প্রতিবেদন : ২০০৩ বিশ্বকাপ ফাইনাল। ২০১৫ বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল। ২০২৩ বিশ্বকাপ ফাইনাল। আইসিসি টুর্নামেন্টের নকআউটে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে হারের যন্ত্রণা ভারতীয় ক্রিকেটপ্রেমীদের কাছে নতুন কিছু নয়। ২০২৩ বিশ্বকাপের ফাইনালের বিভীষিকা এখনও দগদগে প্রত্যেকের মনে। টানা দশটি ম্যাচ জিতে তীরে এসে ডুবেছিল তরী। মঙ্গলবারের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির প্রথম সেমিফাইনাল যেন সেই ক্ষতেই ঢেলে দিল মধুর উপশম-প্রলেপ। দুবাইয়ে অস্ট্রেলিয়াকে চার উইকেটে হারিয়ে প্রতিযোগিতার ফাইনালে পৌঁছে গেল ভারত। বড় মঞ্চে ফের জ্বলে উঠল বিরাট কোহলির ব্যাট। গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখলেন শ্রেয়স, রাহুল, অক্ষর, হার্দিকও। বল হাতে অনবদ্য মহম্মদ শামি।
মঙ্গলবার টসে জিতে ব্যাটিং নেন অজি অধিনায়ক স্টিভ স্মিথ। বড় রান তুলে মন্থর পিচে চাপে রাখতে চেয়েছিলেন প্রতিপক্ষকে। শুরুটা মন্দ হয়নি অস্ট্রেলিয়ার। শামির বলে তরুণ ওপেনার কুপার কোনোলি শূন্য রানে ফিরে গেলেও স্বভাবসিদ্ধ ঝোড়ো গতিতে রান তুলতে আরম্ভ করেন আরেক ওপেনার ট্রাভিস হেড। বেগতিক দেখে রোহিত আক্রমণে আনেন বরুণ চক্রবর্তীকে। আর প্রথম স্পেলের প্রথম বলেই হেডকে (৩৯) প্যাভিলিয়নে ফেরান রহস্য-স্পিনার। এরপর রানের গতি খানিকটা কমে যায় অজিদের। তবে সাবলীল ছন্দেই ইনিংস গড়ছিলেন অধিনায়ক স্টিভ স্মিথ ও মারনাস লাবুশেন। ক্রিজে জমে যাওয়া মারনাসকে (২৯) আউট করেন জাদেজা। এরপর অজি উইকেটকিপার জশ ইংলিসকেও (১১) ফেরান জাড্ডু।
কম সময়ের ব্যবধানে দুটি উইকেট হারালেও সেভাবে ঘাবড়ে যায়নি অজিরা। একদিকে স্মিথ যেমন উইকেটে থিতু হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন, অন্যদিকে দ্রুত রান তুলছিলেন অ্যালেক্স ক্যারি। ৫৪ রানের জুটি তৈরি হয় তাঁদের। স্মিথকে (৭৩) বোল্ড করে পার্টনারশিপ ভাঙেন শামি। বেশিক্ষণ টেকেননি ম্যাক্সওয়েলও (৭)। অক্ষর প্যাটেলের বলে বোল্ড হন তিনি। এরপর অ্যালেক্স ক্যারি (৬১) ও বেন দারুইশ (১৯) ৩৪ রান যোগ করেন। শেষপর্যন্ত অজিদের ইনিংস শেষ হয় ২৬৪ রানে। শ্রেয়স আয়ার দুরন্ত ডিরেক্ট থ্রো-এ ক্যারিকে না ফেরালে হয়তো ২৭০-এর গণ্ডি পেরিয়ে যেত অস্ট্রেলিয়া। ১০ ওভারে ৪৮ রান দিয়ে ৩ উইকেট নেন শামি। বরুণ ও জাদেজা দুটি করে, অক্ষর ও হার্দিক একটি করে উইকেট পান।
রান তাড়া করতে নেমে চেনা ছন্দেই ব্যাটিং শুরু করেন রোহিত। তবে কিউয়ি-ম্যাচের পর এদিনও ব্যর্থ গিল (৮)। দারুইশের বলে প্লেড অন হন তিনি। এরপর রোহিতকে (২৮) যখন ক্রিজে জমাট মনে হচ্ছে, ঠিক তখনই কোনোলির বাঁ-হাতি স্পিনে জব্দ হন ‘হিটম্যান’। সুইপ করতে গিয়ে বল লাগে প্যাডের মাঝ বরাবর। আঙুল তুলতে দেরি করেননি আম্পায়ার। ভারতীয় সমর্থকদের মুখে তখন দুশ্চিন্তার ছায়া। তবে সেই ছায়ায় আলো ফিরতে থাকে বিরাট ও শ্রেয়সের হাত ধরে। ঠাণ্ডা মাথায় ইনিংস গড়তে থাকেন দুজন। ‘কামেথ দ্য আওয়ার, কামেথ দ্য ম্যান’। বিরাটের ব্যাটিং মনে করাচ্ছিল সেই কথাটাই। তাঁর বরফ-ঠাণ্ডা স্নায়ুতে বিলীন হয়ে যাচ্ছিল বড় ম্যাচের চাপ। সিঙ্গল-ডাবলসের ফাঁকে ফাঁকেই আসছিল বাউন্ডারি। এর মধ্যেই পঞ্চাশের মাইলস্টোন ছুঁয়ে ফেলেন বিরাট। দুজনের জুটিতে যখন ৯১ রান উঠে গিয়েছে, ঠিক তখনই পাল্টা আঘাত হানেন অজি লেগস্পিনার অ্যাডাম জাম্পা। তাঁর গুগলি বুঝতে না পেরে বোল্ড হন শ্রেয়স (৪৫)।
এরপর ৪৪ রান আসে বিরাট ও অক্ষরের পার্টনারশিপে। অক্ষরকে (২৭) স্বচ্ছন্দ দেখালেও তাড়াহুড়োয় নাথান এলিসের বলে আড়াআড়ি ব্যাট চালিয়ে বোল্ড হন তিনি। তখনও জয় থেকে ৮৭ রান দূরে ভারত। তবে অজিরা চেষ্টা করলেও চেপে বসতে পারেনি টিম ইন্ডিয়ার উপর। সিঙ্গল-ডাবলসে ভর করেই স্কোরবোর্ড এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকেন বিরাট-রাহুল। জিততে যখন আর মাত্র ৪০ রান বাকি, তখনই গ্যালারিতে নেমে এল অথৈ নীরবতা। জাম্পার বলে আউট হলেন বিরাট (৮৪)। ততক্ষণে জয়ের ভিত অবশ্য গড়েই দিয়েছিলেন তিনি। তবুও মাঠে নিশ্চিত শতরান ফেলে আসায় খানিক মনমরা হয়ে পড়েন সমর্থকরা।
বাকি রান তুলতে আর বেগ পেতে হয়নি ভারতকে। কয়েকটি ডট বল খেলে সমর্থকদের স্নায়ুর চাপ বাড়ালেও তিনটি পেল্লায় ছক্কা হাঁকিয়ে ম্যাচ কার্যত অজিদের হাত থেকে ছিনিয়ে নেন হার্দিক পাণ্ডিয়া। ২৪ বলে ২৮ রান করে আউট হন তিনি। এরপর গ্লেন ম্যাক্সওয়েলের বলকে কাউ কর্নারের উপর দিয়ে গ্যালারিতে পাঠিয়ে ভারতকে কাঙ্ক্ষিত জয় এনে দেন কে এল রাহুল (৪২*)। জাদেজা অপরাজিত থেকে যান ২ রানে। জয়ের উল্লাসে মেতে ওঠেন প্রত্যেকেই। অধিনায়ক রোহিতকে জড়িয়ে ধরেন আবেগঘন বিরাট। ম্যাচের সেরা হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে বিরাটকেই। এই নিয়ে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ইতিহাসে তিনবার ম্যাচ সেরার পুরস্কার জিতলেন তিনি। যা এক রেকর্ড। পাশাপাশি এদিন আরও একটি নজির গড়েছেন বিরাট। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ভারতীয় ফিল্ডার হিসেবে সবচেয়ে বেশি ক্যাচ লুফেছেন তিনি (৩৩৬)। ভেঙে দিয়েছেন রাহুল দ্রাবিড়ের রেকর্ড।
বুধবার দ্বিতীয় সেমিফাইনালে মুখোমুখি হবে নিউ জিল্যান্ড ও দক্ষিণ আফ্রিকা। কিউয়ি না প্রোটিয়া, কারা হবে রোহিতদের প্রতিপক্ষ, সেদিকেই তাকিয়ে তামাম ক্রিকেটমহল। ২০২৪ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পর আরও একটি আইসিসি টুর্নামেন্ট জয়ের স্বপ্নে বুক বাঁধছেন ভারতীয় সমর্থকরা। টিম ইন্ডিয়ার ক্যাবিনেটে কি আসতে চলেছে তৃতীয় চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির খেতাব? ২০২৫-এর দুবাই কি হয়ে উঠতে পারবে ২০১৩-এর রূপকথাময় বার্মিংহ্যাম? তা সময়ই বলবে।