কলকাতা : সোমবার আলিপুরের ধনধান্য অডিটোরিয়ামে স্বাস্থ্য আধিকারিক ও চিকিৎসকদের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে বসলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দেশীয় রাজনীতির আঙিনায় যা নজিরবিহীন বলেই মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল। চিকিৎসা পরিকাঠামো ও পরিষেবার মানোন্নয়নে নতুন দিশা দেখালেন মমতা। করলেন একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা।
প্রথমেই আর জি করের নির্যাতিতার পরিবারকে সমবেদনা জানান মুখ্যমন্ত্রী। পাশাপাশি মনে করিয়ে দেন, রাজ্য সরকার অপরাজিতা বিল আনলেও এখনও পাশ হয়নি রাজ্যপালের দীর্ঘসূত্রিতায়। বলেন, “চিকিৎসকদের কোনও রাজনৈতিক রং নেই। চিকিৎসা মানে সেবা। চিকিৎসক ও তাঁদের পরিবারকে কুর্নিশ জানাই।” মমতার কথায়, “বাম আমলে স্বাস্থ্য নিয়ে অবহেলা হয়েছে। স্বাস্থ্যবিভাগে উন্নয়ন কখনও একজন রাজ্যমন্ত্রী করতে পারেন না। সব কিছু নজর রাখা। ফেক ভিডিও, ফেক মেডিসিন বেরিয়েছে। একটা ভালো কাজকে খারাপ করতে এক সেকেন্ড লাগে। অপপ্রচার এত তাড়াতাড়ি হয়। আগে সোশাল নেটওয়ার্ক ছিল না। কাজেই সেটা সামলাতে হবে।”
মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, “আমরা হাসপাতালগুলিকে রং করেছি। প্রবেশপথ বড় করা হয়েছে। আমাদের রোগীর সংখ্যা বেড়ে গিয়েছে। টেলি মেডিসিনে গড়ে ৭৫ হাজার রোগী চিকিৎসা পান। স্বাস্থ্যসাথীতে ৯ কোটি মানুষ পরিষেবা পান। ৩৮টি মেডিক্যাল কলেজ রাজ্যে। ১৪টি মাদার অ্যান্ড চাইল্ড হাব। ৪০ হাজার বেড বেড়েছে কোভিডকালে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি হাসপাতাল সাহায্য করেছে। কোভিডের প্রতিটি দিন আমি রাস্তায় বেরোতাম। রাস্তার মোড়ে মোড়ে মাইক নিয়ে বলতাম বেরবেন না। যাঁর বাড়িতে কেউ নেই পুলিশ গিয়ে খাবার দিয়ে আসত। অনেক চিকিৎসক, পুলিশকর্মী, ভাই, অফিসে ৪০ বছর কাজ করতেন মারা গিয়েছেন। কোভিড সব পরিবারকে আক্রান্ত করেছে। দুঃখ ভুলতে পারি না।”
মমতা জানান, ১৪ হাজার সরকারি ডাক্তার বাড়িয়েছে রাজ্য। ২৫ হাজারের বেশি প্যারামেডিক্যাল স্টাফ বাড়ানো হয়েছে। নার্সিং সিট বেড়েছে ২৬ হাজার। নিয়োগ থমকে আসছে কারণ, ওবিসি রিজার্ভেশনের জন্য মামলা হয়েছে। “কিছু দুষ্টু লোক আছে যারা কাজের কাজ করে না। একটি মামলা ঠকঠকিয়ে ঠুকে দিল। চিকিৎসা থেকে শিক্ষা নিয়োগ আটকে রয়েছে। আমরা চেষ্টা করছি কেসটা ক্লিয়ার করার”, বক্তব্য তাঁর।
চিকিৎসকদের যে বেতন বাড়ানো হয়েছে, তাও উল্লেখ করেন মুখ্যমন্ত্রী। সর্বস্তরের রেসিডেন্ট ডাক্তারদের বেতন ১৫ হাজার বাড়ানো হয়েছে। জানান, ডাক্তারদের জন্য হস্টেল বেড়েছে। লেডি ডাক্তারদের জন্য হস্টেলের ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রাইমারিতে যাঁরা রেসিডেন্সিয়াল ডাক্তার, বিএমওএইচরা থাকেন তাঁদের হস্টেল ঠিক করতে হবে। কেন্দ্রকে একহাত নিয়ে জানান, “১ লক্ষ ৭৫ হাজার কোটি টাকা পাই আমরা। বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে টাকা। জিএসটি নিচ্ছে। যা ভাগ দেওয়ার কথা দেয় না। তা সত্ত্বেও আমরা চেষ্টা করি।” ডাক্তারদের কুর্নিশ জানিয়ে বলেন, “আপনারা এত ভালো কাজ করেন বলেই হার্ট অপারেশন, যে যতই বিদেশ দেখাক, আমি মনে করি বাংলার যা জ্ঞান, মেধা, প্রতিভা, পরিকাঠামো আছে তা আর কারও নেই।”
মুখ্যমন্ত্রীর স্পষ্ট বার্তা, পুলিশকে সাইবার ক্রাইম রুখতে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। সিভিক ভলান্টিয়ারদের ট্রেনিং দিয়ে হোমগার্ডে পরিণত করা যেতে পারে। “আমি পছন্দ করি ট্রাফিক জ্যামে দাঁড়িয়ে থাকা। আমি কোন হরিদাস যে সিগন্যালে দাঁড়াতে পারব না। আমি মনে করি গাড়ি চললে মানুষের গতি এগিয়ে যায়। একজন ভিআইপি যাবে বলে মানুষকে আটকে দেওয়া আমি পছন্দ করি না। কোনও ভিআইপির জন্য গাড়ি বন্ধ থাকবে না। দুটি ক্রসিংয়ে গাড়ি ঢুকে যাতে কোনও দুর্ঘটনা না ঘটে তাই ওয়াচ টাওয়ারের ব্যবস্থা করুন। দরকার হলে এমপি, এমএলএ-রা টাকা দেবে। সিগন্যালে গানের জন্য আমি অনেক কাজ এমপি ল্যাডের টাকা থেকে করেছিলাম”, বলেন তিনি।
পাশাপাশি, হাসপাতালগুলিতে গান এবং সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার জন্য ২ কোটি টাকা করে দেওয়ার ঘোষণা করেন মুখ্যমন্ত্রী। ইন্টার্ন, হাউস স্টাফ, পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ও পোস্ট ডক্টরেট ট্রেনিদের জন্য ভাতা ১০ হাজার টাকা বাড়ানোর কথাও বলেন। ডাক্তারদের উদ্দেশ্যে বলেন, “মিনিমাম ৮ ঘণ্টা সরকারি পরিষেবা দিন। তারপর প্রাইভেটে ডাক্তারি পরিষেবা দিন। সরকারি পরিষেবা দেওয়ার সময় প্লিজ যাবেন না। অপারেশন করার জন্য বা মরণাপন্ন রোগীকে দেখতে হলে সরকারি হাসপাতালে ডেকে পাঠান। পরিকাঠামো রয়েছে সরকারি হাসপাতালে। বছরে একটা করে এরকম বৈঠক যাতে করতে পারি সেই আশা রাখি। তাতে কমিউনিকেশন বাড়বে।”
মমতার বার্তা, “আমরা চাই গর্বের বাংলা গর্বের বিশ্ববাংলায় পরিণত হোক।” চিকিৎসকদের জানান, “আপনারা বড় হোন। আরও সুন্দর হোন। আপনাদের শুধু অভিনন্দন দিয়ে ছোট করব না। দয়া করে বিদেশে চলে যাবেন না। লোহার শিকল, লোহার বেড়ি বড় অসম্মানজনক। তার চেয়ে বাংলায় থাকুন। ভালো ভবিষ্যৎ কামনা করি। আপনারা চিকিৎসা করেন। অনেক দায়িত্ব। আমি পাহারা দিই।”