“আমি সামান্য মানুষ, জীবনে অনেক জিনিষ এড়িয়ে চলেছি। তাই মরবার পরেও আমার দেহটা যেন তেমনি নীরবে, একটু ভদ্রতার সঙ্গে, সামান্য বেশে, বেশ একটু নির্লিপ্তির সঙ্গে পুড়ে যেতে পারে।”
তিনি চলে গিয়েছিলেন কাউকে কিছু না জানিয়ে। নিঃশব্দে, রাতের অন্ধকারে। তেমনই ইচ্ছে ছিল তাঁর। কন্যা শাঁওলীকে লিখেছিলেন তাঁর ‘ইচ্ছাপত্র’। এক বার নয়, বেশ কয়েক বার। ১৯৯৭ সালের ১৮ই মে রাত দুটো বেজে ১৫ মিনিটে শম্ভু মিত্র শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার পর তাঁরই ইচ্ছে অনুযায়ী কন্যা শাঁওলী গভীর রাতে সিরিটির শ্মশানে বৈদ্যুতিক চুল্লিতে তাঁর নশ্বর দেহটি দাহ করে ফিরে এসে পিতার মৃত্যুসংবাদ জানিয়েছিলেন। শ্মশানের ভারপ্রাপ্ত কর্মচারীটি মধ্যরাতের শ্মশানযাত্রীদের দেখে ও মৃত মানুষটির নাম জেনে প্রশ্ন করেছিলেন, “ইনি কি সেই শম্ভু মিত্র? যিনি নাটক করেন?” উত্তর পাননি। পাওয়ার কথা নয়। কারণ, তাঁর সেটাই ইচ্ছা ছিল।
তবু এই যাওয়ার ধরনটিকে মেনে নিতে কষ্ট হয়েছিল তাঁর অগণিত শুভানুধ্যায়ীর। শম্ভু মিত্র ছিলেন বাংলার নবনাট্যের জনক। প্রবাদপুরুষ। সেই মানুষটিই যখন জীবনের মঞ্চ থেকে নিজের অন্তিম প্রস্থানকে নিখুঁত ভাবে লিখে দিয়ে যান, তাকে অস্বীকার করার অধিকার কারও থাকে না। শুধু প্রশ্ন থেকে যায়, কেন?
শাঁওলী তাঁর পিতার জীবনী লিখতে গিয়ে জানিয়েছেন, “জীবনভর অনেক মন্দ কথা শুনেও, নাট্যমঞ্চ নির্মাণের ক্ষেত্রে বারংবার অসফল হয়ে এবং বারংবার বিশ্বাসঘাতকতার আঘাত সহ্য করেও, নিজের শিষ্যদের কাছে চরম অপমানিত হয়েও যিনি হতাশা বা নৈরাশ্যে ভোগেননি, জীবনের শেষ প্রান্তে পৌঁছেও যিনি বলেছেন,
“স্বপ্ন তো দেখতেই হবে। স্বপ্নগুলো সব কাচের মতো ভেঙে গুঁড়িয়ে গেছে। আবার সেগুলো তো জড়ো করতে হবে’, …’’
প্রশ্নটা থেকেই গিয়েছে …
‘গ্রুপ থিয়েটার’ বলতে আজকে আমরা যা বুঝি, বাংলা নাটকের ইতিহাসে তার প্রকৃত সূচনা হয়েছিল ওই বহুরূপী প্রতিষ্ঠার দ্বারা, ১৯৪৮-এর ১লা মে। আজ বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ তথা বিশ্বের যেখানেই বাঙালির বসবাস, গ্রুপ থিয়েটার নেই এমনটা ভাবাই যায় না। বহুরূপীর নামকরণ করেন পূর্ববর্ণিত মহর্ষি। আর দলের প্রতীকরূপে যে-মুখোশের ছবি, সেটি দক্ষিণ ভারতের মালয়ালমভাষী, কেরালার ঐতিহ্যবাহী লোকনাট্য কথাকলির মুখোশ। একটু কৌতূহলী হয়ে মুখোশের ছবিটি উলটোলেও দেখা যাবে, অনুরূপ আরো এক মুখ। মুখোশের এই চমৎকারিত্ব আনার কৃতিত্ব খালেদ চৌধুরীর, যিনি বহুরূপীর মঞ্চসজ্জাকার থেকে মেকাপম্যান, প্রয়োজনে অভিনেতা। বহুরূপীর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে কুমার রায়, সবিতাব্রত দত্ত, গঙ্গাপদ বসু, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, কলিম শরাফী, মোহাম্মদ জাকারিয়া, শোভন মজুমদার, অমর গঙ্গোপাধ্যায়, স্মৃতি ভাদুড়ী, গীতা ভাদুড়ী, তৃপ্তি মিত্র, দেবতোষ ঘোষ, শাঁওলী মিত্র ও আরো বহুলোকের নাম। তবু শম্ভু মিত্র আর বহুরূপী, নাম দুটি অনন্য ও উজ্জ্বল। দলের বহুধাউদ্দেশ্যকে বাস্তবরূপ দিয়েছেন যেমন, তেমনি প্রতিভায় তিনি বহুরূপীরই নয়, বাংলা নাট্যজগতেই পুরোধা হয়ে আছেন।
শম্ভু মিত্রের অভিনেতা হিসেবে মঞ্চে আত্মপ্রকাশ কুড়ি বছর বয়সে। তাঁর ছাত্রজীবন কাটে কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে, যে-কলেজের অন্যতম ছাত্র বাংলার অন্য এক যুগন্ধর নাট্যব্যক্তিত্ব উৎপল দত্ত। ১৯৩৫ থেকে শুরু করে প্রায় আমৃত্যু তিনি নাটকের সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন। কেবল অভিনয় করেছেন নাটকে, তাই নয়, শম্ভু মিত্রকে আমরা পাই নাট্যকার ও নাট্যপরিচালকরূপে, পাই নাট্যবিষয়ক প্রবন্ধকাররূপেও। নাট্যবিষয়ে বক্তৃতাকারী শম্ভু মিত্র, এ তাঁর অন্যতর পরিচয়। মঞ্চনাটক ছাড়াও তিনি বেতার নাটকেও নিয়মিত অংশ নিয়েছেন। দীর্ঘকাল সম্পাদনা করেছেন বহুরূপী ষান্মাসিক পত্রিকাটি। ঐতিহ্যবাহী নাট্যবিষয়ক এই পত্রিকাটি দীর্ঘ চুয়াত্তর বছর ধরে নিয়মিত, অবিচ্ছিন্নভাবে প্রকাশিত হয়ে আসছে।চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেছেন শম্ভু মিত্র। সমসাময়িক বা তাঁর কিছু পূর্বেকার নাটকের অভিনেতা যাঁরা, যেমন শিশির ভাদুড়ী, ছবি বিশ্বাস, অহীন্দ্র চৌধুরী, উৎপল দত্ত, কুমার রায়, গঙ্গাপদ বসু প্রমুখ যেমন চলচ্চিত্রে অভিনয়কেও আত্মপ্রকাশের মাধ্যম মনে করতেন, শম্ভু মিত্রও তাই। তবে একান্তভাবেই মঞ্চনাটকে নিবেদিতপ্রাণ শম্ভু মিত্র কলকাতা আর মুম্বাইয়ের চলচ্চিত্রে অভিনয় করেও নিয়মিত চলচ্চিত্রে অভিনয়ের ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে পারেননি।এই যে নানা শম্ভু মিত্রের মালা, তাঁর সঙ্গে যোগ করতে হবে নিজ নাটকের দলটিকে বছরের পর বছর ঋদ্ধ করে তোলা, বাঙালি দর্শকের কাছে একের পর এক নন্দিত, আহ্লাদিত আর অভূতপূর্ব নাট্য-প্রযোজনার অবতারণা করে বাংলা নাট্যচর্চাকে সম্ভ্রান্ত পর্যায়ে উন্নীত করে তোলা, কলকাতা ও কলকাতার বাইরে নাটক মঞ্চায়নের মাধ্যমে বৃহত্তর দর্শকমন্ডলীর সামনে নাটক প্রদর্শনের মাধ্যমে বাংলা নাটককে বৃহদায়তনে নিয়ে আসা এবং তাকে জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে শম্ভু মিত্রের নিরলস প্রয়াসকে। আজ যে বাংলা নাটকের বিপুল চলমানতা, বৈচিত্র্য, হাজার হাজার অভিনেতা-অভিনেত্রীর নাটকে যোগদান, নাট্যবিষয়ক পত্রপত্রিকার ব্যাপকতা, নাট্য-গবেষণার অভিজাত ব্যাপ্তি, দর্শকবৃন্দের নাট্যসচেতনতা, তাঁর পেছনে শম্ভু মিত্রের অবশ্যম্ভাবী ও স্থায়ী অবদানকে অস্বীকার করা যাবে না। মনে রাখতে হবে, কোনো অর্থকরী লাভালাভের বিবেচনাকে একেবারেই গুরুত্ব না দিয়ে তাঁর এবং তাঁর দলের সদস্যদের যে-নান্দনিক কারুবাসনা, তারই গতিজাড্যে প্রথমে কলকাতায় ও পরে সমগ্র পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল গ্রুপ থিয়েটারের বৈভব আর মুন্শিয়ানা, শিক্ষিত মানুষ অভিনয় করতে এলেন, শিক্ষিত মানুষ গ্রুপ থিয়েটার না দেখলে নিজেকে প্রকৃত শিক্ষিত বলে ভাবতে দ্বিধাবোধ করতে শুরু করলেন। একটি জাতির সাংস্কৃতিক ইতিহাসে এমন ঐতিহ্যিক উত্থান এবং তার পরম্পরাকে অনুসরণ ও রক্ষা করার ভেতর দিয়ে যে উত্তরাধিকারের অরণি বয়ে নিয়ে চলা, তার মূল্যায়ন সহসা করা হয় না। আরো দুর্ভাগ্য, আমাদের মতো দেশে আমরা ঠাহর করার চেষ্টাও করি না, দেবতার দীপ হাতে কে আমাদের অন্ধকার থেকে আলোয় আহবান জানান, আলোর মূল উৎসটি কোথায়। বহুরূপী যে-পরম্পরার জন্ম দিলো, তারই প্রসারতা লক্ষ করি অনতিবিলম্বে উৎপল দত্তের ‘লিটল থিয়েটার গ্রুপ’ বা এল.টি.জি (ফেব্রুয়ারি ১৯৪৯), অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়-রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্তের ‘নান্দীকার’, বাদল সরকারে ‘শতাব্দী’ (১৯৬৭), শ্যামল ঘোষের ‘গন্ধর্ব’ (১৯৫৬) বা অনুরূপ আরো গ্রুপ থিয়েটারের আবির্ভাবে। পেশাদার রঙ্গমঞ্চের প্রতিস্পর্ধী এই নাট্যদলগুলো বাংলা নাটকের নবজাগরণে যে-ভূমিকা রেখেছে, তা অতুলনীয়। শম্ভু মিত্র এই নাট্যযজ্ঞের পুরোহিত।
শম্ভু মিত্রের জন্ম হয়েছিল ১৯১৫ সালের ২২শে অগস্ট কলকাতার ডোভার রোডে। পিতা শরৎকুমার, মা শতদলবাসিনী। শম্ভুরা তিন ভাই, পাঁচ বোন ছিলেন। বড় ভাই কাশীনাথ। পাঁচ বোনের মধ্যে একজন শৈশবেই মারা যান। বাকিরা হলেন বনলতা, তরুলতা, পুষ্পলতা ও মাধবীলতা। এঁদের জন্মের কয়েক বছরের ব্যবধানে মধ্যম পুত্র শম্ভু ও সব থেকে ছোট শঙ্করনাথের জন্ম হয়েছিল।
শরৎকুমারের পূর্বপুরুষ ছিলেন হুগলি জেলার কলাছড়া গ্রামের জমিদার। যদিও শরৎকুমার কোনও দিনই জমিদারি বিষয়ে আগ্রহী ছিলেন না। তিনি জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার গ্রন্থাগারে চাকরি করতেন। অবসর নেওয়ার পর সামান্য সঞ্চয় নিয়ে চলে গিয়েছিলেন উত্তরপ্রদেশে। সেখানেই জীবনের শেষ দিন অবধি কাটিয়েছেন। অন্য দিকে মা শতদলবাসিনী ছিলেন ভবানীপুরের স্বনামধন্য ডাক্তার আদ্যনাথ বসুর কন্যা। বিয়ের দিন তাঁর হবু স্বামীর অকালপ্রয়াণে বাবার অনুরোধে তিনি বিয়ে করেছিলেন শরৎকুমারকে। স্ত্রীর ভরণপোষণের ক্ষমতা শরৎকুমারের ছিল না। আদ্যনাথই সে দায়িত্ব নিয়েছিলেন। কলকাতার ডোভার রোডে একটি বাড়ি তিনি যৌতুক দিয়েছিলেন জামাইকে। শতদলবাসিনী খুব বেশি দিন বাঁচেননি। কিন্তু শম্ভুর জীবনে মায়ের প্রভাব এতটাই ছিল যে, খারাপ কাজ করার কথা ভাবতে পারেননি। তাঁর শুধু মনে হত, ‘মা আকাশ থেকে সব দেখছেন।’
শম্ভু মিত্রর পড়াশোনার শুরু বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট হাই স্কুলে। এখানে পড়ার সময় থেকেই অভিনয় ও আবৃত্তির প্রতি তাঁর আগ্রহ তৈরি হতে শুরু করে। তাঁর সঙ্গে একই ক্লাসে পড়তেন তাঁর ভাগ্নে দুর্গা। এই দুর্গা এক বার ক্লাসের মধ্যে হঠাৎই আবৃত্তি করে উঠেছিলেন ‘রঘুবীর’ নাটক থেকে। শম্ভু বলেছিলেন, “ওই আবৃত্তির সামনে আমার নিজেকে কীরকম তুচ্ছ মনে হল।”
দুর্গার সঙ্গে ছাত্রজীবনে তিনি নাটক করেছেন কখনও স্কুলে, কখনও বকুলবাগানের ‘গোল মাঠে’। হয়তো এই ভাবেই নাট্যমঞ্চে তাঁর প্রথম পদার্পণ। অন্য যে আগ্রহটি ছেলেবেলায় ক্রমশ তাঁর মনের মধ্যে চেপে বসেছিল, তা আবৃত্তি। প্রতিবেশী প্রবোধ মিত্রকে শম্ভু ‘বড়দা’ বলে ডাকতেন। তিনিও অল্প বয়সে তাঁকে আবৃত্তিতে উৎসাহী করে তুলেছিলেন। শাঁওলী জানাচ্ছেন, মুখস্থ করে ফেলার অভ্যেস ছিল তাঁর বাবার। “মুখস্থ করার নেশা এবং ক্ষমতা এতটাই ছিল যে, ‘সঞ্চয়িতা’ কিংবা তারও পূর্বে প্রকাশিত ‘চয়নিকা’, গোটাটাই মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। কোন পৃষ্ঠায় কোন কবিতা আছে তা পর্যন্ত বলে দিতে অসুবিধা ছিল না। যেন এর চেয়ে সহজ কাজ আর নেই পৃথিবীতে।”
১৯৩১ সালে শম্ভু প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাশ করেন। সেই ফল প্রকাশের পর তাঁর বাবা এসেছিলেন ছেলের ঘরে। গলা খাঁকারি দিয়ে একটিই শব্দ মুখ থেকে বার করেছিলেন, “ইয়ে”। তার পর নিজের হাতে ধরা দুটো জিনিস ছেলেকে দিয়ে তিনি চলে গিয়েছিলেন। মোড়ক খুলে শম্ভু আবিষ্কার করেছিলেন বস্তু দুটোর একটি ফাউন্টেন পেন, অন্যটি কালির দোয়াত। ছেলের সাফল্যে শরৎকুমারের খুশি হওয়ার এইটুকুই ছিল বহিঃপ্রকাশ। আসলে এ রকমই এক আশ্চর্য মানুষ ছিলেন তিনি। বাড়িতে দুই ছেলের সঙ্গে প্রায় কথাই বলতেন না। বেশির ভাগ সময় তাঁকে দেখা যেত বইয়ে মুখ ডুবিয়ে আছেন। তিনি যে ঠিক কী পড়তেন তার খোঁজ পেয়েছিলেন শম্ভু বাবার মৃত্যুর পর। দুই ছেলের উদ্দেশে তাঁর নির্দেশ ছিল, “তোমরা পড়াশোনা করবে কী করবে না, কেমন করে বাঁচবে, সে তোমরা নিজেরা ঠিক কোরো।” এই মানুষটির নীরব উপস্থিতি শম্ভু ও শঙ্করের জীবনকে অদৃশ্য এক শাসনে বেঁধে রেখেছিল।
স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে শম্ভু মিত্র ভর্তি হয়েছিলেন সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে। কিন্তু অল্প দিনের মধ্যেই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রতি তিনি আগ্রহ হারান। কলেজ ছেড়ে দেন। ঠিক করেন নিজেই নিজেকে শিক্ষিত করে তুলবেন। এর পরই বাবার সঙ্গে দুই ভাই চলে যান উত্তরপ্রদেশ। তত দিনে শরৎকুমার অবসর নিয়েছেন। প্রথমে লখনউ, তার পর ইলাহাবাদ। ইলাহাবাদে থাকার সময় থেকেই শম্ভু মিত্র শরীর এবং স্বরের চর্চা সমান ভাবে চালাতে থাকেন। সেই সঙ্গে ছিল পাবলিক লাইব্রেরিতে বসে পড়াশোনা করে নিজেকে তৈরি করার আপ্রাণ চেষ্টা। নাটক, সাহিত্য, বিজ্ঞান, সমাজতত্ত্ব, মনস্তত্ত্ব প্রভৃতি নানা বিষয়ের বই তিনি পড়তে শুরু করেন। এক দিন লাইব্রেরি থেকে বাড়ি ফিরছেন সন্ধেবেলা। শুনলেন, পাশের বাড়িতে ‘আলমগীর’ নাটকের রেকর্ড বাজছে। “মনে হল যেন শ্যামের বাঁশি বাজল। নাটক ছাড়া আমার গত্যন্তর নেই।”
১৯৩৬-৩৭ সালে শম্ভু মিত্র ফিরে এলেন কলকাতায়। প্রথম ঠিকানা, ছেলেবেলার বন্ধু বিশে বা বিশ্বনাথ মিত্রর বাড়ি। সেখান থেকে ল্যান্সডাউন রোডে জ্যোতিনাথ ঘোষের বাড়ি। যাঁকে তিনি ডাকতেন জ্যোতিনাথদা বলে। এইখানে শম্ভু থাকতেন গৃহকর্তার ভাইয়ের মতো। জ্যোতিনাথের ছেলেমেয়েদের পড়াতেন। এই বাড়িই তাঁকে ‘শম্ভু মিত্র’ হয়ে উঠতে সাহায্য করেছিল। জ্যোতিনাথ তাঁকে থিয়েটার, সিনেমা দেখাতেন, বিদেশি বই জোগাড় করে দিতেন। শারীরচর্চা, স্বরচর্চা একই ভাবে চলত। তবে তখন থিয়েটারের প্রেমে মগ্ন হলেও কলকাতার থিয়েটার পাড়ায় যোগ দেওয়ার কোনও ইচ্ছেই শম্ভু মিত্রর হয়নি। আকস্মিক ভাবে নিছক ‘চ্যালেঞ্জ’ জানিয়ে থিয়েটার পাড়ায় যুক্ত হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু কেমন ছিল সেই অভিজ্ঞতা? শম্ভু মিত্রর ভাষায়, “গিয়ে দেখি কোথায় সেই কল্পনার থিয়েটার! একটা পার্ট ধরিয়ে দিলে, এতটুকু একটা কাগজের মধ্যে খুদে খুদে অক্ষরে লেখা। বলল, কাল সন্ধেবেলায় এটা অভিনয় করবেন।” রিহার্সাল হল না, পুরো নাটক সম্পর্কে কিছুই তাঁকে বলা হয়নি। তবু অভিনয় করতে হয়েছিল। এই ভাবেই শম্ভু মিত্র যুক্ত হলেন ‘রঙমহল’ থিয়েটারে, সম্ভবত ১৯৩৯ সালে।
এই রঙমহল থিয়েটারেই তাঁর প্রথম দেখা হয়েছিল ‘গুরু’ মনোরঞ্জন ভট্টাচার্যের সঙ্গে। যাঁকে তিনি ডাকতেন ‘মহর্ষি’। মহর্ষির প্রজ্ঞা ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য যেন ওই নামকে সার্থক করেছিল। পরম স্নেহে ও ভালবাসায় তিনি কাছে টেনে নিয়েছিলেন শম্ভুকে। আমৃত্যু অটুট ছিল এই সম্পর্ক।
রঙমহলে কয়েকটি পুরনো নাটকে অভিনয় করার পর তিনটি নতুন নাটক ‘মালা রায়’ (বিধায়ক ভট্টাচার্য, নির্দেশনা নরেশ মিত্র), ‘রত্নদীপ’ (প্রভাত মুখোপাধ্যায়) ও ‘ঘূর্ণি’ (নির্দেশনা অহীন্দ্র চৌধুরী) অভিনয় করেন। তার পর বন্ধ হয়ে যায় রঙমহল। প্রখ্যাত অভিনেতা ভূমেন রায় এর পর তাঁকে নিয়ে যান ‘মিনার্ভা’ থিয়েটারে। সেখানে তখন ‘জয়ন্তী’ নাটকটি হচ্ছিল। এখানে তিনি ‘বড় অ্যাক্টর’ হিসেবে মান্য হতেন। কিন্তু এক দিন এখান থেকেও বেরিয়ে আসেন, কারণ মহর্ষিকে অপমানিত হতে দেখেছিলেন। এ বার ভূমেন রায় তাঁকে নিয়ে এলেন ‘নাট্যনিকেতন’-এ। তারাশঙ্করের ‘কালিন্দী’তে শম্ভু মিত্র পেলেন ‘মিস্টার মুখর্জি’র ভূমিকা। কিন্তু নাট্যনিকেতনও উঠে গেল এক দিন। সেই থিয়েটার চলে এল শিশির ভাদুড়ীর হাতে। ‘শ্রীরঙ্গম’ নাম নিয়ে নতুন করে শুরু হল তার যাত্রা। মহর্ষি নিয়ে এলেন শম্ভু মিত্রকে। শিশির ভাদুড়ীর নাটক আর অভিনয় ধারার সঙ্গে পরিচয় ঘটল শম্ভুর। উইংয়ের পাশে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে শিশির ভাদুড়ীর অভিনয় দেখতেন আর ভাবতেন, “এতো প্রচণ্ড জীবনীশক্তি একটা মানুষের থাকে কি করে? তিনিই আমাদের প্রথম নির্দেশক। আমার অনুমান সমগ্র ভারতবর্ষের প্রথম নির্দেশক যিনি মঞ্চের ছবি কল্পনা করেছেন। যিনি আলো, দৃশ্যপট, অভিনয় দিয়ে থিয়েটরের একটা সামগ্রিক রূপ প্রথম এই দেশে এনেছিলেন।” যে দিন অভিনয় থাকত না, সে দিন বসত আড্ডা। শিশিরকুমার যদি শেক্সপিয়র থেকে কিছুটা আবৃত্তি করে শোনান, তো শম্ভু মিত্র শোনান টি এস এলিয়টের কবিতা। দুই দিকপালের মধ্যে কথোপকথন হত এই ভাবে, “শিশির, ‘কী হল?’ শম্ভু, ‘কেন? বেশ তো হল!”
যত দিন যাচ্ছিল কলকাতার রঙ্গালয়ের পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছিলেন না। ১৯৪০-৪১ সালে শ্রীরঙ্গম ছেড়ে বেরিয়ে এলেন তিনি। এ বার যুক্ত হলেন কালীপ্রসাদ ঘোষ বি এস সি-র টুরিং কোম্পানিতে। কিন্তু এখানেও বেশি দিন থাকেননি। নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন। কারণ তত দিনে তিনি জীবনের গুরুত্বপূর্ণ এক সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছেন। যুদ্ধ, ফ্যাসিবাদ, মন্বন্তর, দাঙ্গা চল্লিশের দশককে উত্তাল করে তুলেছিল। এর কিছু আগে তৈরি হয়েছিল ‘অ্যান্টি-ফ্যাসিস্ট রাইটার্স অ্যান্ড আর্টিস্টস অ্যাসোসিয়েশন’। যার থেকে পরে ‘গণনাট্য সংঘ’র জন্ম। এই সংগঠনের ছাতার তলায় বামপন্থী বুদ্ধিজীবী, শিল্পী ও সাহিত্যিকরা সমবেত হতেন। ও দিকে যুদ্ধের বোমা পড়ার ভয়ে শহর কলকাতা প্রায় নাগরিকশূন্য। শম্ভু মিত্র লিখছেন, “তখন ১৯৪১ সাল, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের কাল। আমি শ্যামবাজারের থিয়েটার ছেড়ে দিয়েছি এবং ফ্যাসিবিরোধী লেখক ও শিল্পী সংঘের সঙ্গে পরিচিত হইনি। কিন্তু সাধারণ নাগরিক হিসেবে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে আমাদের নিঃসহায়তায় কষ্ট পেয়েছি।”
২৬ বছরের যুবক শম্ভু সেই একাকিত্বের মধ্যে বসেই লিখেছিলেন তাঁর প্রথম নাটক ‘উলুখাগড়া’, শ্রীসঞ্জীব নামে। গল্পও লিখতে শুরু করেছিলেন, নাম ‘সংক্রমণ’। তবে তাঁর সেই অসহায় অবস্থা কেটে গিয়েছিল ফ্যাসিবিরোধী লেখক ও শিল্পী সংঘের ডাক পেয়ে। ৪৬ ধর্মতলা স্ট্রিটের বাড়িতে পা রেখে এমন সব মানুষের সংস্পর্শে এসেছিলেন, যাঁরা জনতার ‘মুখরিত সখ্যে’ থাকতে চান। এমন ইচ্ছে তাঁরও মনে তখন দানা বাঁধছিল। আজীবন তিনি তাঁর নাটকের মধ্য দিয়ে সেই চেষ্টাই করে গিয়েছেন। ‘গণনাট্য সংঘ’ শম্ভু মিত্রকে প্রথম সেই পরিবেশ তৈরি করে দিয়েছিল।
১৯৪২-৪৩ সালে বিনয় ঘোষের ‘ল্যাবরেটরি’ ও বিজন ভট্টাচার্যের ‘আগুন’ মঞ্চস্থ হল। তার পর হল ‘জবানবন্দী’ ও ‘নবান্ন’। ‘নবান্ন’র সাফল্য তো মিথে পরিণত হয়েছে। এর পরিচালক ছিলেন বিজন ভট্টাচার্য ও শম্ভু মিত্র। এই নাটকই বাংলা নাটকের ইতিহাসে নবনাট্য আন্দোলনের জন্ম দিয়েছিল। শম্ভুবাবু তাঁর নাট্যচিন্তার প্রথম সার্থক প্রয়োগ করতে পেরেছিলেন এই ‘নবান্ন’ নাটকে। সেই সঙ্গে তাঁর কণ্ঠে জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রর ‘মধুবংশীর গলি’ গণনাট্য আন্দোলনের এক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হয়ে উঠেছিল।
বিজন ভট্টাচার্যর সঙ্গে ‘আগুন’ করার সময়ে তৃপ্তি ভাদুড়ির সঙ্গে পরিচয় হয় শম্ভু মিত্রর। তৃপ্তির নিজের মেজমাসিমার ছেলে ‘গোষ্ঠদা’ই হলেন বিজনবাবু। প্রসঙ্গত দু’জনকেই বিজন ভট্টাচার্য নিয়ে এসেছিলেন গণনাট্য সংঘে। পরবর্তী কালে আইপিটিএ-র হয়ে খাজা আহমদ আব্বাস যখন ‘জবানবন্দী’ নাটকের হিন্দি অনুবাদ ‘শেষ অভিলাষা’ অবলম্বনে ‘ধরতী কে লাল’ ছবি পরিচালনায় হাত দিলেন, শম্ভুবাবুকেই ডেকে নিলেন ছবির অভিনেতা এবং সহপরিচালক হিসেবে। এই ছবিতে অভিনয় করতে শম্ভু-তৃপ্তি দু’জনেই মুম্বই যান। এবং এই শহরেই পরিণয় সূত্রে বাঁধা পড়েন। শাঁওলী মিত্রর বর্ণনায় পাই, “মা-বাবার বিয়ে হয়েছিল ১৯৪৫ সালের ১০ই ডিসেম্বর মুম্বই শহরে। ওদের বিয়ে হয়েছিল খাজা আহমদ আব্বাসের বাড়িতে। সে বাড়ির নাম ছিল ‘সমুদ্র তরঙ্গ’। আব্বাস সাহেবের স্ত্রী মুঝঝি ও শ্যালিকা ছাদি বিয়ের বিরিয়ানি রান্না করেছিলেন। বিয়েতে উপস্থিত ছিলেন তখনকার কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা। কন্যাকর্তা হন মামুজান, তিনি ছিলেন আব্বাসের শ্বশুর এবং মামাও বটে। দস্তুরখান বিছিয়ে ইসলামি কায়দায় বিরিয়ানি খাওয়া হয়েছিল।” ১৯৪৫ সালে যাঁর বিয়ে ছিল ‘গ্র্যান্ড আই পি টি এ ইভেন্ট’, মাত্র তিন বছর পরে ১৯৪৮ সালে সেই শম্ভু মিত্রই গণনাট্য ও ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি ছেড়ে বেরিয়ে আসেন। সে দীর্ঘ ইতিহাস অনেকেরই জানা।
১৯৪৮ সালে গণনাট্য থেকে কেবল যে শম্ভু মিত্র একা বেরিয়ে এসেছিলেন, এমন নয়। বিজন ভট্টাচার্য, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রর মতো আরও অনেক শিল্পীই চলে এসেছিলেন। এঁরা সকলেই ছিলেন বাম মনোভাবাপন্ন ও গণতান্ত্রিক স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। সে দিক থেকে দেখলে মনে হতেই পারে শম্ভুবাবুরা এই সংঘে যে কাজ করতে এসে বাধা পেয়েছিলেন, তারই সার্থক বিকল্প হিসেবে জন্ম হয়েছিল ‘বহুরূপী’র, ওই একই বছরে। যদিও ‘বহুরূপী’ নামকরণ হয় ১লা মে ১৯৪৯ (মতান্তরে ১৯৫০) সালে মহর্ষির প্রস্তাব মেনে। প্রথম প্রযোজনা ছিল অবশ্যই ‘নবান্ন’। রঙমহলে তা মঞ্চস্থ হয়েছিল ‘অশোক মজুমদার ও সম্প্রদায়’ নামে। নাটকের প্রায় সকল অভিনেতাই ছিলেন ‘গণনাট্য’র প্রাক্তন সদস্য। প্রাতিষ্ঠানিক বামপন্থী রাজনীতির বাইরে এসেও তাঁরা তাঁদের রাজনৈতিক বিশ্বাসকে টিকিয়ে রেখেছিলেন। শম্ভু মিত্র ছিলেন যাঁর পুরোধা।
IPTA থেকে শম্ভু মিত্রসহ আরো অনেকেই বেরিয়ে এসেছিলেন। কারণটা সংক্ষেপে জানা দরকার। শম্ভু মিত্র ‘ভাগনাসে’ (ভারতীয় গণনাট্য সংঘ) যোগ দিয়েছিলেন বিনয় ঘোষ ও বিজন ভট্টাচার্যের অনুপ্রেরণা ও আহবানে। ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির সাংস্কৃতিক শাখারূপে ভাগনাস ক্রিয়াশীল ছিল। এর আগে পেশাদারি মঞ্চে কয়েক বছর অভিনয় করেন তিনি। প্রথমে রঙমহল মঞ্চে বিধায়ক ভট্টাচার্যের ‘রত্নদীপ’, ‘গৌর শীর’, ‘ঘূর্ণি’ নাটকে। এরপর তিনি যোগ দেন মিনার্ভায়, এবং জয়তী নাটকে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করে প্রশংসিত হন। এরপরে তিনি আসেন ‘নাট্যনিকেতনে’। এরপর কিছুদিন তিনি শিশির কুমার ভাদুড়ীর পরিচালনায় জীবনরঙ্গ নাটকে অংশ নেন। পরে কালীপ্রসাদ ঘোষের ভ্রাম্যমাণ নাট্যদলের সঙ্গে ছিলেন। পেশাদারি দল তাঁকে কিছুতেই তৃপ্তি দিতে পারছিল না। তাঁর নাট্য-এষণা, নাটক নিয়ে ভাবনা-চিন্তা, উচ্চাকাঙ্ক্ষার কাছে শিশিরকুমার-কালীপ্রসাদেরা ন্যূন বিবেচিত হচ্ছিলেন, যদিও শিশিরকুমারের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ছিল তাঁর অপরিসীম। এ-সময়েই তিনি ভাগনাসে যোগ দেওয়ার তাগিদ অনুভব করেন। কমিউনিস্ট পার্টি তখন ব্রিটিশ শাসকদলের কাছে সুয়োরানী, কেননা হিটলার রাশিয়া আক্রমণ করলে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি মিত্র শক্তির সমর্থক হয়ে পড়ে ও রুশবিরোধী অক্ষশক্তির প্রতিকূলতা করে, একে ‘জনযুদ্ধ’ আখ্যা দেয়। তাই বিয়াল্লিশের আন্দোলনে এবং বাংলার দুর্ভিক্ষ-মন্বন্তরকেও তারা কিন্তু মূলত নেতিবাচক দৃষ্টিতে গ্রহণ করেছিল। নেতাজী সুভাষচন্দ্রের প্রতিও কটূক্তি করে তারা। অথচ এখানে একটি স্ববিরোধ দেখতে পাই আমরা। বাঙালি সংস্কৃতিমনাদের প্রায় সিংহভাগ, ঋত্বিক ঘটক থেকে রবিশঙ্কর, দেবব্রত বিশ্বাস, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, সলিল চৌধুরী, স্নেহাংশু আচার্য, সকলেই ভাগনাসের ছত্রছায়ায় আসেন। অচিরে মোহভঙ্গও হয় তাঁদের। পার্টি তাঁদের ওপর চাপিয়ে দেয় নানা অবাঞ্ছিত শর্ত, সংস্কৃতির অঙ্গনে রাজনীতির অভিভাবকত্ব প্রকট হতে থাকে। তাছাড়া অন্তর্কলহ ভাগনাসে ভাঙন ধরায়। রবিশঙ্কর তাঁর স্মৃতিকথায় লিখছেন, ‘পার্টির অফিস থেকে নানা রকম ফরমায়েশ আসতে শুরু করল। … একটা সময় বুঝতেই পারছিলাম বড় বেশি মাপজোখের মধ্যে প্রবেশ করছি। … কিছুদিন পরেই বুঝলাম ওদের মূল দৃষ্টি কোনো টপিকাল ইস্যু নিয়ে কাজ করা। … স্থায়ী সাহিত্যের সঙ্গে সাংবাদিকের যে দূরত্ব, এদের কাজ-কারবারের সঙ্গে দেখলাম স্থায়ী কোনো শৈল্পিক কাজের সেই দূরত্ব থেকে গেছে। … কী রকম যেন নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে-বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ঠেকতে লাগল।’ এমন অবস্থা অনেকেরই হচ্ছিল। যেমন বিজন ভট্টাচার্য বা শোভা সেন। আনন্দবাজারের চাকরি ছেড়ে বিজন ভট্টাচার্য ভাগনাসকে ভালোবেসে যোগ দিয়েছিলেন। থাকতেন গোয়াবাগানের কমিউনে, যেখানকার চিলেকোঠায় শম্ভু মিত্রও ছিলেন। করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়, সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালী ছবিতে সর্বজয়ারূপে যিনি সমধিক পরিচিত ছিলেন গণনাট্যে। স্বামী সুব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির সভ্য ও মুম্বাইবাসী। তাঁরা থাকতেন আন্ধেরির কমিউনে। অাঁচড়ে এঁদেরও মোহভঙ্গ হয়। এইভাবে নবান্নের তুমুল সাফল্য সত্ত্বেও (বর্ধমানের হাটগোবিন্দপুরে ঝড়-বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে লক্ষাধিক দর্শক এ-নাটক দেখতে এসেছিলেন, নবান্ন থেকে লালদুর্গ গ্রন্থে লিখেছেন শোভা সেন) সংঘের নাট্যশালাটির অকালমৃত্যু ঘটে। ১৯৪৮-এর ফেব্রুয়ারিতে কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় অধিবেশন বসে কলকাতায়, আর তার কিছুদিনের মধ্যেই ভারত সরকার কমিউনিস্ট পার্টিকে বেআইনি ঘোষণা করে। নেতাকর্মীরা আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যান।
নবান্নর পর দীর্ঘ এক বছর সময় নিয়েছিলেন শম্ভু মিত্র নিজেকে ও দলের বাকিদের প্রস্তুত করতে। অপেশাদার একটি নাট্যদল কী ভাবে এগিয়ে যাবে তার পথনির্দেশ ছিল একান্তই জরুরি। ১১এ, নাসিরুদ্দিন রোডের ফ্ল্যাটে ছিল শম্ভু ও তৃপ্তির সংসার। ওই ফ্ল্যাটে সংসার পেতেছিল বহুরূপীও। এখানে বসেই মিত্র দম্পতি এক দিকে যেমন নিদারুণ দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে নবনাট্যের ভিত তৈরি করছিলেন, তেমনই বহুরূপীর সদস্যরাও নিজেদের দলের উপযোগী করে তুলতে চেষ্টা করছিলেন। এই দলের সদস্য হওয়ার সঙ্গে একটি বিশেষ জীবনবোধ ও চর্চার যোগ ছিল। যার কেন্দ্র ছিল দেশের মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা। আর লক্ষ্য, ‘ভালো নাটক, ভালো করে করে যাওয়া’।
এই ভাবনা থেকেই একে একে মঞ্চস্থ হতে লাগল ‘পথিক’ (১৯৪৯), ‘উলুখাগড়া’ (১৯৫০), ‘ছেঁড়া তার’ (১৯৫০), ‘বিভাব’ (১৯৫১)। বিষয়গত দিক থেকে গণনাট্যের ভাবনার অনুসারী হলেও আঙ্গিকগত দিক থেকে নিরীক্ষার ছাপ ছিল স্পষ্ট। উৎপল দত্ত বলেছেন, “গণনাট্য আন্দোলন থেকে এলেই যে হল না, নাট্য প্রযোজনা বা অভিনয়ের ক্ষেত্রে পেশাদারি সূক্ষ্মতারও বিরাট প্রয়োজন আছে, এই সত্যটি তিনি-ই সকলের চোখের সামনে তুলে ধরলেন।” আর বিভাস চক্রবর্তীর কথায়, “এইভাবেই নবনাট্য আন্দোলন শম্ভু মিত্র ও বহুরূপীর হাত ধরে এগিয়ে গিয়েছিল অনেকখানি। সেই আন্দোলনকেই আজ আমরা গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন বলে জানি।”
অনেক দিন আগে, ১৯৫১ সালে ‘বাংলা থিয়েটার’ শিরোনামে একটি লেখায় শম্ভু মিত্র লিখেছিলেন, ‘‘বিদেশিদের কাছে ধার করা জিনিস নিয়ে নাচানাচি করছি— এই ব্যঙ্গ করলে পরাধীন জাতির আত্মাভিমানে ঘা লাগে। এবং হৃদয়ের নির্দেশ অমান্য করে জোর করে উলটো পথে চলে আমরা প্রমাণ করতে চাই যে দেশাত্মবোধে আমরা কারও চেয়ে কম নই। কিন্তু এ প্রচেষ্টা আজও পর্যন্ত নন্দিত হয়নি সাধারণ্যে। বাঙালি থিয়েটার ভালোবাসে। শুধু শহুরে বাবুরা নয়, গ্রামের চাষীরাও। এই যাত্রা তাই থিয়েটারের পদাঙ্ক অনুসরণকারী, প্রতিপক্ষ নয়।’’
অর্থাৎ ‘বহুরূপী’র প্রধান নট ও নির্দেশক মেনে নিয়েছিলেন যে, ১৯৪৭ সালের ১৫ই অগস্টের পর স্বাধীন দেশের বুকে তাঁর দল বা তাঁদের মতো আরও কেউ কেউ যে নাট্যচর্চা শুরু করেছিল, তা আসলে ওই সাহেবদের শেখানো প্রসেনিয়াম থিয়েটারের অনুব্রজন করে চলা। সেই কবেকার সাঁ সুসি বা চৌরঙ্গি থিয়েটারে যে ধরনের নাটক হত, যে রকমের নাটকের আদলে বেলগাছিয়া, পাইকপাড়া, পাথুরিয়াঘাটায় বা অন্য অনেক বাবুবাড়ির নাটমন্দিরে বঙ্গসন্তানদের শৌখিন নাট্যচর্চার শুরু হয়েছিল, যার খেই ধরে গিরিশচন্দ্র ঘোষ থেকে শুরু করে তাঁর গুরু শিশির ভাদুড়ি পেশাদার থিয়েটারের পতাকা উড়িয়েছেন, তার খোল বা নলচে কোনওটাই দেশি নয়। সেটি ‘ধার করা’। ধার করা জিনিসকে নিজের বলে চালানোর মধ্যে এক ধরনের আত্মপ্রবঞ্চনা আছে। অথচ দেশ থেকে লালমুখো সাহেবের পাল মানে মানে বিদায় হয়েছে বলে স্বাদেশিকতার দোহাই দিয়ে বা ‘নবনাট্য’ লেবেল সেঁটে রাতারাতি কোনও বদল আনার মতো পরিস্থিতি নেই। এ তো টেক্সটবুক নয় যে কমিশন গড়া হল আর ১৮৫৭ সালে যা হয়েছিল তার নাম ‘সিপাহী বিদ্রোহ’ না বলে ‘ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম’ বলার নিদান হেঁকে দিলাম! শত্তুরের মুখে ছাই লেপে দেওয়া সোজা। কিন্তু একশো-দেড়শো বছর ধরে বিলিতি থিয়েটারের যে ধাঁচা শহর থেকে দূরে, আরও দূরে ছড়িয়ে পড়েছে, তার সঙ্গে আপাতত সন্ধি স্থাপন না করলে থিয়েটার বস্তুটিই উবে যেতে পারে। যেমন দেশ জুড়ে লিংক ল্যাঙ্গুয়েজ হিসেবে ইংরেজিকেও রাজভাষার তকমা দিতে হয়েছে, তেমন প্রসেনিয়াম থিয়েটারকেও দিতে হবে বইকী!
এই ভাবনাকে সামনে রেখেই ‘বহুরূপী’ পথ চলতে শুরু করেছিল। শম্ভু মিত্র কোনও দিন সে দলের সভাপতি হননি। সম্পাদকও হননি। কিন্তু, যত দিন ‘বহুরূপী’তে ছিলেন তত দিন তাঁর শিল্পদর্শনকে শিরোধার্য করেই দল চলেছে। ১৯৪৯ সালের ‘পথিক’ থেকে ১৯৭১ সালের ‘চোপ, আদালত চলছে’ – সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে। এই ট্র্যাডিশনের আনাচে কানাচে চোখ রাখলে ক্রমবিবর্তনের একটি ছবি স্পষ্ট হয়।
কেউ কেউ বলার চেষ্টা করেন ‘বহুরূপী’ গড়ে ওঠার পর শম্ভু মিত্রের প্রথম নির্দেশিত নাটক ‘নবান্ন’। এ দাবি অসার। কারণ, ‘বহুরূপী’ নামটিরই তখন কোনও অস্তিত্ব ছিল না। শম্ভু মিত্র ও বিজন ভট্টাচার্যের যুগ্ম পরিচালনায় ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘের ‘নবান্ন’ প্রযোজনার সঙ্গে এই নবীকৃত ‘নবান্ন’-র ফারাক ছিল না বললেই চলে। তা ছাড়া, ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘের ‘নবান্ন’-এ যাঁরা অভিনয় করতেন তাঁদের অনেকে এই ‘নবান্ন’-তেও ছিলেন। সব চেয়ে বড় কথা নবীকৃত ‘নবান্ন’-র অভিনয় হয়েছিল হাতে গোনা। আর আমন্ত্রিত অভিনয়? একটিও নয়! ফেলে আসা মতাদর্শের বোঝা সাত তাড়াতাড়ি নামিয়ে রেখেছিলেন শম্ভু মিত্র ও তাঁর সঙ্গীরা। ১৯৪৯ সালে তুলসী লাহিড়ীর ‘পথিক’ প্রযোজনা করেই খাতা খুলেছিল ‘বহুরূপী’।
যে নবনাট্যের সন্ধানে ‘বহুরূপী’র পথ চলা শুরু, তার একটি প্রাথমিক শর্তই ছিল নতুন নাট্যকারদের বরণ করা। তুলসী লাহিড়ী সে আমলের প্রতিষ্ঠিত নাট্যকার। তাঁর লেখালেখিতে স্বদেশ ও সমকাল বিধৃত। তাই একে একে তাঁর ‘পথিক’ (১৯৪৯), ‘ছেঁড়া তার’ (১৯৫১) প্রযোজনা করেছে ‘বহুরূপী’। সে আমলে জনপ্রিয় মন্মথ রায়, শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত, বিধায়ক ভট্টাচার্যের সঙ্গে মৌলিক পার্থক্য ছিল ‘বহুরূপী’র সামাজিক দায়িত্ববোধ সংক্রান্ত শপথের। তাই বলে ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘের ঘনিষ্ঠ নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্য, দিগিন্দ্রচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, ঋত্বিক কুমার ঘটকের কাছেও হাত পাতেননি শম্ভু মিত্র। নিজে কলম ধরেছেন। লিখেছেন ‘উলুখাগড়া’ (১৯৪৯), ‘বিভাব’ (১৯৫১)। এর মধ্যে দ্বিতীয় নাটকটি তাঁর নিজের খুব প্রিয় ছিল। নাটকের ফর্ম ও প্রেজেন্টেশন নিয়ে যে এক্সপেরিমেন্ট তিনি করতে চেয়েছিলেন, সেই সুযোগ কড়ায়-গণ্ডায় উশুল করেছিলেন ‘বিভাব’-এ। দর্শক তৈরি থাকলে এ নাটকের অনেক অভিনয় হতে পারত!
এর পরই শম্ভু মিত্র হাত দিলেন ‘চার অধ্যায়’ (১৯৫১)-এ। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে তিনি আগেও কাজ করেছেন। করেছেন পরেও। কিন্তু, স্বাধীনতার চার বছরের মাথায় একটি রবীন্দ্র উপন্যাসের নাট্যরূপ দিয়ে নির্দেশনা দেওয়ার মূলে ছিল সন্ত্রাসবাদী স্বাধীনতা আন্দোলনের দার্শনিক ভিত্তিকে প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করানোর আগ্রহ। স্কুলপাঠ্যে ক্ষুদিরাম বসুকে ‘সন্ত্রাসবাদী’ বলা উচিত হয়েছে কিনা তা নিয়ে ইদানীং চাপানউতোর চলছে। ইন্দ্রনাথ-অতীন-এলাদের মতো স্বঘোষিত সন্ত্রাসবাদীদের পথ ও পাথেয় নিয়ে সেই ১৯৫১ সালেই জিজ্ঞাসু হয়েছিলেন শম্ভু মিত্র। নিজের মতো করে একটি উত্তর খাড়াও করেছিলেন তিনি। আমআদমিকে লুঠ করে স্বরাজ আনার রাজসূয় যজ্ঞকে এক রকম নিন্দাই করেছিল তাঁর ‘চার অধ্যায়’।
নাট্য সমালোচক ও গবেষকদের মতে এই সময় থেকেই ‘বহুরূপী’র বেশির ভাগ নাটকে সমষ্টির চাইতে ব্যক্তিকেই প্রাধান্য পেতে দেখা গিয়েছিল। তা বলে বার্নার্ড শ-এর মতো ‘ম্যান অ্যান্ড সুপারম্যান’-এর ধন্দে পড়েননি শম্ভু মিত্র। তাঁর অনুমোদন নিয়ে আন্তেন চেকভ বা জে বি প্রিস্টলির বাংলা রূপান্তর প্রযোজনা করেছে ‘বহুরূপী’। নিজে বঙ্গীকরণ করেছেন রিয়ালিস্টিক থিয়েটারের পুরোধা হেনরিক ইবসেনের ‘এনিমি অফ দ্য পিপল’-এর। তৈরি হয়েছে ‘দশচক্র’ (১৯৫২)। আজ অনেকেই মনে করেন ট্র্যাজিক হিরো ডাক্তার অমলেন্দু বসুর মধ্যে নিজেকেই দেখতে পেয়েছিলেন শম্ভু মিত্র। এর ছ’বছরের মাথায় আবার ইবসেনে ফিরেছিলেন। ‘ডলস হাউস’ থেকে গড়ে নিয়েছিলেন ‘পুতুল খেলা’ (১৯৫৮)। এ নাটকে নারীর স্বাধীন হওয়ার স্পৃহাকে অকুণ্ঠ স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল। মনে রাখতে হবে, এর কয়েক বছর আগেই বিবাহবিচ্ছেদ সংক্রান্ত ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্ট তার ঐতিহাসিক রায় জানিয়েছিল। আর এ নাটকের এক বছর আগে ‘বহুরূপী’র নির্দেশক লিখেছিলেন, ‘যে-কোনো নাট্যরূপই আমরা অবলম্বন করি না কেন, উদ্দেশ্য হল আজকের দিনের সমস্যাকে দর্শকের মনের সামনে তুলে ধরা, আজকের কষ্টকে আর আজকের চেষ্টাকে প্রতিফলিত করা।’ শম্ভু মিত্র তাঁর যুগধর্মকে অস্থিমজ্জায় বুঝতেন। তাই ‘বুলু’কে এমন মমতা দিয়ে গড়েছিলেন বাংলার মাটিতে।
‘বহুরূপী’র ‘রক্তকরবী’ (১৯৫৪) তো কিংবদন্তি। সকলেই এত কাল এ নাটকের প্রয়োগকুশলতায় মগ্ন ছিলেন। রবীন্দ্রনাট্যের প্রথম সফল নির্দেশকের উষ্ণিক পরিয়েছিলেন শম্ভু মিত্রের মাথায়। কেউ কেউ পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে শ্রমজীবী মানুষের ‘সওগাত’ হিসেবে একে বুঝতে চেয়েছিলেন। সত্যি বলতে কী, জওহরলাল নেহরুর সরকার এই প্রযোজনাটিকে যে ভাবে বিদেশি অতিথি-অভ্যাগতদের সামনে উপস্থাপনার ব্যবস্থা করেছিল, তাতে বুঝতে বাকি থাকে না যে, তারা এই নাটকটিকে ভারতীয় সংস্কৃতির পরাকাষ্ঠা বলেই বিবেচনা করেছে। আমাদের মনে হয়, প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় বৃহৎ শিল্প উদ্যোগের ঢালাও বন্দোবস্তের বিরুদ্ধে একটি নান্দনিক উচ্চারণ হিসেবেও ‘রক্তকরবী’কে দেখা উচিত। ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘে থাকার সময় ‘মুক্তধারা’ করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছেন শম্ভু মিত্র। ১৯৫৯ সালে আবার ফিরিয়েও আনেন। ভাকরা নাঙ্গালের মতো বৃহৎ বাঁধ প্রকল্পের বিরুদ্ধে তাঁর কিছু বলার ইচ্ছে হয়েছিল নিশ্চয়ই। নইলে দু’বার একই নাটক ফিরিয়ে আনার সাধনা কেন? তাঁকে অরাজনৈতিক কলাকৈবল্যবাদী বলার আগে এই দৃষ্টান্তগুলি মাথায় রাখা উচিত। ‘কাঞ্চনরঙ্গ’ (১৯৬১)-এর মতো মজাদার নাটকের মধ্যেও সামাজিক প্রহসনের একটি ফল্গুধারা বয়ে গিয়েছে।
বাংলা নাটকের ইতিহাসে ১৯৫৪ সালটি বিশেষভাবে চিহ্নিত হয়ে আছে বহুরূপী নাট্যসংস্থা-প্রযোজিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রক্তকরবী মঞ্চায়নের জন্য। মাত্র ছ-বছরের নাট্যদল, যদিও তাঁদের প্রারম্ভিক প্রযোজনাগুলিও ছিল যথেষ্ট সম্ভ্রম আদায় করা ও একইসঙ্গে সমীহ করার মতো। দলে ছিলেন মনোরঞ্জন ভট্টাচার্যের মতো প্রবীণ নাট্যব্যক্তিত্ব, শিশিরকুমার ভাদুড়ীর সীতা নাটকে বাল্মীকির ভূমিকায় অভিনয়সূত্রে যাঁর চিরস্থায়ী নামই হয়ে যায় ‘মহর্ষি’। ছিলেন ভারতীয় গণনাট্য সংঘ থেকে বেরিয়ে আসা (ভাগনাস) সবিতাব্রত দত্ত, তৃপ্তি ভাদুড়ী (পরবর্তীকালে মিত্র), শম্ভু মিত্র। নবান্ন নাটক দিয়ে দলটির নাট্যযাত্রার সূচনা, যে নবান্ন (১৯৪৪) আইপিটিএতে অভিনীত হয়ে সাড়া ফেলে দিয়েছিল একদা। এছাড়া পথিক, ছেঁড়া তার, উলুখাগড়া, বিভাব, দশচক্র, স্বপ্ন আর ধর্মঘট ইত্যাদি রক্তকরবীর আগে বহুরূপী-কর্তৃক প্রযোজিত হয়েছিল, যে-নাটকগুলোর রচয়িতারা হলেন তুলসী লাহিড়ী, ইবসেন বা ইউজিন ও’নিলের মতো নাট্যকার। রবীন্দ্রনাথের নাটকও ’৫৪-পূর্ববর্তী পর্বে করে সে-দল, কিন্তু সেটি প্রকৃত প্রস্তাবে নাটক ছিল না। চার অধ্যায় উপন্যাসের নাট্যরূপ ছিল সেটি। কিন্তু ১৯৫৪-র ১০ মে বহুরূপী রেলওয়ে ম্যানশন ইনস্টিটিউটে রক্তকরবীর যে-মঞ্চয়ন করে, নানা দিক দিয়ে ঘটনাটি তাৎপর্যবাহী। রবীন্দ্রনাথের জীবতকালে এ-নাটক স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ করতে চেয়ে ব্যর্থ হন। নাটকের ভাষাকে দর্শকের কাছে গ্রহণযোগ্য করা দুরূহ হয়ে দাঁড়াবে বলে আশঙ্কা ছিল। রূপক-সাংকেতিক নাটক বলে রবীন্দ্রনাথের ডাকঘর, মুক্তধারা, রাজা, রক্তকরবীকে এমনভাবে সমালোচককুল দেগে দিয়েছিলেন, যেন এসব নাটকের মঞ্চায়ন অসম্ভব বলেই বিবেচিত হয়ে আসছিল। ভালো নাটক ভালোভাবে করবেন, এই দায়বদ্ধতা থেকেই শম্ভু মিত্র সংকল্প নিলেন এ-নাটকটিকে মঞ্চে আনার। ফলে বাংলা গ্রুপ থিয়েটারের ইতিহাস গতিজাড্য পেয়ে গেল।
‘বিসর্জন’ (১৯৬১), ‘রাজা অয়দিপাউস’ (১৯৬৪), ‘রাজা’ (১৯৬৪) নাটকের মধ্যে আঁধারে আলোর সন্ধান করেছেন শম্ভু মিত্র। বিশেষত শেষ দু’টি নাটক সম্বন্ধে তিনি নিজেই ‘অন্ধকারের নাটক’ শব্দবন্ধ ব্যবহার করেছেন। এই অন্ধকারের মধ্যে ‘নেহরুভিয়ান সোশ্যালিজম’-এর ব্যর্থতার হতাশা যেমন আছে, তেমন আছে একের পর এক প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে যুদ্ধ-বিবাদে লিপ্ত ভারতের বুকে হিংসার বাতাবরণও। এর দরুন রবীন্দ্রনাটক যে বহুবিধতার মধ্যে দর্শক ও নাট্যবিদের অনুমোদন পেতে পারে তা আর প্রমাণের অপেক্ষায় থাকল না। এই পর্বে আঙ্গিকের দিক থেকেও একটি নতুন দিগন্তের সন্ধান করেছেন শম্ভু মিত্র। ক্ল্যাসিক্যাল গ্রিক ট্র্যাজেডির আঙ্গিককে বাংলার মঞ্চে এনেছেন। তাঁর সমকালে বাংলায় তো বটেই, ভারতেও গ্রিক-রোমান সূত্র আহরণ করার রেওয়াজ চালু হয়নি।
নাট্য সমালোচক ও গবেষকদের কাছে তাঁর নির্দেশক জীবনের শেষ চার বছরের কাজ খুব গুরুত্বপূর্ণ। নাট্যকার বাদল সরকারকে সর্বভারতীয় দর্শকের কাছে উপস্থাপন করার ষোলো আনা কৃতিত্ব তাঁর। ঘটনাচক্রে ‘এবং ইন্দ্রজিৎ’ করা হয়নি। কিন্তু, ‘বাকি ইতিহাস’ (১৯৬৭) থেকেই রিয়ালিজম থেকে খানিক সরে কিছুটা অ্যাবসার্ড থিয়েটারের দিকে বাঁক নিল ‘বহুরূপী’। ছাত্র রাজনীতির আবর্তে ঢুকে পড়ল নীতীশ সেনের ‘বর্বর বাঁশি’ (১৯৭১) দিয়ে। আবার ‘পাগলা ঘোড়া’ (১৯৭১)-য় ফিরল মৃত্যুচেতনায় আকীর্ণ কিমিতিবাদ।
এর পর আর বাংলা নয়, ভারতনাট্যের নয়া ভগীরথদের চিনতে চাইলেন শম্ভু মিত্র। নাটমঞ্চ প্রসার সমিতির অভিনয়ে পেলেন গিরীশ কারনাডকে। বিজয় তেন্ডুলকরকে আনলেন ‘বহুরূপী’র প্রযোজনায়। হামেশাই যাতায়াত ছিল মহারাষ্ট্রে। নাড়ি ধরতে দেরি হয়নি। ‘শানতাতা, কোর্ট চালু আহে’ থেকে ‘চোপ, আদালত চলছে’ (১৯৭১) যখন হচ্ছে, তখন দেখতে পাই বাস্তবধর্মী নাটক নির্মাণের খড়ির গণ্ডি মুছে ফেলে অনেক দূরে চলে গিয়েছেন শম্ভু মিত্র। পাশে পাচ্ছেন সুদূরের সত্যদেব দুবে, শ্রীরাম লাগুদের।
‘চার অধ্যায়’ বহুরূপীর প্রথম রবীন্দ্রনাটক। খালেদ চৌধুরীর ধারণা, বিষয়ের তাগিদেই একটি উপন্যাসকে নাট্যরূপে উপস্থিত করতে চেয়েছিলেন শম্ভু মিত্র। যদিও সেই সময়ে নাটকটি বামপন্থী মহলে তুমুল আলোড়ন তুলেছিল। দীর্ঘ তিরিশ বছর ধরে অভিনীত হয়েছিল নাটকটি। নকশাল আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত মানুষদের মধ্যেও এর প্রতিক্রিয়া হয়েছিল তীব্র। শাঁওলী জানিয়েছেন, নকশালপন্থী নাট্যকার, অভিনেতা অমল রায় বলেছিলেন, “প্রত্যেকবার দেখার সময়ে আমি মনে তীব্র ঘৃণা ও বিদ্বেষ নিয়ে হলে ঢুকতাম, কিন্তু বেরিয়ে আসতাম বুকের মধ্যে কাউকে না বলতে পারা এক আশ্চর্য যন্ত্রণা নিয়ে।”
১৯৫২ সালে ইবসেনের ‘দশচক্র’র পর ‘রক্তকরবী’ প্রযোজনা হয়েছিল ১৯৫৪ সালে। এই নাটকেই শম্ভু মিত্র ও তাঁর বহুরূপী তাদের পূর্ণ প্রতাপ নিয়ে মঞ্চে আবির্ভূত হয়েছিল। ‘রক্তকরবী’ বাংলা তথা ভারতীয় নাটকে নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা করেছিল। এ নাটক নিয়ে মুগ্ধতা আমাদের আজও শেষ হয়নি। তবে মনে রাখা দরকার, তৎকালীন বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ এই নাটকের প্রথম দু’টি অভিনয়ের পর তা বন্ধ করে দিতে চেয়েছিল।
এর পর ‘পুতুলখেলা’ (১৯৫৮), ‘মুক্তধারা’ (১৯৫৯), ‘কাঞ্চনরঙ্গ’ ও ‘বিসর্জন’ (১৯৬১), ‘রাজা অয়দিপাউস’ ও ‘রাজা’ (১৯৬৪), ‘বাকি ইতিহাস’ (১৯৬৭), ‘বর্বর বাঁশি’ (১৯৬৯), ‘পাগলা ঘোড়া’ ও ‘চোপ আদালত চলছে’ (১৯৭১) অবধি শম্ভু মিত্রর নেতৃত্বে বহুরূপী এগিয়ে ছিল উল্কার গতিতে। ‘রক্তকরবী’ ও ‘পুতুল খেলা’র সাফল্য ছাপ ফেলেছিল মিত্র দম্পতির সাংসারিক জীবনেও। নাটক দু’টির নিয়মিত অভিনয় হত নিউ এম্পায়ার হলে। ১৯৫৯ সালে তৃপ্তি মিত্র বিশ্বরূপায় ‘সেতু’ নাটকে যোগ দিয়েছিলেন। ওই বছরই শম্ভু মিত্র, অমিত মৈত্র ও চিত্রগ্রাহক দেওজীভাই পাদিহার তৈরি করেন একটি চলচ্চিত্র প্রযোজনা সংস্থা। নাম দেওয়া হয় ‘চলচ্চিত্র প্রয়াস সংস্থা’। এই সংস্থা ‘শুভ বিবাহ’, ‘মাণিক’, ‘কাঞ্চনরঙ্গ’, ‘পান্না’র মতো ছবি তৈরি করে। যদিও শম্ভু মিত্র তাঁর চলচ্চিত্র প্রয়াসকে ‘ক্ষুন্নিবৃত্তি’ বলে মনে করতেন। অথচ তাঁর পরিচালিত ‘ধরতী কে লাল’, ‘একদিন রাত্রে, ‘জাগতে রহো’র মতো ছবিকে অনায়াসেই অন্য ধারার ছবি হিসেবে গণ্য করা যায়। যা তৈরি হয়েছিল ‘পথের পাঁচালী’র আগেই। চিত্রপরিচালক হিসেবে তিনি আন্তর্জাতিক পুরস্কারও পেয়েছিলেন। রাজ কপূর তাঁকে দিয়ে আরও ছবি করাতে চেয়েছিলেন।
‘রক্তকরবী’ ও ‘পুতুল খেলা’ নাটকের প্রদর্শন হয়েছে ভারতের বিভিন্ন শহর, এমনকী ঢাকাতেও। শম্ভুবাবু রাশিয়া-সহ পূর্ব ইউরাপের নানা দেশে বহু বার গিয়েছিলেন সাংস্কৃতিক আমন্ত্রণে, আন্তর্জাতিক নাট্যজগতের সঙ্গে পরিচিত হতে। এ দিকে ১৯৬৮ সালে শুরু হয়েছিল ‘জাতীয় নাট্যমঞ্চ’ গড়ার কর্মযজ্ঞ। এই উদ্যোগের অংশ হিসেবেই তিনি ‘মুদ্রারাক্ষস’ ও ‘তুঘলক’-এর মতো নাটকও করেছিলেন। যদিও সে স্বপ্ন অধরাই থেকে গিয়েছিল।
শম্ভু মিত্রর চলার পথ কখনওই মসৃণ ছিল না। বারে বারে দলেরই সদস্যদের বিশ্বাসঘাতকতা, অপমান, অসম্মান তাঁকে সহ্য করতে হয়েছে। তৃপ্তি মিত্রর সঙ্গে বিচ্ছেদ ও পুনর্মিলনের দিনগুলি তাঁকে যাপন করতে হয়েছে নীরবে। নিজের এই যাত্রাপথের কথা বলতে গিয়ে তিনি রসিকতা করে বলতেন, “একটা কেন্নো অন্ধের মতো কেবলই বাঁচবার চেষ্টা করছে, আর কেউ কাঠি দিয়ে তাকে নর্দমার মধ্যে ফেলে দিতে চাইছে। আবার সে শক্তি সংগ্রহ করে ওপরে উঠে আসছে। আবার কেউ তাকে ফেলে দিচ্ছে। এই রকম করেই তো বাঁচা।” এই রসিকতার মধ্যে কোথাও কি লুকিয়ে আছে অভিমানী, বেদনাতুর এক শিল্পী মন?
তৃপ্তি মিত্রর পরিচালনায় ‘ডাকঘর’ (দ্বিতীয় বার) নাটকে অমলের ভূমিকায় অভিনয় করতে আসা চৈতি ঘোষাল নাটকের ‘ফকির’ রূপী শম্ভু মিত্রকে জেনেছিলেন শিশুমনের দৃষ্টি দিয়ে। “আমার মনে হত শম্ভু মিত্র ভীষণ অভিমানী, নরম মনের এক জন শিল্পী-মানুষ। প্রকৃত শিক্ষক। বিশ্বাস করতেন, ভাল কাজ করার জন্য আগে এক জন ভাল মানুষ হওয়া দরকার। এই শিক্ষাই আমি পেয়েছিলাম বহুরূপীতে এসে।”
বহুরূপী দলটি চিরকাল এক রকম থাকেনি। কালের নিয়মেই তার ভাঙন শুরু হয়েছিল। একে একে ‘মহর্ষি’, গঙ্গাপদ বসু প্রমুখ বহুরূপীর সদস্য ও স্বজনরা ইহলোক ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। অনেকে দল ছেড়েছিলেন। ১৯৭৮ সালের ১৬ই জুন বহুরূপীর প্রযোজনায় ‘পুতুলখেলা’ নাটকে শম্ভু মিত্রকে শেষ বারের জন্য মঞ্চে দেখা গিয়েছিল। এর পর বহুরূপীর দফতরে আর তাঁকে দেখা যায়নি বলে জানিয়েছেন তাঁর জীবনপঞ্জি রচয়িতা প্রভাতকুমার দাস। যদিও তাঁকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা হয়েছিল অনেক পরে। বহুরূপী ছেড়ে গেলেও শম্ভু মিত্র কিন্তু নাটক থেকে দূরে যাননি। অন্য নাট্যগোষ্ঠীর প্রযোজনায় মঞ্চে এসেছেন কয়েক বার। ১৯৮০ সালের ১৮ই নভেম্বর ‘গ্যালিলি গ্যালিলিও’ নাটকে নামভূমিকায় শেষ বারের মতো তিনি মঞ্চে এসেছিলেন।
১৯৭৮ সালের ১৫ই অগস্ট অ্যাকাডেমিতে শম্ভু মিত্র পাঠ করেন ‘চাঁদ বণিকের পালা’। নাটকটিকে অনেকেই তাঁর আত্মজীবনী বলে মনে করেন। এই নাটক পড়তে বসলে হয়তো তা সত্যি মনে হয়। শম্ভু মিত্রর মতো মহান এক শিল্পী তাঁর জীবনের ট্র্যাজেডিকে গেঁথে দেন মানুষের চিরন্তন সংগ্রাম ও এগিয়ে চলার ঐকান্তিকতার সঙ্গে। রবীন্দ্রনাথের মতোই তিনি মানুষের উপর বিশ্বাস হারাননি কখনও। যদিও তাঁর “নোঙর তো কেটে দেছে শিব।” তবু তিনি ডাক দেন,
“প্রস্তুত সবাই? হৈ-ঈ-ঈ-য়াঃ। কতো বাঁও জল দেখ। তল নাই? পাড়ি দেও, এ আন্ধারে চম্পক নগরী তবু পাড়ি দেয় শিবের সন্ধানে। পাড়ি দেও, পাড়ি দেও” …
শেষে ফিরতে চেয়েছিলেন বঙ্গনাট্যের মূলে। ‘চাঁদ বণিকের পালা’-য় ধরা ছিল তাঁর নাট্যদর্শনের সারাৎসার। প্রসন্ন, করন্থ, তনবির, পানিক্কর প্রমুখ সর্বভারতীয় নাটমঞ্চে দাপিয়ে বেড়ানোর আগেই লোকায়ত নাট্যনির্মাণের নীল নক্শা ছকেছিলেন শম্ভু মিত্র। আরব্ধ সে কাজ অসম্পূর্ণ থেকেছে। কিছুটা অনিবার্য ভাবেই একা থেকে আরও একা হতে হতে সংগঠনভিত্তিক নাট্যের অঙ্গন থেকে বিদায় নিয়েছেন তিনি। কিন্তু, সিকি শতকের এই অভিযাত্রাই বলে দিচ্ছে, কেন তাঁকে আধুনিক ভারতনাট্যের প্রথম পুরুষ বলতে আমাদের কোনও সংশয় থাকার কথা নয়।
সত্যের সন্ধানে শম্ভু মিত্র সারা জীবন পাড়ি দিয়েছিলেন, কারণ চাঁদের মতোই তাঁর চোখেও স্বপ্ন ছিল। আর নৌকার নাম ছিল ‘বহুরূপী’।
(তথ্যসূত্র:
১- শম্ভু মিত্র: ধ্যানে ও অন্তর্ধানে, শাঁওলী মিত্র, নান্দনিক (২০১১)।
২- শম্ভু মিত্রঃ অন্য সন্ধান, শোভন গুপ্ত, দীপ প্রকাশন।
৩- শম্ভু মিত্র ও সৎনাট্য, শাঁওলী মিত্র, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ।
৪- গণনাট্য নবনাট্য সৎনাট্য ও শম্ভু মিত্র, শাঁওলী মিত্র, আনন্দ পাবলিশার্স।
৫- শম্ভু মিত্র ও বহুরূপী, দিলীপ ঘোষ, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ।
৬- কাকে বলে নাট্যকলা, শম্ভু মিত্র, আনন্দ পাবলিশার্স (২০১০)।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত