প্রতিবেদন : সম্প্রতিই কেরলে চতুর্থ শ্রেণির পাঠ্য বইয়ে একটি পাতা ঘিরে বিতর্কের ঝড় উঠেছে দেশজুড়ে। সেই পাতায় লেখা, ব্রিটিশের ভয়ে জার্মানি পালিয়ে গিয়েছিলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু!(Netaji Subhash Chandra Bose)ইতিমধ্যেই ফরওয়ার্ড ব্লক এর তীব্র নিন্দা করেছে। একে ‘ঐতিহাসিক ভুল’ বলে ক্ষমা চেয়েছে সিপিআইএম। কিন্তু যতই ‘ড্যামেজ কন্ট্রোল’-এর চেষ্টা চলুক, এটাকে কমিউনিস্টদের ‘চিরকালীন চালাকি’ বলে মনে করছেন নেতাজি গবেষকরা। তাঁদের দাবি, “এটা তথাকথিত কমিউনিস্টদের ইচ্ছাকৃত ভুল। সুভাষ বসুকে তারা বারবার প্রো-ফ্যাসিস্ট বলেছে। তাঁর মহানিষ্ক্রমণকে পলায়ন বলে বরাবর অপমান করেছে।”
এর সপক্ষে যুক্তি দিতে লন্ডন আর্কাইভ থেকে ১৯৪২-এর একটি ফাইল সামনে এনেছেন এই গবেষকরা। ২০১৮-এ যা ডিক্ল্যাসিফাই করা হয়। ফাইলটিতে নেতাজির(Netaji Subhash Chandra Bose)সঙ্গে হরবিন্দর সিং সোধি নামে এক কমিউনিস্ট নেতার কথোপকথন পাওয়া যাচ্ছে। দুজনেই তখন রয়েছেন তৎকালীন নর্থ ফ্রন্টিয়ার প্রভিন্স, অধুনা পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়ায়। নেতাজি ছদ্মবেশ নিয়েছেন। সেখান থেকে রাশিয়া পাড়ি দিতে পাসপোর্ট ভিসা হাতে পাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। রাশিয়াও তা অজ্ঞাত কারণে ‘ক্লিয়ার’ করছে না। আবার দেশের কমিউনিস্টরা বলছে নেতাজি ‘প্রো-ফ্যাসিস্ট’। নেতাজির সঙ্গে ওই কমিউনিস্ট নেতার কথায় উঠে আসছে সেই প্রসঙ্গ এবং দলের আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কথা। সম্প্রতি এই তথ্য সামনে রেখে বামেদের এই ‘চিরকালীন দ্বিচারিতা’-র তীব্র প্রতিবাদ করেছেন কলকাতার দুই গবেষক সৈকত নিয়োগী ও সৌম্যব্রত দাশগুপ্ত।

সৈকত নিয়োগী জানাচ্ছেন, সোধির উপর দায়িত্ব ছিল সুভাষকে ওই অঞ্চল পার করিয়ে রাশিয়া পৌঁছে দেওয়ার। সুভাষকে সাহায্য করার পাশাপাশি পার্টি লাইন নিয়েও আলোচনা করছিলেন সোধি। নোট থেকে জানা যাচ্ছে, এ দেশে সে সময় কমিউনিস্ট পার্টির দাবি ছিল, ‘সুভাষ বোস প্রো-ফ্যাসিস্ট’। সেই অবস্থাতেই সোধিকে নিজের অবস্থান, মতাদর্শ বোঝাচ্ছেন সুভাষ। নেতাজি বলছেন, ‘আমি ফ্যাসিস্ট নই। ফরওয়ার্ড ব্লকের দলীয় পত্রিকায় ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আমি বহু লেখা লিখেছি, যেগুলো তোমরা জানো না, তোমরা পড়োনি। কিন্তু দেশ আমার কাছে আগে।’ সৈকত বলছেন, “সুভাষবাবুর মত ছিল, ‘স্বাধীনতার যুদ্ধ আমরা বিভিন্ন মতের মানুষ একসঙ্গে লড়ব। কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যখন প্রশাসন তৈরি হবে তখন সেখানে আমরা গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে যে লড়াই তা লড়ব নিজেদের রাজনৈতিক মতের বিরুদ্ধে।’ সেখানে গান্ধীবাদীদের সঙ্গেও সুভাষবাবু কাজ করেছিলেন।”
পাশাপাশি নোট থেকে জানা যাচ্ছে, সোধির সঙ্গে এই নিয়ে বিবাদ চলাকালীন সুভাষের মনে হয় রাশিয়া পৌঁছতে যে সহযোগিতা দরকার, তার জন্য সোধি যোগ্য লোক নন। তখন সোভিয়েত রাশিয়ার কাছে সুভাষচন্দ্র বারবার অ্যাপ্রোচ করছেন এই বলে যে, তাঁকে ‘সেফ প্যাসেজ’ দেওয়া হোক। কিন্তু রাশিয়া বারবার সেটা রিজেক্ট করছে। তখন ইতালি এগিয়ে আসে। সিসিলির বাসিন্দা অরল্যান্ডো মাজোটা নামে এক মৃত ব্যক্তির পাসপোর্ট নিয়ে সেখানে নেতাজির ছবি বসিয়ে ওই একই নামে তাঁর পাসপোর্ট তৈরি হয়। কিন্তু তার পরও রাশিয়া নেতাজিকে ট্রানজিট ভিসা দিচ্ছিল না। সৈকত বলছেন, “কমিউনিস্টরা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও রাশিয়ায় নেতাজির প্রবেশ আটকেছিল। আবার দেশের ভিতরেও তারা তাঁকে প্রো-ফ্যাসিস্ট বলছিল। ভারত এবং রাশিয়ার কমিউনিস্ট উভয়েরই তখন এক ভূমিকা। ওরা বারবার নেতাজিকে অপমান করেছে। গোটা বিশ্ব যাকে জানে মহানিষ্ক্রমণ বলে, তাকে ‘পলায়ন’ বলেছে সেই কমিউনিস্টরা।”
গবেষক সৌম্য দাশগুপ্তের কথায়, “কেরলের সিপিএম সরকার পাঠ্যবইয়ে নেতাজিকে নিয়ে ওই ভুলকে বলছে ঐতিহাসিক ভুল। আসলে ওটা ইচ্ছাকৃত ভুল।” সৌম্য জানাচ্ছেন, সেই সময় সুভাষচন্দ্রকে দেশের কমিউনিস্টরা বাধা দিয়েছিল। তিনি বলেন, “দেশের স্বার্থে রাজনীতির উর্ধ্বে উঠে দেশের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছিলেন নেতাজি। যে লড়াইকে কমিউনিস্টরা আজও ন্যক্কারজনকভাবে দেখে। তাই কেরলের বইয়ে এই ধরনের কথা লেখা হয়।” সেই নোটেই পাওয়া যাচ্ছে, নেতাজির সহযোগী ভগত রাম বলছেন, এই পরিস্থিতিতে রাশিয়ার উদাসীনতা দেখে ইতালি সড়কপথে সেখান থেকে নেতাজিকে ইরান নিয়ে যায়। তবে শেষ মুহূর্তে ট্রানজিট ভিসা মেলে। কাবুল হয়ে মস্কো ছুঁয়ে জার্মানির বার্লিন পৌঁছন সুভাষচন্দ্র বসু।