ফের অশান্তিতে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে ভূস্বর্গ। প্রসঙ্গত, গত চারদিনে চারটি সন্ত্রাসবাদী-হামলার খবর এসেছে জম্মু-কাশ্মীর থেকে। রবিবার নরেন্দ্র মোদীর তৃতীয় দফার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার দিনেই রেয়াসিতে একটি তীর্থযাত্রী বাসে হামলা চালানো হয়, মহিলা ও শিশু-সহ ৯ জন নিহত এবং ৪২ জন আহত হন। মঙ্গলবার সন্ধেয় কাঠুয়ার একটি গ্রামে ফের একজন সিআরপিএফ জওয়ানের মৃত্যু হয় সন্ত্রাসী হামলায়। এর পরেই, ডোডায় সেনাবাহিনীর অস্থায়ী অপারেটিং ঘাঁটিতে হামলায় সাত নিরাপত্তা কর্মী আহত হন। বুধবার রাতে ফের উত্তপ্ত হয় ডোডার গান্দো গ্রাম, জখম হন এক জওয়ান। পরপর এই জঙ্গিহানার কারণ খুঁজতে গিয়ে গোয়েন্দারা দায়ী করছেন নিজস্ব ইনটেলকেই। তাঁরা জানিয়েছেন, সীমান্তে অনুপ্রবেশের পথগুলিতে বিশেষ নজর দেওয়া প্রয়োজন ছিল। সূত্রের খবর, গত তিন বছর ধরেই জম্মু-সীমান্তের বিভিন্ন পুরনো অনুপ্রবেশ পথে সেনা মোতায়েন কমেছে। অন্যদিকে পাল্লা দিয়ে শক্তিশালী হয়েছে জঙ্গিরা, নানা আধুনিক উপায়ে নিজেদের প্রশিক্ষিত করেছে তারা। সেনার তরফেও হিউম্যান ও টেকনিক্যাল ইনটেলিজেন্স আগের মতো শক্তিশালী নেই অনেক ক্ষেত্রেই, শোনা যাচ্ছে এমন কথাও।হনিরাপত্তা সংস্থার একটি সূত্রের মতে, সাম্বা-কাঠুয়া রুটে অনুপ্রবেশ বেশ বেড়েছে সম্প্রতি। কাঠুয়া দিয়ে এদেশে ঢোকার পরে সাধারণত ট্রাকে করে সড়কপথে কাশ্মীরে পৌঁছে যেত পাক জঙ্গিরা, কিন্তু এখন সে পথ বদলেছে তারা। পীরপাঞ্জাল রেঞ্জ দিয়ে পাহাড় পেরিয়ে এসে, নিয়ন্ত্রণরেখা পার করে সোজা দক্ষিণ কাশ্মীরের শোপিয়ানে চলে আসছে উচ্চ প্রশিক্ষিত জঙ্গিরা। সেখানেই থেকে যাচ্ছে তারা। স্থানীয়দের মধ্যে মিশে হামলার ছক কষছে। জানা গিয়েছে, এই অনুপ্রবেশগুলি খুবই ছোট ছোট দলে ঘটছে এবং সেই কারণেই অনেক সময়ে নজর এড়িয়ে যাচ্ছে।
এবিষয়ে জনৈক গোয়েন্দা অফিসার জানিয়েছেন, “ওদের কৌশলে অনেক পরিবর্তন এসেছে। এখন এমন সব জায়গায় ওরা ঘাঁটি গাড়ছে, যে সব জায়গায় ওদের আগে দেখা যেত না। ডোডা, উদমপুর, রিয়াসির মতো এলাকাগুলি ওদের অপারেশনের নতুন ফ্রন্ট হয়ে উঠছে। এসব জায়গায় বিক্ষিপ্ত আক্রমণ করে, গুলি চালিয়ে, নিরাপত্তা বাহিনীকে দুর্বল করার চেষ্টা করছে ওরা। যেসব জায়গায় মোতায়েন সামান্য কম, সেখানেই আক্রমণ করছে বেছে বেছে।” এই কৌশলগত পরিবর্তনই জম্মুতে সাম্প্রতিক আক্রমণগুলির একটা বড় কারণ। ওই অফিসার বলছেন, “কাশ্মীরে একের পর এক সেনা-সক্রিয়তার কারণে একাধিক জঙ্গি খতম হয়েছে গত কয়েক মাসে। মনে করা হচ্ছে, সে জন্যই এবার জম্মুর দিকে সরে যাচ্ছে তারা। কাশ্মীরের পরিবেশ খানিকটা ভাল হয়ে উঠতে শুরু করেছিল, ফলে নজরদারি সামান্য আলগা হয়েছিল। সেটারই সুযোগ নিয়েছে জঙ্গিরা। জম্মুতে অনুপ্রবেশের রুটগুলি নতুন করে ব্যবহার করছে, ছোট ছোট দলে পাঠাচ্ছে সন্ত্রাসবাদীদের।” গোয়েন্দা তথ্য অনুসারে, কাশ্মীর উপত্যকায় ৩০ থেকে ৪০ জন জঙ্গি সক্রিয় রয়েছে বলে খবর। কিন্তু জম্মু অঞ্চলে সেই সংখ্যা আরও বেশি। পুঞ্চে প্রায় ১২ জন, রাজৌরিতে ১০ জন, ডোডায় ১৬ জন এবং উধমপুরে ৬ জন সক্রিয় রয়েছে এই মুহূর্তে। এই এত সংখ্যায় পাক জঙ্গিকে রোখা অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। বর্ষার আগে আরও অনুপ্রবেশ হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ওই অফিসার। বিগত ২০২১ সালের জুন মাসে প্রথম জম্মু থেকে হামলার খবর এসেছিল। ছোট ড্রোনের মাধ্যমে আইইডি বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছিল। এর পরে ২০২৩ সালের এপ্রিলে পুঞ্চ জেলায় সেনাবাহিনীর গাড়িতে গুলি চালায় জঙ্গিরা, শহিদ হন ৫ সেনা। মে মাসে ফের নিহত হন ৫ সেনা। পরপর আঘাতে ওই এলাকায় দুর্বল হয়ে পড়েছিল সেনাবাহিনী। ২০২০ সালে লাদাখে চীনের সঙ্গে ভারতের যে সংঘর্ষ শুরু হয়, সেখানে বড় সংখ্যক সেনা মোতায়েন করা হয়েছিল। ফলে জম্মুর একাধিক গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে সেনা উপস্থিতি বেশ কমে গেছিল। জঙ্গিদের এতে বড়ই সুবিধা হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। সূত্রের খবর, একটু আলগা পেয়েই জম্মুতে নিজেদের সংগঠনকে জোরালো করে তোলার চেষ্টা করেছে জঙ্গিরা। কাশ্মীর থেকে শিফ্ট করেছে অনেকে। এই কারণেই গত কয়েক বছরে রাজৌরি, পুঞ্চ, রিয়াসি, কাঠুয়ার মতো এলাকায় জঙ্গি হামলা এত বেড়েছে। তার উপর রয়েছে প্রযুক্তির বড় বদল। উক্ত অফিসারের কথায়, “নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের উপায় অনেক বদল এনেছে জঙ্গিরা। নিজেদের মোবাইল ব্যবহার করছে না তারা, ওয়্যারলেস স্যাটেলাইট ফোনও ব্যবহার করছে না। গ্রামবাসীদের মধ্যে মিশে গিয়ে, তাদেরই ফোনে টেলিগ্রাম বা সিগন্যালের মতো অ্যাপ ইনস্টল করে, পাকিস্তানে সরাসরি যোগাযোগ করছে তারা। ফলে ডিজিটাল ইনটেল মেলা খুবই কঠিন হয়ে উঠেছে।” অর্থাৎ, জম্মুকে নিরাপদ ভেবে উদাসীন হওয়ার জন্যই আক্রমণপ্রবণ হয়ে উঠেছে এই অঞ্চল। গোয়েন্দা ও সেনা ব্যর্থতার কথাই উঠে আসছে এই পরপর জঙ্গি হামলার পিছনে। ইতিমধ্যেই প্রবল সমালোচনার মুখে পড়েছে তারা।