ষণ ধরে নরেনকে লক্ষ করছিলেন। এক সময় তিনি নীচে নেমে দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন রাজপথে। নরেনের সামনে এসে তিনি সবচেয়ে অপ্রত্যাশিত প্রশ্নটি করলেন, মহাশয় আপনি কি ধৰ্ম মহাসভার একজন প্রতিনিধি? এই মহিলার নাম শ্রীমতী হেল। এর নজরে পড়ায় আর কোনও সমস্যাই রইল না। ইনি নরেনকে স্নান করিয়ে, খাইয়ে-দাইয়ে নিয়ে এলেন ধর্ম মহাসভার অফিসে। অধ্যাপক রাইটের ডাকে পাঠানো চিঠির ফলে সব ব্যবস্থাই হয়ে ছিল, সে প্রতিনিধি হিসেবে স্বীকৃতি পেল, তাঁর থাকার ব্যবস্থাও নির্দিষ্ট হল।
এখন নরেন সেই মহা সম্মেলনের মঞ্চে উপবিষ্ট। দ্বিতীয় অধিবেশন শুরু হয়ে গেছে অপরাহ্নে। একে একে প্রতিনিধিরা বক্তৃতা শেষ করছেন। আর তো উপায় নেই, এবার নরেনকে দাঁড়াতেই হবে এই বিশাল জনসমষ্টির সম্মুখে। চারজন বক্তার ভাষণ শেষ হবার পর নাম ঘোষিত হল হিন্দু ধর্মের প্রতিনিধির। নরেনের বুকের কাঁপুনি এখন দ্বিগুণ। গুরুর নাম কিংবা মা কালীর কথা তাঁর মনে পড়ল না। সে একবার মঞ্চের পেছন দিকে তাকাল। সেখানে দু’জন গ্রিক দার্শনিকের পাথরের মূর্তি সাজানো রয়েছে, আর একটু দূরে একটি নারীমূর্তি, আকারে বেশ বড়, একটি হাত আশীবাদের ভঙ্গিতে তোলা, হয়তো কোনও গ্রিক বা রোমান দেবীর প্রতিমূর্তি। কিন্তু অনেকটা হিন্দুদের দেবী সরস্বতীর সঙ্গে মিল আছে। সে দিকে চেয়ে নরেন মনে মনে বলল, হে মা সরস্বতী, দয়া করো, আমার জিহ্বাগ্রে তোমার একটুখানি স্পর্শ দাও মা! ধীর পায়ে সে গিয়ে দাঁড়াল রোষ্ট্রামে। শ্রোতাদের মধ্যে মহিলাদের সংখ্যাই বেশি। কত বিভিন্ন বর্ণের পোশাক। হলে তিল ধারণের স্থান নেই, পেছন দিকে দাঁড়িয়ে আছে অনেকে। অন্য সবাই প্রথম সম্বোধন করেছে, ‘‘ভদ্রমহিলা ও ভদ্র মহোদয়গণ। এটাই বিলিতি সভ্যতার রীতি, নরেন বলল, হে আমেরিকাবাসী ভগিনী ও ভ্রাতৃবৃন্দ …।’’ সঙ্গে সঙ্গে হাততালি, প্রবল হাততালি, সমস্ত প্রেক্ষাগৃহ জুড়ে হাততালি এবং সে হাততালি যেন থামতেই চায় না। এ তো ঠিক ভদ্রতার হাততালি নয়। নরেন নিজেই বেশ বিস্মিত হল। ভারতে অনাত্মীয় মহিলাদের মা কিংবা বোন বলে সম্বোধন করার রীতি আছে, এ দেশে নিজের মা-বোন ছাড়া অন্যদের এইভাবে ডাকাটা ন্যাকামির পর্যায়ে পড়ে। ভারতে পুরুষে পুরুষে ভাই সম্বোধন খুবই স্বাভাবিক, আর এদেশে পারিবারিক বন্ধন শিথিল, নিজের ভাই-বোনেরই অনেকে খবর রাখে না, পরিবারের বাইরে ভাই শব্দটার প্রায় ব্যবহারই নেই বলতে গেলে, ইয়ার্কির ছলে গুড়া। ভারতীয় সম্বোধন এদের এত পছন্দ হয়ে গেল? এত হাততালিতে অনেকখানি ভরসা পেল নরেন। এর পর সে জোরাল গলায় বলতে লাগল, ‘‘পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন সন্ন্যাসী সমাজের পক্ষ থেকে আমি আপনাদের ধন্যবাদ জানাতে এসেছি … আমরা শুধু সকল ধর্মকেই সহ্য করি না, সকল ধর্মকেই সত্য বলে মনে করি … বিভিন্ন নদীর বিভিন্ন উৎস, কিন্তু সব নদীই সাগরে মেশে, তেমনি যত ধর্মমত, যত রকম বিশ্বাস, সকলের মূলে একই ভগবান, … আজ এই সম্মেলনের শুরুতে যে ঘন্টাধ্বনি হয়েছিল, তাতেই যেন একই সংঘের দিকে অগ্রগামী বিভিন্ন মতবাদের রেষারেষির অবসান ঘোষিত হল।’’ সময় নির্দিষ্ট, নরেন বক্তৃতা দীর্ঘ করল না। শেষ হতে না হতেই সে কি তুমুল ধ্বনী! যেন মহা সমুদ্রের কলরোল। মঞ্চে উপবিষ্ট অন্যান্য বক্তাদের মুখ ধূসর হয়ে গেল, এত অভিনন্দন তো আর কারুর ভাগ্যে জোটেনি। নরেনের বক্তৃতার ভাষা বা বিষয়বস্তু খুব যে অভিনব বা চমকপ্রদ, তা কিন্তু নয়। ব্যবহারিকভাবে মানলেও প্রত্যেক ধর্মের প্রবক্তারাই এক এক সময় উদার ভাব দেখিয়ে অন্য ধর্মের প্রতি সহিষ্ণুতার কথা ঘোষণা করেন। সকাল থেকে প্রত্যেক বস্তার কণ্ঠেই বিশ্ব প্রাতৃত্বের কথা ধ্বনিত হয়েছে। তা হলে নরেন এমন নতুন কী বলল? নরেনের চেহারা বা পেশাকের ঔজ্জ্বল্য দেখেই সবাই মুগ্ধ হয়েছে, আমেরিকান শ্রোতাদের এতটা ছেলেমানুষ মনে করাও ভুল। অন্য বক্তারা পাঠ করেছেন লিখিত বক্তৃতা, তা কিছুটা ক্লান্তিকর হয়, ভাষার কারিকুরিতে সব বোঝা যায় না, বক্তার মুখ দেখা যায় না। নরেন যে আগে থেকে লিখেটিখে তৈরি হয়ে আসেনি, সেটাই যেন তাঁর পক্ষে শাপে বর হয়েছে। সে সোজাসুজি শ্রোতাদের দিকে তাকিয়ে তাঁর বিশ্বাসের কথা উচ্চারণ করেছে সরল, আন্তরিক ভাষায়। তাঁর বক্তব্যের আড়ালেও এমন কিছু ছিল, যা স্পর্শ করেছে সকলের মন। যেন এই তেজস্বী যুবকটি নিছক তত্ত্বকথা শোনাতে আসেনি, মানুষে মানুষে মিলন ঘটানোর দায়িত্ব সে নিজেই নিয়েছে, তার বিশ্বাসের জোরেই ভালবাসার প্রতিষ্ঠা ঘটাবে। যেন সে এক নতুন অবতার। নরেন জয়ী হয়েছে। এতগুলি মানুষের হৃদয় হরণ করেছে সে। এই মুহূর্ত থেকে নরেন মুছে গেল, সে এখন স্বামী বিবেকানন্দ, এই নামেই বিশ্বের বহু লোক তাঁকে চিনবে। শুধু হর্ষধ্বনিতেই শেষ হল না, শত শত শ্রোতা চেয়ার-বেঞ্চি টপকিয়ে ছুটে এল তাঁর দিকে। মহিলারাই অগ্রবর্তী হয়ে স্বামী বিবেকানন্দকে ঘিরে ধরল, তাঁকে একটু স্পর্শ করার জন্য। উৎসবের একজন কর্তাব্যক্তি সেদিকে তাকিয়ে অস্ফুট স্বরে বললেন, ও বলেছে খুবই ভাল। কিন্তু এর পরেও যদি ছোকবা মাথার ঠিক রাখতে পারে, তা হলে বুঝব ওর এলেম!
শিকাগো ধর্মসভায় অপ্রত্যাশিতভাবে বক্তৃতার সুযোগ পাওয়া ও সভায় অবিশ্বাস্য সাফল্যের পরে স্বার্থপররা প্রচার শুরু করে যে নিজের দেশেই লোকটি ভ্যাগাবন্ড, কোথাও কোনো খুঁটি নেই। এই অবস্থায় স্বদেশের কিছু সমর্থন তাঁর পক্ষে প্রয়োজনীয়। স্বদেশ থেকে তিনি কোনো নিদর্শন পত্র নিয়ে আসেন নি, যাঁরা তাঁর বিরুদ্ধাচারণ করছে “তাঁদের সামনে আমি যে জুয়াচোর নই তা কি করে প্রমাণ করবো?” বিবেকানন্দের আশা ছিল মাদ্রাজ ও কলকাতায় কতকগুলি ভদ্রলোক জড়ো করে তাঁকে অভিনন্দন জানিয়ে সভা হবে এবং প্রস্তাবগুলি আমেরিকায় পৌঁছবে। “কিন্তু এখন দেখছি ভারতের পক্ষে এ কাজটি বড় গুরুতর ও কঠিন। এক বৎসরের ভিতর ভারত থেকে কেউ আমার জন্য একটা টু শব্দ পর্যন্ত করলো না–আর এখানে সকলে আমার বিপক্ষে।” গুরুভাই শশীমহারাজ (স্বামী রামকৃষ্ণানন্দ) ও কালীবেদান্তী (স্বামী অভেদানন্দ) উঠে পড়ে লাগলেন কলকাতায় কিছু একটা করবার জন্য। সভাপতি নির্বাচনের জন্য তাঁরা মাননীয় বিচারপতি গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে গেলেন। এরপর সেই সাক্ষাতের বর্ণনা এইরকম – “প্রথম হইতেই স্যার গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায় এ সম্বন্ধে বিশেষ উৎসাহহীনতা প্রকাশ করিতে লাগিলেন। তাঁহার সহিত এ সম্বন্ধে বহু আলোচনা হয়। পরে তিনি বলেন যে, কোন বিশিষ্ট মহামহোপাধ্যায় পণ্ডিত তাহাকে বলিয়াছেন যে স্বামী বিবেকানন্দ নাম গুরুদত্ত নহে, শাস্ত্রমতে শূদ্রের সন্ন্যাস গ্রহণে অধিকার আছে কিনা এ সম্বন্ধে বহু মতভেদ আছে এবং সন্ন্যাসী হইয়াও ম্লেচ্ছদেশে গমনেও বিশেষ প্রত্যবায় আছে ইহাও অনেকে বলিয়া থাকেন।” যেসব কাজে সামাজিক ও ধর্ম সম্বন্ধে মতভেদ আছে সেসব কাজের ভিতর আর স্যার গুরুদাস যেতে চান না। “নগেন্দ্রনাথ মিত্র বলিয়া উঠিলেন, আপনি যে ম্লেচ্ছদেশে যাওয়ার দোষ দিলেন কিন্তু আপনি তো শুদ্ধ আচারী ব্রাহ্মণ হইয়াও চিরকাল ম্লেচ্ছের চাকরি করিলেন, এতে যে শাস্ত্রে তুষানলের ব্যবস্থা রহিয়াছে, এই বলিয়া সকলেই ক্ষুণ্ণ হইয়া চলিয়া আসেন।” এই দ্বন্দ্বের অবসান যে বিশ্ববিজয়ী বিবেকানন্দর মহাপ্রয়াণের পরেও শেষ হয়নি তার ইঙ্গিতও রয়েছে স্বামীজির কনিষ্ঠভ্রাতার রচনায় – “স্বামীজির স্মৃতিসভায় সভাপতিত্ব করার জন্য অনুরোধ জানানো হয় দুইজন হাইকোর্টের বিচারপতিকে, একজন ব্রাহ্মণ এবং অপরজন কায়স্থ। এঁরা স্বামীজির প্রতি কটুক্তি বর্ষণ করেছিলেন। ব্রাহ্মণ বিচারপতিটি বলেছিলেন, দেশে হিন্দু রাজার শাসন থাকলে তাঁকে ফাঁসি দেওয়া হত। আর বিচারপতিটিও স্বামীজির তীব্র নিন্দাবাদ করেছিলেন।” দ্বিতীয় ব্যক্তিটি একসময়ে প্রস্তাব করেছিলেন যে ব্রিটিশ রাজপরিবারের কোন সদস্য যেন ভারতে এসে শ্বেতাঙ্গ রাজন্যবর্গের সহায়তায় নৃপতি হিসেবে দেশ শাসন করেন। এবিষয়ে কনিষ্ঠ ভূপেন্দ্রনাথ দত্তর সংযোজন – “বিচারপতি সারদাচরণ মিত্র একবার সংবাদপত্রে এই প্রস্তাব দিয়েছিলেন। স্বামীজির মৃত্যুর পরে তাঁর স্মৃতিসভায় পৌরোহিত্য করবার জন্যে অনুরোধ করা হলে তিনি স্বামীজিকে নিন্দাবাদ ও সমালোচনা করেছিলেন।” স্বামী অভেদানন্দ তাঁর জীবনকথায় গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায় সম্বন্ধে লিখেছেন, “প্রতিদিন গঙ্গাস্নান করিয়া পূজা-জপাদি করিতেন। তাহা ছাড়া শুনিয়াছি প্রাচীনপন্থী ব্রাহ্মণ্যধর্মকে তিনি অত্যন্ত সম্মানের আসন দিতেন। সেইজন্য তথাকথিত শূদ্ৰ কুলোৎপন্ন দত্তবংশীয় নরেন্দ্রনাথের উদ্দেশ্যে অনুষ্ঠিত সভায় যোগদান করিতে তিনি অসম্মতি প্রকাশ করিলেন।” আমেরিকা থেকে নরেন্দ্রনাথ লিখে পাঠিয়েছিলেন, “তোমরা কলিকাতায় একটি সাধারণসভার আয়োজন করিয়া আমার কার্যাবলীর সমর্থন ও সঙ্গে সঙ্গে আমি যে হিন্দুধর্মের প্রতিনিধি এই উল্লেখ করিয়া … একটি পত্র প্রেরণ কর।” স্বামী অভেদানন্দ তখন আহার নিদ্রা ভুলে বিশিষ্ট নাগরিকের বাড়িতে গিয়ে সভায় যোগদানের জন্য অনুরোধ জানাতে লাগলেন। একজন বিশিষ্ট মাড়ওয়ারি নাগরিকের কাছে গেলে তিনি বললেন, “বাবুজি, হিন্দু হইয়া যাহারা বিলেত গমন করে তাহারা তো ভ্রষ্টাচারী। তাহাদের সঙ্গে আমাদের সম্বন্ধ রাখা উচিত হইবে কি?” মনোমোহনবাবু মাড়ওয়ারী ব্যবসায়ীদের সহিত বিশেষভাবে মেলামেশা করতেন, সুতরাং তাদের প্রকৃতি ভালভাবেই জানতেন। “তিনি তৎক্ষণাৎ বলে উঠলেন – “শেঠজি, আপকা নাম তো কমিটিমে চড় গিয়া। এই কথা শুনিবামাত্র মাড়ওয়ারী-ভদ্রলোকের মুখে আর কোনো কথা নাই।” শেষ পর্যন্ত উত্তরপাড়ার রাজা পিয়ারীমোহন মুখোপাধ্যায় সভাপতিত্ব করতে রাজি হন, কিন্তু তিনিও “স্বামী বিবেকানন্দ কথাটিকে আপত্তি করিয়া ‘ব্রাদার বিবেকানন্দ’ বলিয়া সম্বোধন করিয়াছিলেন, কারণ কায়স্থ সন্ন্যাসী হইতে পারে কিনা এবিষয়ে তখনও তাঁহার সন্দেহ ছিল।” শিকাগোর ঐতিহাসিক ধর্মসভায় আরও একজন বিশিষ্ট বাঙালি যে উপস্থিত ছিলেন তা আজ প্রায় কারও মনে নেই। ইনি বিশিষ্ট ব্রাহ্ম ভাই প্রতাপচন্দ্র মজুমদার, উত্তর কলকাতায় বসবাসকালে নরেন্দ্রনাথের সঙ্গে তিনি বিশেষ পরিচিত ছিলেন, একসময় শ্রীরামকৃষ্ণ সম্বন্ধে একখানি বইও লিখেছিলেন, যে বইটি স্বামীজি আমেরিকায় চেয়ে পাঠিয়েছিলেন। এই প্রতাপ মজুমদারই যে কেন প্রবলভাবে চটে উঠে স্বামীজির নিন্দায় মেতে উঠলেন তা নিয়ে বিস্তারিতভাবে অনুসন্ধান হয়েছে। এক্ষেত্রে মহেন্দ্রনাথ দত্তের রচনা থেকে কিছু খবর উদ্ধৃত করা যায় – “প্রতাপচন্দ্র মজুমদার মহাশয় ফিরিয়া আসিয়া বলিতে লাগিলেন, নরেন, সেই ছোঁড়াটা, যে ভ্যাগাবন্ডের মত পথে পথে ঘুরে বেড়াত, সে এক লম্বা জামা পরে মাথায় পাগড়ি বেঁধে চিকাগো পার্লামেন্টে তো গিয়ে হাজির। সে আবার লেকচার করতে উঠলে, আবার বেদান্তর উপর কথা কয়, মায়াবাদ–সে সব অযৌক্তিক কথা, আর পৌত্তলিক ধর্ম সমর্থন করে। এসব জিনিস কি এযুগে আর চলে। যত সব বাজে জিনিস। ছোঁড়া এমনি অসভ্য রমণীদের সম্মুখে বসিয়াই চুরুট টানিতে লাগিল। আর কি লেকচার করে তার মাথামুণ্ডু কিছুই নেই, হাউড়ের মতন যত সব আবোল তাবোল বকে।” এই নিন্দায় ভীষণ ক্ষতি হয়েছিল স্বামীজির। কিন্তু সব খারাপ জিনিসেরই একটা ভাল দিক থাকে। বিখ্যাত ইন্ডিয়ান মিরর পত্রিকার সম্পাদক ও প্রতাপচন্দ্র মজুমদার মশায়ের নিকট কুটুম্ব নরেন্দ্রনাথ সেন রেগে উঠে মুখ ছুটিয়ে গালি দিতে লাগলেন নিজের আত্মীয়কে। মহেন্দ্রনাথ সবিস্তারে লিখেছেন সেইসব প্রতিবাদের কথা – “দেখ দেখি একটা বাঙালির ছেলে নিঃসম্বল, বিদেশ ভূমিতে গিয়ে নিজের দেশের জন্য, নিজের জাতের জন্য, নিজের ধর্মের জন্য লড়াই করছে, আর কি করে বিদেশির কাছে এদেশের একটুমাত্র সম্মান হয় তার চেষ্টা কচ্ছে, আর এই এক বুড়ো মিসে কোথা তাঁকে সেখানে তাঁর হয়ে দুটো কথা বলবে না তাঁর নিন্দাবাদ করে কিসে তাঁর অনিষ্ট হয় তার চেষ্টা কচ্ছে।” বিবেকানন্দের বিড়ম্বনার ক্ষেত্র প্রসারিত করার জন্য বিভিন্ন স্তরে কিরকম ষড়যন্ত্র চলেছিল তার প্রমাণ ছড়ানো রয়েছে নানা জায়গায়। অধ্যাপক এন ঘোষের বিখ্যাত ইন্ডিয়ান নেশন পত্রিকায় বিবেকানন্দকে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে একটা বড় প্রবন্ধ বেরুলো। অবাক কাণ্ড। তারপর সম্পাদক স্বীকার করলেন, “মাদ্রাজ হইতে কে একটা প্রবন্ধ লিখিয়া পাঠাইয়া দেয়, অনবধানবশতঃ সেটা বিশেষ না পড়িয়াই সম্পাদকীয় স্তম্ভে প্রকাশ করা হইয়াছিল। এই ভুলের জন্য তিনি লজ্জিত ও দুঃখিত হইয়াছিলেন।” প্রবল নিন্দার পরিবেশেও ধৈর্যশীল স্বামী বিবেকানন্দ সম্পূর্ণ নীরবতা অবলম্বন করতেন। নিন্দা সম্পর্কে স্বামীজির সুচিন্তিত নীতি কি তা তিনি নিজেই আলাসিঙ্গা পেরুমলকে লেখা এক চিঠিতে (২৭শে সেপ্টেম্বর ১৮৯৪) বিশ্লেষণ করেছেন – “আমার বন্ধুগণকে বলবে যারা আমার নিন্দাবাদ করছেন, তাঁদের জন্য আমার একমাত্র উত্তর–একদম চুপ থাকা। আমি তাঁদের ঢিলটি খেয়ে যদি তাঁদের পাটকেল মারতে যাই, তবে তো আমি তাঁদের সঙ্গে একদরের হয়ে পড়লুম। তাঁদের বলবে–সত্য নিজের প্রতিষ্ঠা নিজেই করবে, আমার জন্যে তাঁদের কারও সঙ্গে বিরোধ করতে হবে না। আমার বন্ধুদের এখনও ঢের শিখতে হবে, তাঁরা তো এখনও শিশুতুল্য। … সাধারণের সঙ্গে জড়িত এই বাজে জীবনে এবং খবরের কাগজের হুজুগে আমি একেবারে বিরক্ত হয়ে গিয়েছি। এখন প্রাণের ভেতর আকাঙ্ক্ষা হচ্ছে হিমালয়ের সেই শান্তিময় ক্রোড়ে ফিরে যাই।”
(তথ্যসূত্র:
১- সেই সময়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, আনন্দ পাবলিশার্স (২০১৪)।
২- স্বামী বিবেকানন্দ এক অনন্ত জীবনের জীবনী, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, দে’জ পাবলিশিং।
৩- অচেনা অজানা বিবেকানন্দ, শংকর।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত