গত সপ্তাহেই সংসদের দুই কক্ষে পাশ হয়ে গিয়েছে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল(ক্যাব)। আর তারপর বিলে রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরের পর তা এখন আইনে পরিণত হয়েছে। কিন্তু এখনও গোটা দেশজুড়ে জ্বলছে প্রতিবাদের আগুন। বিরোধী দলগুলিও সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের বিরোধিতায় সরব। ঠিক হয়েছিল মোদী সরকারের সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন নিয়ে রাষ্ট্রপতিকে স্মারকলিপি দেওয়া হবে। সেই মতো তার খসড়া তৈরি করেছিল কংগ্রেস। কিন্তু তাতে কিছুটা নরম অবস্থান নেওয়া হয়েছিল। তবে শেষমেশ তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধায়ের হস্তক্ষেপে সেই খসড়া পরিবর্তন করা হয়। সূত্রের খবর, গতকাল বিকেলে রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দের হাতে যে চিঠি তুলে দেওয়া হয়েছে, মমতার পরামর্শে তাতে মোদী সরকারকে সরাসরি আক্রমণ করে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয়েছে।
প্রসঙ্গত, গতকাল সকালেই তৃণমূলের রাজ্যসভার দলনেতা ডেরেক ও’ব্রায়েন দিল্লীতে পৌঁছান। সূত্রের খবর, রাজধানীতে পৌঁছেই গুলাম নবি আজাদের কাছ থেকে পাওয়া খসড়াটিতে তিনি দেখেন যে, চিঠির শেষে লেখা রয়েছে, ‘(নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন সম্পর্কে) রাষ্ট্রপতি যা ভাল মনে করেন, সেটাই করুন।’ এরপরই তৃণমূল নেত্রীর সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করেন ডেরেক। মমতা তাঁকে নির্দেশ দেন, এই অংশ বদলে সরাসরি লিখতে হবে ‘আমরা আপনার কাছে আর্জি জানাচ্ছি, সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন প্রত্যাহার করতে সরকারকে পরামর্শ দিন।’ শুধু তাই নয়। চিঠিতে আরও বেশ কিছু পরিবর্তনের প্রস্তাব দেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী। সম্পূর্ণ নতুন দু’টি লাইন যোগ করার কথা বলেন তিনি।
যার একটি হল, ‘দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো রক্ষা করতে আপনার কাছে আর্জি জানানো হচ্ছে, ভারত সরকার যেন কোনও ভাবেই এই কাঠামোকে ধাক্কা না দেয়।’ আর মমতা প্রস্তাবিত দ্বিতীয় লাইনটি হল, ‘বর্তমান সরকার খোলাখুলি ভাবে বৈষম্যমূলক নীতি নিয়ে চলছে, দেশের সর্বত্র শান্তি এবং সংহতি নষ্ট করছে।’ এরপর বিষয়টি নিয়ে কংগ্রেস নেতৃত্বের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করেন ডেরেক। মমতার প্রস্তাবিত পরিবর্তনগুলি চিঠিতে অন্তর্ভুক্ত করতে বলেন। রাজনৈতিক সূত্রের খবর, প্রাথমিক ভাবে কংগ্রেসের কপিল সিব্বল আপত্তি জানিয়ে বলেন, এটি নেহাতই প্রতীকী চিঠি। এতে সরকারের বর্তমান গতিপথের যে কোনও পরিবর্তন হবে না, সেটা সবাই জানেন। ফলে আইন প্রত্যাহার করতে বলে শেষে ‘লোক হাসানোই’ হবে।
তবে ডেরেক পাল্টা যুক্তি দিয়ে বলেন, যেহেতু বিষয়টি প্রতীকী, সে-হেতু সরকারের এই বৈষম্যমূলক নীতির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপতির কাছে সর্বাত্মক আক্রমণে যাওয়াটাই জরুরি। তাতেই ঠিক বার্তা যাবে। পশ্চিমবঙ্গে মমতাই সর্বপ্রথম এনআরসি-র বিরুদ্ধে আক্রমণে সরব হয়েছিলেন। পরে অন্য মুখ্যমন্ত্রীরা একে একে যোগ দিচ্ছেন। একই ঘটনা ঘটেছিল নোট-বাতিল এবং জিএসটির সময়। ফলে আজকের চিঠিটি প্রতীকী হলেও তাতে ‘ঝেড়ে কাশতে হবে’। রাজনৈতিক সূত্রের খবর, শেষ পর্যন্ত তৃণমূলের যুক্তি মেনে নেন কংগ্রেস নেতৃত্ব। সিপিএম নেতা সীতারাম ইয়েচুরিও তৃণমূলের যুক্তিতে সমর্থন জানান।
জানা গেছে, গতকাল ডেরেক এনআরসি এবং সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন প্রত্যাহারের আর্জি জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতির সামনে। গোটা বিষয়টিকে নোট-বাতিলের সঙ্গে তুলনা করেছেন। পরে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘আমি রাষ্ট্রপতিকে জানিয়েছি, তিন বছর আগে ঠিক এই সময়েই আমরা আপনার পূর্বসূরির কাছে এসেছিলাম। নোট-বাতিলের পরে। সে সময় লড়াইটা ছিল ধনী বনাম দরিদ্রের। আজ মানুষ বাতিলের পরেও লড়াইটা সেই ধনী বনাম দরিদ্রেরই।’ সবমিলিয়ে বলা যায়, কংগ্রেসের নেওয়া নরম অবস্থান বদলে তাঁর নেতৃত্বে যে আবারও কেন্দ্রের বিরুদ্ধে চরম অবস্থান নিল বিরোধীরা, এতে ফের একবার দেশের প্রধান বিজেপি-বিরোধী মুখ হিসেবে উঠে এলেন বাংলার অগ্নিকন্যা মমতা।