সম্প্রতি প্রকাশ্যে এসেছে নেট পরীক্ষায় দুর্নীতির ভয়াবহ চিত্র। ডাক্তারির প্রবেশিকা পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে ইতিমধ্যেই শোরগোল পড়ে গিয়েছে দেশজুড়ে। একাধিক মামলাও দায়ের হয়েছে শীর্ষ আদালতে। এরই মধ্যে এবার ডাক্তারির স্নাতকোত্তরে ‘সুযোগ পাইয়ে দেওয়ার’ চক্রের সন্ধান পাওয়া গেল! ৬৫ লক্ষ টাকা দিলেই দেশের যে কোনও স্নাতকোত্তর মেডিক্যাল কলেজে মিলবে এমডি বা এমএস পড়ার সুযোগ! ফোন করে নিট পিজি (স্নাতকোত্তর)-এর পরীক্ষার্থী চিকিৎসক সুমন বিশ্বাসকে এমনই টোপ দেওয়া হল সোমবার। কী ভাবে অনলাইন মাধ্যমে দেওয়া পরীক্ষার নম্বর ‘বাড়িয়ে’ পছন্দের বিষয়ে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হবে, তা-ও জানানো হয়েছে বিশদে।
প্রসঙ্গত, ব্যারাকপুরের বাসিন্দা সুমন এমবিবিএস পাশ করেন ২০২০ সালে। এই মুহূর্তে চাকরি করেন লিলুয়া রেল হাসপাতালে। সেই সঙ্গে স্নাতকোত্তর স্তরে ভর্তির প্রবেশিকা পরীক্ষার জন্য তৈরি হচ্ছেন। পরীক্ষা আগামী রবিবার। সুমনের কাছে গত সোমবার বেলা ১১টা নাগাদ ফোনটি আসে। অপর প্রান্তে হিন্দিতে কথা বলছিলেন এক ব্যক্তি। তিনিই টাকার বিনিময়ে স্নাতকোত্তরে ভর্তি করিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব দেন। ওই ব্যক্তির দাবি, সুমনের দেওয়া প্রবেশিকা পরীক্ষার উত্তরপত্রেই করা হবে ‘কারসাজি’।
ফোনে ওই ব্যক্তিকে বলতে শোনা গিয়েছে, ‘যে প্রশ্নের জবাব পরীক্ষার্থীরা জানেন, সেগুলি লেখেন। যেগুলি জানেন না, লেখেন না। ওখানে (পরীক্ষাকেন্দ্রে) আমরা ম্যানেজ করে নম্বর বাড়িয়ে দিই। অনলাইন মাধ্যমে পরীক্ষা দেওয়ার পর সাইট লক করে দেওয়া হয়। এর পর যখন পরীক্ষার খাতা দেখার জন্য সাইট আনলক করা হয়, তখন যে সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হয়নি, সেখানে আগে সঠিক উত্তর বসানো হয়। তার পর খাতা দেখে নম্বর বসানো হয়। এর ফলে নম্বর বেড়ে যায়। যে দিন ফলঘোষণা হবে, আপনি দেখতে পাবেন, আপনার নম্বর ৬৫০ থেকে ৭৫০ হয়ে গিয়েছে।’
এর পরেই সুমন প্রশ্ন করেন, এই নম্বর বৃদ্ধির জন্য কী করতে হয়? জবাবে ওই ব্যক্তি বলেন, ‘আপনি নিজের পছন্দের তিনটি বিষয় বাছাই করতে পারবেন। তার মধ্যে যে কোনও একটি বিষয়ে স্নাতকোত্তর করতে পারবেন। এর জন্য প্রথমে কিছু নথি দাখিল করতে হয়। তার পর ৬৫ লক্ষ টাকা দিতে হবে।’ জবাবে সুমন জানান, তিনি এই নিয়ে ভাবনাচিন্তা করতে চান। ফোনের অন্য দিকে থাকা ব্যক্তি বলেন, ‘ভর্তি হওয়ার পদ্ধতি এখনই বিশদে জানতে হলে আমার এক সিনিয়রের সঙ্গে কথা বলিয়ে দিতে পারি।’ এর পর ‘ভাবনাচিন্তার জন্য সময় চেয়ে’ ফোনটি রেখে দেন চিকিৎসক।
এভাবে ‘কারসাজি’ করে নম্বর বৃদ্ধি করা কি সম্ভব? লিলুয়া রেল হাসপাতালের চিকিৎসক সুমন বলেন, এই নিট পিজি পরিচালনা করে ন্যাশনাল বোর্ড অফ এগজামিনেশন। তারা ন্যাশনাল মেডিক্যাল কাউন্সিলের অধীনে। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের অধীনে রয়েছে ন্যাশনাল মেডিক্যাল কাউন্সিল। এই ন্যাশনাল বোর্ড অফ এগজামিনেশন স্বশাসিত। এই বোর্ডের হাতেই থাকে পরীক্ষার খাতা। অনলাইন মাধ্যমে হয় পরীক্ষাগ্রহণ। পরীক্ষার্থী উত্তরপত্র জমা (সাবমিট) করলেই তা লক হয়ে যায়। পরীক্ষাকেন্দ্র থেকে তখন ওই উত্তরপত্রে আর কিছু করা যায় না। পরীক্ষার্থীও চাইলে আর খাতা খুলে কিছু করতে পারেন না। উত্তরপত্র চলে যায় বোর্ডের হাতে।
সুমনের প্রশ্ন, তা হলে কী ভাবে ওই ব্যক্তি দাবি করলেন যে, তিনি ওই খাতা ‘আনলক’ করিয়ে ফাঁকা জায়গায় উত্তর বসাবেন এবং সেই মতো নম্বর বাড়িয়ে দেবেন? তিনি নিজে মনে করছেন, ওই ফোন প্রতারণা চক্রেরও হতে পারে। কেউ এই স্নাতকোত্তর স্তরে ভর্তি করিয়ে দেওয়ার টোপ দিয়ে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিতে চাইছেন! নয়তো, তাঁর সন্দেহ, বোর্ডের কেউ এই ‘কারচুপি’-র সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারেন। ডাক্তারির সর্বভারতীয় প্রবেশিকা নিট নিয়ে যে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে, তার আবহে চিকিৎসকের দ্বিতীয় সন্দেহ কিছুটা হলেও পালে হাওয়া পাচ্ছে।