অসমে নাগরিক বাছাইয়ের নামে যে কাজটি সরকারের নেতৃত্বে চলছে, সেটি একটি গভীর দেশবিরোধী রাজনীতির অনুষঙ্গ। এটিকে কখনওই অনুপ্রবেশকারীদের হাত থেকে স্থানীয় মানুষদের জীবন–জীবিকা ও সংস্কৃতি রক্ষার স্বার্থে প্রয়োজনীয় রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ বলে মেনে নেওয়া যাচ্ছে না। কারণ বহুবিধ এবং বহুমাত্রিক। যে বিধির ভিত্তিতে এই নাগরিক পঞ্জীকরণের কাজ— তা নিয়েও প্রশ্ন আছে।
একটি রাষ্ট্রের দায় তার নাগরিকদের প্রতি, প্রতিবেশী রাষ্ট্রের মানুষদের প্রতি নয়। এই স্বাভাবিক বোধ থেকে জন্ম নেওয়া যে অনুপ্রবেশের ধারণা, তা কিন্তু ভারত রাষ্ট্রে অচল। ১৯৪৭ সালের ১৪, ১৫ ও ১৬ আগস্ট এ দেশের কিছু কিছু অংশের মানুষকে বলে দেওয়া হল, কাল থেকে আপনারা অন্য দেশের নাগরিক। এ দেশে আর বসবাস করতে পারবেন না। এঁরা চৌদ্দ পুরুষের বাসিন্দা এই দেশের, হঠাৎই কেউ হয়ে গেলেন ভারতীয়, কেউ পাকিস্তানি, বা পূর্ব পাকিস্তানি। যেভাবে লক্ষ লক্ষ মানুষকে পরদেশি বানিয়ে দেওয়া হল, সেই রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বলি হয়ে পূর্ববঙ্গ থেকেও পরে বারবার বিতাড়িত হতে হল। শেষে বাংলাদেশ গঠনের পরেও পশ্চিমবঙ্গ, অসম ও দেশের নানা স্থানে সেই অঞ্চল থেকে আগত মানুষের স্রোত অব্যাহত থাকল। কী বলবেন এঁদের? এঁরা অন্য দেশ থেকে এসেছেন? নাকি এঁদের নিজেদের দেশ থেকেই ছিন্নমূল করে শরণার্থী বানানো হয়েছে? ইউরোপ বা আমেরিকায় যেভাবে রিফিউজি ভাবা হয়, এঁরা তা নন। এঁদের পূর্বপুরুষ ও পরম্পরা ধরেই এঁরা ভারতীয়। এঁদের কাছে কীসের পরিচয় জানতে চাইবে নতুন ভারত রাষ্ট্র? এই মৌলিক ঔচিত্যবোধের রাজনীতিটা দেশভাগের পর এ নিয়ে প্রশ্ন তুলে দেয়। প্রশ্ন তোলেন অসমের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বরদলৈ। ‘পূর্ববঙ্গ থেকে আগতদের পুনর্বাসন দিলে আসামে জমি ও জীবিকার ওপর চাপ বাড়বে’— কেন্দ্রকে তিনি এ কথা জানালে নেহরু–প্যাটেল কড়া মনোভাব নিয়ে উদ্বাস্তুদের পক্ষে বলেন, এটা মেনে নেওয়া ভারতের পক্ষে বাধ্যতামূলক। এরকমই আরও তিন–চার দশক ছিল কেন্দ্রের মনোভাব। ইতিমধ্যে বাঙালি বিতাড়নের জন্য স্থানীয় রাজনীতিতে চক্রান্ত, রাজনৈতিক দাঙ্গা, সরকারি পীড়ন, ছাত্র আন্দোলন শুরু হয়ে যায়। তবু আসামে হিতেশ্বর শইকিয়া সরকার থাকা পর্যন্ত রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের যে রাজনৈতিক বোধ ছিল, তার বোধের বিলোপ ঘটেছে বর্তমানে কেন্দ্র ও অসম সরকারের। এনআরসি–র দাবি জানানো হয়েছে মধ্যপ্রদেশের মতো অন্য রাজ্যেও। লক্ষণীয়, সব কটি রাজ্যেই ক্ষমতায় রয়েছে বিজেপি। আসলে কেন্দ্রে হোক কিংবা রাজ্যে, বিজেপি চায় বিভাজনের রাজনীতি। তাই সর্বত্রই জাতিসত্তার পরিচয়ের ভিত্তিতে আঞ্চলিক রাজ্যগুলিতে স্থানীয় মানুষের সমর্থন পেতে চাইছে তারা ক্ষমতায় আসার জন্য। এর জন্য যে গোটা দেশের ঐক্য ও সংহতি বিপন্ন হচ্ছে, তা নিয়ে কোনও হেলদোল নেই মোদি সরকারের। যেন একটি অনুচ্চারিত রাজনৈতিক এজেন্ডা নিয়েই এই দলটি দেশের সর্বত্র বহুত্ববাদী সংস্কৃতি ও মিলনের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা পারস্পরিক সহমর্মিতার বাতাবরণটিকে ধ্বংস করতে চাইছে। উদ্দেশ্য, স্থানীয় মানুষদের উন্নয়নের কথা বলে এবং পরিচয়–সঙ্কটের আশঙ্কা যুগপৎ জারি করে ভোট বাড়ানো। তাই তারা ক্ষমতায় এসে নির্দিষ্টভাবে কোনও একটি জাতিকে ছিন্নমূল করে বিপন্ন করার এক ভয়ঙ্কর অমানবিক রাজনীতি শুরু করেছে। এদের সবথেকে বড় আগ্রাসনের শিকার এখন বাঙালি। উত্তরাখণ্ড থেকে মণিপুর— সর্বত্রই বি জে পি–র শাসনে বাঙালিদের ওপর নেমে আসছে নাগরিক পঞ্জীকরণের আতঙ্ক। কারণ রাষ্ট্রগতভাবেই বি জে পি সরকার বাংলাভাষীদের ‘নাগরিক নয়’ বলে ঘোষণায় উদগ্রীব। যেন বাংলাভাষী মানেই অনুপ্রবেশকারী এবং বাংলাদেশি। এনআরসি–তে নাম তোলার জন্য যে লিগ্যাসি ডাটা চাওয়া হচ্ছে, সঙ্গত কারণেই তা সকল বৈধ নাগরিকের পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়। কারণ শুধু নিজের দাদুর নাম বললেই হবে না, দাদুর বাবা, তাঁর বাবার বাবা, বাবার বাবার বাবা— এভাবে বললেও হবে না, যে বানানটি কেউ লিখবে, সেটি সরকারি নথির বানানের সঙ্গে মিলতে হবে। এর পর সেই সব দাদু কোন গ্রামে থাকতেন, একই নামের গ্রাম হলে তার সিরিয়াল নম্বর, কোন স্কুলে পড়েছেন— এরকম অজস্র তথ্য দেওয়ার পরও দেখা যাচ্ছে মায়ের নাম আছে, ছেলের নাম নেই! এক ভাইয়ের নাম আছে, বাবারও নাম আছে, পরিবারের অন্য সদস্যদের নাম নেই! এভাবে কপালজোরে আপনার নাম যদি থাকে, তবেই আপনি এ দেশের নাগরিক, না হলে আপনি ‘দেশহীন’। এটাই কি চেয়ছিল সুপ্রিম কোর্ট? নাকি চেয়েছিলেন এ দেশের জনগণ?
১৯৭১ সালকে ভিত্তিবর্ষ ধরার ক্ষেত্রেও গোলযোগ আছে, যা একটি গেজেট নোটিফিকেশন দিয়ে জানানো হয়। প্রকৃতপক্ষে ১৯৪৯ সালে প্রজাতন্ত্র রাষ্ট্র গঠনের দিনটিই সংবিধানসম্মত। সেটি কিন্তু বি জে পি সরকার তুলে ধরছে না। এটা অবশ্য বি জে পি–র কাছে নতুন কিছুই নয়। কারণ রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের রাজনৈতিক কর্মসূচির মধ্যেই বাঙালিদের বিরোধিতা, বিতাড়ন, দমন ও কোণঠাসা করাটা অঘোষিতভাবেই বিদ্যমান। তা নিয়ে গোপনে এই সংগঠনের বিভিন্ন শিবিরে কী পরিমাণ বাঙালি বিদ্বেষ ছড়ানো হয়, সে বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে একটি সর্বভারতীয় পত্রিকায়। তাদের রিপোর্টার কিছুদিন ওই সব ক্যাম্পে গোপনে আরএসএস কর্মী হিসাবে যোগ দিয়ে তাঁর অভিজ্ঞতার কথাই তুলে ধরেছেন সেই প্রতিবেদনে। তাই সুকৌশলেই এনআরসি করার নামে সব বাঙালিই বাঙালি মুসলমান ও বাংলাদেশ থেকে এসেছে— এমন একটি ‘পাবলিক কনসেন্ট’ নির্মাণ করেছে আসামের বি জে পি শাখা। কনসেন্টটা এরকম যে, ১৯৭১–এর পর এরা ভারতে ঢুকেছে। এরা সকলেই আসামের স্থানীয় অর্থনীতি ও সমাজের ভারসাম্য নষ্ট করে দিচ্ছে। এদের জন্যই আসামের নিজস্ব ভূমিপুত্র ও তাদের সংস্কৃতি বিপন্ন।
মনে রাখা দরকার, অটলবিহারী বাজপেয়ীর আমলেও শিবসেনার নেতৃত্বে মুম্বইয়ে বসবাসকারী বাঙালি শ্রমজীবীদের জোর করে বম্বে মেলে তুলে দিয়ে ফেরত পাঠানো হয়েছিল। এখন আসাম সরকার সেটাই করছে। কিন্তু এ কাজটি যে শুধু অযৌক্তিক তা–ই নয়, চরম অন্যায়ও। একটি দেশের যে কোনও স্থান থেকে যদি দেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়ে আসতে পারেন, একটি দেশের এই সব ‘বিপজ্জনক’ ভোটারদের দ্বারা নির্বাচিত সরকার যদি চলতে পারে, সে ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী বৈধ, সরকার বৈধ হলে, ভোটাররাই শুধু কেন অবৈধ হবেন? এ ক্ষেত্রে স্ববিরোধিতাটিও আশ্চর্যের। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চকে সামনে রেখেই নাগরিক পঞ্জীকরণ হবে। ওদিকে নাগরিকত্ব বিলে বলা হচ্ছে, মুসলিম বাদে সব ধর্মের মানুষের নাম তোলা হবে ২০১৪ সাল পর্যন্ত। তার মানে বাছা হবে শুধু মুসলিমদের। কারা ১৯৭১ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত এ দেশে এল— এটা কি কোনও দেশের গ্রহণযোগ্য আইন? নাকি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত রাজনীতি? সত্যিই ‘ইনক্রেডিবল’! এ দেশে ভোট বৈধ, কিন্তু ভোটার অবৈধ! এ দেশে মুসলিম ছাড়া অন্য ধর্মের মানুষ বৈধ, কিন্তু তার নাগরিকত্ব অবৈধ!
চরম নির্লজ্জ এই রাজনীতি টুকরো টুকরো করবে দেশ। প্রতিটি রাজ্যেই অন্য রাজ্যের লক্ষ লক্ষ মানুষ আছেন। এটা কি ভারতকে দুর্বল করার চক্রান্ত নয়? রাজ্যগুলি যদি শুধুই নিজের লোক ছাড়া অন্যদের কারোকে থাকতে দেব না— এই নীতি নেয়, তা হলে ভারতের সংবিধান ও সংবিধান–প্রসূত আইনটিকে বদলে নিতে হয়— যেখানে পরিষ্কার বলা আছে— ‘ইয়ে দেশ হ্যায় হামারা’। ‘উই দি ইন্ডিয়ান’ শব্দবন্ধ দিয়ে আমাদের সংবিধানের প্রস্তাবনা শুরু। সকলেই সারা দেশে থাকার, সম্পত্তি ও নাগরিকত্বের বিচারে সম দাবির অধিকারী। অসমে ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চের মধ্যরাতকে ভিত্তি সময় মেনে যা হচ্ছে, তা কেবল অসমেই প্রযোজ্য— এমন একটা আইনি ব্যাখ্যা দেওয়া হচ্ছে।
সুপ্রিম কোর্টের আবার ভেবে দেখার সময় এসেছে। ৪০ লক্ষ মানুষের জীবন–জীবিকা–পরিবার বিপন্ন করে তাদেরকে টুকরো টুকরো করে দেওয়া হচ্ছে এই বলে যে, তাদের নাম প্রাথমিক খসড়ায় নেই। এই নাম না থাকা মানেই তারা ভারতবাসী হিসাবে বঞ্চিত হবে— এটা কি বলা যায়? যার আধার কার্ড আছে, ভোটার কার্ড আছে, ব্যবসা–পেশা–চাকরির এবং পিতৃপুরুষের নথিও আছে, সেও যদি বাতিল হয়, তা হলে কাল অন্য রাজ্যগুলিতেও বা এটা হবে না কেন— এমন দাবি উঠলে এই প্রজাতন্ত্রের অস্তিত্বই আদতে বিপন্ন হবে। একটি বহুত্ববাদী দেশ ও সমাজকে ধ্বংস করার এই রাজনীতি বন্ধ করতেই হবে। আইন যদি হয় অনুপ্রবেশকারীকে চিহ্নিত করে ফেরত পাঠানোর জন্য, সে ক্ষেত্রেও তার প্রয়োগ ভারতে হতে হবে মানবিক। কারণ বৃহত্তর এই দেশটার বাইরে কেউই নয়।
(সৌজন্যে:- আজকাল)