পেরিয়ে গিয়েছে ৫ দিন। এখনও ধিকিধিকি জ্বলছে হিংসার আগুন। যদিও গত কয়েকদিন ধরে পেট্রল-বোমা-অ্যাসিড ছুঁড়ে, গাড়ি জ্বালিয়ে তাণ্ডব চলছিল রাজধানীর রাস্তায়, এখন তা থেমেছে। কিন্তু সেই তাণ্ডবের ভয়াবহতা এখনও ভুলতে পারেননি কেউই। আর সর্বোপরি হিংসা ছড়ানো ছাড়া জঙ্গী বা হামলাকারীদের যে কোনও ধর্ম হয় না। তা আরেকবার প্রত্যক্ষ করল হিংসা কবলিত উত্তর-পূর্ব দিল্লী। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা শিব বিহারের নঈম আলি প্রধান বা সেলিম কাসারই হোক বা চাঁদবাগের তারান্নুম বা নেম সিং। নিজেদের ধর্মের উন্মত্ত জনতার হাত থেকে যাঁরা রক্ষা করেছিলেন ভিন্ন ধর্মের আতঙ্কিত মানুষদের প্রাণ।
দিল্লী পুলিশের আমন কমিটির সদস্য ৩৪ বছরের নঈম জানালেন, গত ২৪ তারিখ তাঁদের এলাকা যখন সাম্প্রদায়িক হিংসায় জ্বলছিল, তখন তাঁর কাছে কমপক্ষে আটজন ত্রস্ত হিন্দু যুবক পথনির্দেশ জানতে চান। তাঁদের তাড়া করছিল হামলাকারীরা। ওই যুবকরা দিকভ্রষ্ট হয়ে গিয়েছেন বুঝতে পেরে তিনি এবং তাঁর বন্ধুরা মিলে তাঁদের নিরাপদে হিন্দু কলোনিতে যেতে সাহায্য করেন। আবার ৪৮ বছরের সেলিম কাসার গত ২৫ তারিখ সকালে তাঁর ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে এখনও কেঁপে উঠছেন। সেদিন সকালে তাঁর চোখের সামনেই তাঁদের গাড়ি এবং ৫২ বছরের প্রৌঢ় তাঁর বড়দাকে পুড়িয়ে মেরেছিল হামলাকারীরা।
সেলিম এবং তাঁর পরিবারকে নিজেদের বাড়িতে লুকিয়ে রেখে উন্মত্ত জনতার হাত থেকে রক্ষা করেছিল তাঁদেরই এক হিন্দু প্রতিবেশী পরিবার। পরদিন তাঁকে, তাঁর স্ত্রী, মেয়ে, অন্ধ জামাই এবং মেয়ের দুই সন্তানকে হিন্দুদের মতো পোশাক পরিয়ে, ছেলেদের কপালে তিলক কেটে, মেয়েদের সিঁথিতে সিঁদুর পরিয়ে ওই হিন্দু পরিবারই মুস্তাফাবাদে নিরাপদে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করে বলে জানালেন কাসার। তিনি আরও বললেন, হামলাকারীদের মুখ-মাথা কাপড় ও হেলমেটে ঢাকা ছিল।
চাঁদবাগের তারান্নুম জানালেন, গত ২৫ তারিখ রাতে তাঁদের বিপরীত বাড়ির প্রতিবেশী, পেশায় অটো রিকশাচালক নেম সিং-এর জন্যই তাঁর পরিবারের ১৫ জনের প্রাণ বেঁচেছে। নেম সিংকে ধন্যবাদ জানানোর ভাষা এখনও খুঁজে পাননি তারান্নুম। বললেন, রাতে যখন সদর দরজায় ধাক্কার শব্দ শুনেছিলেন, তখন তাঁরা সবাই ভেবেছিলেন হামলা হতে চলেছে। কিন্তু নেম সিং তাঁদের নিজের ঘরে লুকিয়ে রেখে তাঁদের রক্ষা করেন। অন্যদিকে, নেম সিং বললেন, নিজের প্রাণের চিন্তা থাকলেও এতদিন যে প্রতিবেশী শিশুদের বাড়ির সামনে খেলা করতে দেখেছেন, তাদের আর্তনাদই তাঁকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল তারান্নুমের দরজায়।
উত্তর-পূর্ব দিল্লীর বাসিন্দা এক যুবতীও জানিয়েছেন, কীভাবে উন্মত্ত বিক্ষোভকারীদের হাত থেকে রেহাই পেয়েছিলেন তিনি। বাঁচাতে পেরেছিলেন দুই মেয়েকেও। যুবতী বলেন, রাত নামতেই বাড়ির বাইরে দাঙ্গাবাজদের তাণ্ডব শুরু হয়। বাড়ি থেকে তাঁকে বেরিয়ে আসতে বলে তারা। এরপরে দরজা ভাঙতে শুরু করে। তবে দোতলা বাড়ির বারান্দা দিয়ে কাপড় ঝুলিয়ে নীচে নেমে কোনও রকমে দুই মেয়ের হাত ধরে দৌড় শুরু করি। পাশের মুসলিম মহল্লায় আয়ুব আহমেদের বাড়িতে গিয়েই আশ্রয় নিই। আর মুসলিম মহল্লায় ঢুকতে দেখেই পিছু ধাওয়া করা ছেড়ে দেয় বিক্ষোভকারীরা। এক মুসলিমই খাবার ও মাথা গোঁজার জায়গা দিয়ে প্রাণ বাঁচায় সেদিন।