আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের আগে ফের নতুন দুশ্চিন্তা মাথাচাড়া দিল পদ্মশিবিরের অন্দরে। প্রসঙ্গত, গত পাঁচ বছরে কোন রাজনৈতিক দল কোন শিল্প সংস্থার থেকে কত টাকা চাঁদা পেয়েছে, তা মার্চ মাসেই প্রকাশ্যে আসতে চলেছে। আর রাজনীতির কারবারিরা মনে করছেন, সুপ্রিম কোর্টের এই রায়ের পরে বিজেপিই সব থেকে অসুবিধায় পড়বে। কারণ, মোদী সরকার নির্বাচনী বন্ড চালু করার পর থেকে তার সব থেকে বেশি ফায়দা তুলেছে বিজেপিই, এমনটাই মনে করে বিরোধীরা। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, মোদী সরকার কি অধ্যাদেশ জারি করে সুপ্রিম কোর্টের এই রায় উল্টে দেওয়ার চেষ্টা করতে পারে? বিজেপি নেতৃত্ব তা নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাননি। দলের বক্তব্য, রায় পড়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করা হবে। যদিও ঘরোয়া ভাবে বিজেপির অনেক নেতাই স্বীকার করে নিচ্ছেন, সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্ত তাঁদের খুশি করেনি। বিজেপি নেতাদের একাংশের মতে, সরকারের উচিত, শীর্ষ আদালতের ওই সিদ্ধান্ত খারিজ করে অধ্যাদেশ আনা। যাতে আগের ব্যবস্থা বহাল থাকে। বিজেপি নেতা রবিশঙ্কর প্রসাদ যুক্তি দিয়েছেন, ‘‘সংস্কারমুখী পদক্ষেপ হিসেবে নির্বাচনী বন্ড এনেছিল সরকার। মূলত নির্বাচন প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনতে এবং নির্বাচনে নগদ টাকার ব্যবহার রুখতে ওই পদক্ষেপ করা হয়েছিল। তা ছাড়া, কিছু দাতা নিজেদের পরিচয় গোপন করার পক্ষে ছিলেন, তাঁদের কথা ভেবেই বন্ড নিয়ে এসেছিল সরকার।’’ মোদী সরকার নির্বাচনী বন্ড চালু করার পরে বিরোধী শিবির থেকে অভিযোগ উঠেছিল, সরকারে থাকার সুবাদে কর্পোরেট সংস্থাগুলিকে নানা সুবিধা পাইয়ে দিয়ে গোপনে তাদের থেকে চাঁদা আদায় করছে বিজেপি।
উল্লেখ্য, বিগত ২০১৭ সালের বাজেটে নির্বাচনী বন্ডের ঘোষণা হয়েছিল। ২০১৮-র জানুয়ারি মাসে নির্বাচনী বন্ড চালুর বিজ্ঞপ্তি জারি হয়। ২০১৭-১৮ থেকে ২০২২-২৩-এর মধ্যে মোট ১২,০০৮ কোটি টাকার নির্বাচনী বন্ড বিক্রি হয়েছে। এর প্রায় ৫৫ শতাংশ বা ৬,৫৬৪ কোটি টাকা বিজেপির সিন্দুকে ঢুকেছে। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী, বিজেপি-সহ সব দলকে এই কোটি কোটি টাকা চাঁদা কে দিয়েছে, ১৩ই মার্চের মধ্যেই তা প্রকাশ্যে আনবে নির্বাচন কমিশন। নির্বাচনী বন্ডের বিরুদ্ধে মামলার অন্যতম আইনজীবী কপিল সিব্বলের দাবি, এতে বিজেপির মুখোশ খুলে যাবে। কারণ, কেউ বিনা কারণে বিজেপিকে কোটি কোটি টাকা দেয়নি। একই মত পি চিদম্বরমের। তাঁর বক্তব্য, ‘‘বিজেপি কর্পোরেট ও বড়লোকদের চাঁদার ৯০ শতাংশ নিজের ঝুলিতে পুরেছিল। সবাই জানুক, কবে, কাকে চাঁদা দেওয়া হয়েছে। তার পরে মানুষ জানতে চাইবেন, কেন এই চাঁদা দেওয়া হয়েছে। তার পরে মানুষই সিদ্ধান্ত নেবেন।’’ তবে নির্বাচনী বন্ড তুলে দেওয়ার পরেও সব রাজনৈতিক দলের কাছে সমান চাঁদা পাওয়ার সুযোগ তৈরি হল কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। সব দল লড়াইয়ের ময়দানে সমান সুযোগ পেল কি না, তা নিয়েও দেখা দিয়েছে সংশয়।
এপ্রসঙ্গে প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী, কংগ্রেসের রাজ্যসভা সাংসদ চিদম্বরমের মতে, এত দিন শাসকদল বাড়তি সুবিধা পাচ্ছিল। এ বার সব দল সমান সুযোগ পাবে। কিন্তু তাঁর ছেলে, লোকসভা সাংসদ কার্তি চিদম্বরমের মতে, বিজেপি নির্বাচনী বন্ডের চাঁদার বেশির ভাগই পকেটে পুরে ফেলল। তা হলে আর সমান সুযোগ কোথায় হল? ২০১৭-১৮ থেকে ২০২২-২৩-এর মধ্যে যত টাকার নির্বাচনী বন্ড বিক্রি হয়েছে, তার মাত্র ৯.৫ শতাংশ, বা ১,১৩৫ কোটি টাকা কংগ্রেস পেয়েছে। আঞ্চলিক দল হলেও তৃণমূল পেয়েছে ১,০৯৬ কোটি টাকা। সুপ্রিম কোর্টে অন্যতম মামলাকারী সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরির বক্তব্য, ‘‘কে বন্ডের মাধ্যমে কাকে কত টাকা চাঁদা দিয়েছে, তা প্রকাশ্যে এলে শাসকদলগুলির গোপন আঁতাঁত প্রকাশ্যে আসবে।’’ তৃণমূলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষের বক্তব্য, ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বার বার নির্বাচনী সংস্কারের দাবি করেছেন। কোথা থেকে টাকা আসছে, দলের অর্থের উৎস কী, তা মানুষকে জানাতে হবে।’’ আজ সুপ্রিম কোর্ট রায় ঘোষণা করার পরেই মামলার অন্যতম আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণ এজলাসের মধ্যেই রায়কে সাধুবাদ জানান। এতে দেশের রাজনীতিতে স্বচ্ছতা আসবেই আশাবাদী তিনি।