১৯৩৩ সালে জার্মানির নির্ণায়ক নির্বাচনের ঠিক দু’সপ্তাহ আগে নিজের অন্যতম সহযোগী তথা রাইখস্ট্যাগের প্রেসিডেন্ট হেরম্যান গোয়েরিং-এর বার্লিনের বাসভবনে দেশের সবচেয়ে ধনী ২৪ শিল্পপতির সামনে দাঁড়িয়ে হিটলার তাঁর ৯০ মিনিটের ভাষণে বলেছিলেন, কেবল জার্মান জাতির স্বার্থেই নয়, শিল্পপতিদের নিরঙ্কুশ মুনাফা লাভের জন্যও দরকার দেশের সার্বিক উন্নতির জন্য সমস্ত বিরোধী দলগুলিকে নিকেশ করে একচ্ছত্র ক্ষমতা দখল। তৎকালীন জার্মানির স্টিল টাইকুন, বণিক সংঘের চেয়ারম্যান গুস্তাফ ক্রুপ উঠে দাঁড়িয়ে হিটলারকে পূর্ণ সমর্থনের আশ্বাস দেন। এরপর অর্থনীতিবিদ জামলার স্কাক্ট নাৎসি কোয়ালিশনের সমর্থনে একটি ফান্ড গঠনের আহ্বান জানান শিল্পপতিদের কাছে। এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে ২০ মিলিয়ন ডলারের (বর্তমান মূল্যে) একটি নির্বাচনী ফান্ড তৈরি হয়। জার্মান শিল্পপতিদের সেই ফান্ড হিটলারকে ভোটে জিততে বিপুল সাহায্য করেছিল।
এর পরেই শুরু হয় চূড়ান্ত স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় আধিপত্য, ইহুদিদের নাগরিক অধিকার হরণ। ৬০ লক্ষ ইহুদিকে হত্যার পাশাপাশি সমস্ত বিরোধী দল, ট্রেড ইউনিয়নকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। মোদী জমানায় যেন প্রায় একই ঘটনা ঘটছে ভারতেও! ২০১৪-র সাধারণ নির্বাচনের আগে নরেন্দ্র মোদীকে বিজেপির মুখ হিসেবে তুলে ধরার জন্য ভারতীয় শিল্পপতিদের একাংশ বিপুল টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন। বছরে দু’কোটি বেকারের চাকরির ব্যবস্থা এবং বিদেশের ব্যাঙ্কে লুকিয়ে রাখা কালো টাকা ফেরত এনে প্রত্যেক ভারতীয়ের অ্যাকাউন্টে ১৫ লক্ষ টাকা দেওয়ার ‘জুমলা’ও দেওয়া হয়েছিল। এই অবাস্তব স্বপ্ন মানুষের মনে গেঁথে দেওয়ার জন্য কর্পোরেট-পোষিত সংবাদমাধ্যমের একাংশকে ব্যবহার করা হয়। বিগত পাঁচ বছরের শাসনকালে এই মোদি-সমর্থক কর্পোরেট-মিডিয়া লাগাতার প্রচার চালিয়ে গিয়েছে, মোদী জমানায় বিভিন্ন দিক থেকে ভারত নাকি এক অভূতপূর্ব বিকাশের মুখ দেখেছে। মোদীই ‘বিশ্বগুরু’।
যে প্রধানমন্ত্রী তাঁর ১০ বছরের রাজত্বকালে ৭৩ বার বিদেশভ্রমণে জাতীয় কোষাগারের কোটি কোটি টাকা খরচ করেছেন, কোনওরকম যুক্তি-তথ্যের ধার না ধরে কেবল মিথ্যা উন্মাদনা তৈরির মাধ্যমে তাঁকেই ভারতের একমাত্র পরিত্রাতা হিসেবে তুলে ধরছে একাংশের বৃহৎ মিডিয়া। কর্পোরেট-লবির এই একাংশ যে মোদী সরকারকে খুলে আম সমর্থন দিচ্ছে, তা নিশ্চয়ই বিনা কারণে নয়। বিগত দশ বছরে মোদী সরকার মূলত কাজ করেছে তাঁদের এই ঘনিষ্ঠ কর্পোরেট-লবি ও অতি-ধনী অংশের জন্য। বুগত দশ বছরে যেখানে অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা ৫০ শতাংশ মানুষের হাতে এসেছে জাতীয় সম্পদের মাত্র ৩ শতাংশ, সেখানে ওপরের দিকে থাকা ১০ শতাংশ মানুষের হাতে এই সম্পদের পরিমাণ ৬৬ শতাংশ। শুধু তাই নয়। গত দশ বছরে বিজেপি-ঘনিষ্ঠ কর্পোরেটদের ঋণ মকুব করা হয়েছে প্রায় ২৫ লক্ষ কোটি টাকা।
প্রসঙ্গত, মাথাপিছু আয়-বৃদ্ধির নিরিখে গত দশ বছরে ভারতের স্থান এতটাই নীচে নেমে গিয়েছে যে, এইমুহূর্তে আমাদের মাথাপিছু আয় পার্শ্ববর্তী বাংলাদেশেরও নীচে, যে বাংলাদেশকে এই সেদিনও পশ্চাৎপদ দেশ হিসেবে গণ্য করা হত। মোট ১৮০টি দেশের মধ্যে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবোন্নয়ন ও সামাজিক সূচকের নিরিখেও বিগত দশ বছরে ভারতের স্থান ক্রমশ তলানিতে ঠেকেছে। বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ভারতের স্থান এইমুহূর্তে ১১১তম। মানবোন্নয়ন সূচকে ১৩২তম। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার সূচকে ১৬১তম। অথচ অতি ধনীদের সংখ্যার দিক থেকে এইমুহূর্তে ভারতের স্থান উঠে এসেছে তৃতীয় স্থানে। আসলে মোদী ঘনিষ্ঠ পু্ঁজিপতিদের এই ‘ক্রোনি পুঁজি’ কর্মসংস্থান বা দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক বিকাশ ঘটায় না। বরং ক্ষমতাসীন দলকে চূড়ান্ত সমর্থন দিয়ে এই পুঁজি নিজের বল্গাহীন মুনাফা বৃদ্ধি ঘটায়। অর্থাৎ এর চরিত্র চরম অগণতান্ত্রিক ও বৈষম্যবাদী।