বুধবার থেকেই শুরু হয়েছে বহুপ্রতীক্ষিত বিশ্ববাংলা বাণিজ্য সম্মেলন। বিশ্ববাংলা কনভেনশন সেন্টারে আয়োজিত হয়েছে এই মেগা আসর। দু’দিনের এই সম্মেলনে দেশের ২০০ জন প্রতিনিধি-সহ মোট ৫ হাজার বিশিষ্ট শিল্পপতি-শিল্প বিশেষজ্ঞরা যোগ দিচ্ছেন। কলকাতার সীমানা ছাড়িয়ে শিল্পকে যে বাংলার পূর্ব থেকে পশ্চিম ও উত্তর থেকে দক্ষিণ প্রান্তে ছড়িয়ে দেওয়াও যে সম্ভবপর, তা আগেই প্রমাণ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এবার তাতে নতুন মাত্রা যোগ করল বেঙ্গল গ্লোবাল বিজনেস সামিট ২০২৫। যেখানে বাংলার শিল্পের প্রসারের সঙ্গে জুড়ল প্রতিবেশী দেশ ভুটান ও প্রতিবেশী রাজ্য ঝাড়খণ্ড। প্রতিবেশীদের সঙ্গে একই ধরনের প্রাকৃতিক ও সামাজিক সম্পদ ভাগ করে নেওয়া রাজ্যের উন্নয়ন অনেকাংশেই নির্ভরশীল সেই প্রতিবেশী রাজ্য ও দেশের উপরে। তাই এবার বাংলার উন্নয়নের সঙ্গে জুড়বে ঝাড়খণ্ড, ভুটানও। ভুটানের কৃষি ও প্রাণীপালন মন্ত্রী ইউনটেন ফুন্টসো ও ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেনের কথাতেও ফুটে উঠল একই সুর।
উত্তরবঙ্গের জেলাগুলি নিয়ে একাধিক পরিকল্পনার কথা আগেই জানিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। স্থানীয় শিল্পোন্নয়ন থেকে যোগাযোগে নজর দিয়েছে রাজ্য। এবার সেই মানচিত্রে জুড়তে চলেছে ভুটান। সেদেশের মন্ত্রী ফুন্টসোর দাবি, মূলত চারটি ক্ষেত্রে বাংলার সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে কাজ করার কথা ভেবেছেন তাঁরা। প্রথমত, পর্যটন। দুই এলাকারই সাংস্কৃতিক ও প্রাকৃতিক সম্পদ একই প্রকার। একসঙ্গে কাজ করলে উভয়ের উন্নয়ন সম্ভব বলে আশাবাদী মন্ত্রী। দ্বিতীয়ত, যোগাযোগ ব্যবস্থা। যেখানে অনেকাংশে বাংলার উপর নির্ভরশীলতার কথাও তুলে ধরেন মন্ত্রী। বাংলা সেখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। এক্ষেত্রে নবতম সংযোজন মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা করা পরিবহন করিডোর। তৃতীয়ত, কৃষি ও কৃষি বিপণন। মন্ত্রী ফুন্টসো জানান, জৈব চাষে বাংলার পদ্ধতির সঙ্গে একইভাবে কাজ করে ভুটান। ভুটানের বিস্তীর্ণ কৃষিজমিতে উচ্চমানের উৎপাদিত দ্রব্য প্রয়োজনীয় প্রযুক্তির মাধ্যমে বিপণন হলে বিশ্ববাজার ধরা সম্ভব হবে। তাতে বাংলারও বিশ্ববাজারে স্থান হবে। এর পাশাপাশি পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তিতেও যৌথ উদ্যোগে কাজের কথা জানান তিনি। মন্ত্রী জানান, ভুটান জল, সৌর, বায়ু ও জিওথার্মাল শক্তি শক্তির ভাণ্ডার। দক্ষিণ এশিয়ায় এই শক্তি উৎপাদনে নেতৃত্ব দেয় এই পাহাড়ঘেরা ছোট্ট দেশটি। বাংলার সঙ্গে গ্রিন এনার্জি উৎপাদনে যৌথভাবে কাজ করার ইচ্ছা প্রকাশ করে ভুটান। মন্ত্রীর কথায়, “গ্রিন এনার্জির ক্ষেত্রে ভুটান এশিয়ার মধ্যে একটা গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় রয়েছে। এক্ষেত্রে আমরা এনার্জি পার্টনারশিপ করতে পারি।”
পাশাপাশি, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দরাজ ও ভূয়সী প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলেন ফুন্টসো। মমতাকে ‘মাদারলি ফিগার’ বলেও সম্বোধন করলেন তিনি। স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে তিনি বললেন, “আমার মা ১৯৫৫ সালে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও ওই বছর জন্মান। তাই আমি তাঁর ছেলের মতো। উনি অবশ্যই আমার কাছে মায়ের মতো।” শুধু তাই নয়, বাংলার সঙ্গে ভুটানের পারস্পরিক সম্পর্কের কথা তুলে ধরে মন্ত্রী বলেন, “ভুটান এবং বাংলা শুধুমাত্র প্রতিবেশী নয়। আমাদের মধ্যে সাংস্কৃতিক যোগ আছে। ইতিহাসেরও যোগ আছে। যোগ রয়েছে আধ্যাত্মবাদের ক্ষেত্রেও। ভুটানে মমতা দিদি একটা পরিচিত নাম।” এরপরই সম্মেলনের মঞ্চ থেকে মমতার উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, “আপনার বোল্ড ভিশন গোটা দেশে সুপরিচিত। ট্যুরিজমের ক্ষেত্রে আমাদের পার্টনারশিপ হতে পারে। আমরা বিনিয়োগকারীদের ট্যুরিজমের সুযোগ পর্যালোচনা করার জন্য অনুরোধ করছি।”
উল্লেখ্য, বিশ্বের একমাত্র জিরো কার্বন নিঃসরণকারী দেশ ভুটান। তাদের প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ নিয়ে চিন্তাভাবনার প্রশংসা বিজিবিএস মঞ্চে করেন রাজ্যের অর্থ উপদেষ্টা অমিত মিত্র। এই প্রসঙ্গেই ভুটানের মন্ত্রী ইচ্ছা প্রকাশ করেন যে, দুই প্রশাসনের যৌথ উদ্যোগে এমন শহর তৈরি করতে যেখানে শুধু উঁচু বাড়ির সারি থাকবে না, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মুখে হাসি ফুটবে, এমন শহর তৈরি হবে। কেন তিনি পর্যটন ক্ষেত্রে যৌথভাবে কাজের কথা বলছেন এদিন তার ব্যখ্যাও দিতে দেখা যায় ইয়নটেনকে। তাঁর দাবি, হাই ভ্যালু লো ইনপ্যাক ট্যুরিজমের জন্য ভুটানকে বিবেচনা করা যেতে পারে। কানেক্টিভিটির জন্য ভুটানের সঙ্গে বাংলার সম্পর্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর দাবি, এক্ষেত্রে বানারহাট সামসি রেলপথ মোড় ঘোরানো ভূমিকা নিতে পারে। অর্গানিক ফার্ম ও কৃষি ক্ষেত্রেও ভুটান সম্ভাবনাময় জায়গায় রয়েছে বলে দাবি করেন ফুন্টসো। সর্বোপরি, এদিন মঞ্চ থেকে একগুচ্ছ সম্ভাবনার কথা বলে গেলেন প্রতিবেশী রাষ্ট্রের মন্ত্রী। যা বাস্তবায়িত হলে উন্নয়নের দৃশ্যপটে এক নতুন দিগন্ত খুলে যাবে বলেই মনে করছে বিশেষজ্ঞ মহল।