বড়সড় বিতর্কের মুখে সিপিএম। দীর্ঘ বাম-জমানার শেষ পর্যায়ে সিপিএমের বিরুদ্ধে বারবার ধেয়ে আসত ‘হার্মাদ’ শব্দটি। যে যে নেতাদের নাম উল্লেখ করে সেই শব্দবন্ধ ব্যবহার করা হত, তাঁদের খানিকটা পিছনেই সরিয়ে রেখেছিল দল। কিন্তু এবার দলের যুব সংগঠনের ‘ইনসাফ যাত্রা’র পুরোভাগে দেখা গেল সেই নেতা-নেত্রীদেরই। তাঁদের মধ্যে অন্যতম নেতাই গণহত্যা মামলায় আট বছরের বেশি সময় জেল খেটে আসা ডালিম পাণ্ডে, অনুজ পাণ্ডে, ফুল্লরা মণ্ডল। ইতিমধ্যেই এ নিয়ে চরমে তোলপাড়। উঠেছে বিতর্কের ঝড়। বাঁকুড়া থেকে সোমবার রাতে যাত্রা পৌঁছেছিল জঙ্গলমহলের লালগড়ে। ধরমপুরের যে সিপিএম জোনাল অফিস একদা জ্বলে গিয়েছিল গণরোষে, সেই পার্টি অফিসের সামনে রাত ৯টার সময়েও দেখা গিয়েছে ঠাসা ভিড়। সভায় ভাষণ দিয়েছেন যুব সম্পাদক মিনাক্ষী মুখোপাধ্যায়। একাধিক ভিডিয়োতে দেখা গিয়েছে, আদিবাসী মহিলারা মিছিলের সামনে উদ্দাম নাচছেন বাজনার তালে তালে। আর সেই মিছিলকে ফুল ছড়িয়ে অভ্যর্থনা জানিয়েছেন নেতাই মামলার অন্যতম অভিযুক্ত ফুল্লরা। ফুল্লরার গায়ে পাল্টা গাঁদার পাপড়ি ছড়িয়ে দিয়েছেন পদযাত্রীরা। মঙ্গলবার সকালে ধরমপুর থেকে যখন যাত্রা শুরু হয়, তখন মিছিলে হেঁটেছেন অনুজ পাণ্ডে। সদ্য পায়ে অস্ত্রোপচার হয়েছে। তাই বেশি পথ হাঁটতে পারেননি। তবে সর্বক্ষণ মিছিলে ছিলেন ডালিম পাণ্ডে।
প্রসঙ্গত, নেতাই গণহত্যা ঘটেছিল ২০১০ সালের ৭ই জানুয়ারি। সিপিএম নেতা রথীন দণ্ডপাটের বাড়ি থেকে গুলি চালিয়ে ন’জন গ্রামবাসীকে হত্যার অভিযোগে সিবিআই তদন্তের নির্দেশও দেওয়া হয়েছিল। সেই মামলায় গ্রেফতার হয়েছিলেন অনুজ, ডালিম, ফুল্লরারা। চলতি বছরের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে শর্তসাপেক্ষে জামিন পান তাঁরা। তার পরে গত বইমেলায় ফুল্লরাকে দিয়ে বইয়ের স্টল উদ্বোধন করিয়েছিল সিপিএমের ছাত্র সংগঠন এসএফআই। মহিলা সংগঠন বিভিন্ন জায়গায় তাঁকে নিয়ে গিয়ে সভা করিয়েছিল। সেই তিনিই ইনসাফ যাত্রায় মিনাক্ষীদের অভ্যর্থনা জানালেন। অনুজ পাণ্ডের প্রাসাদোপম বাড়ি ভাঙার দৃশ্য এখনও অনেকের কাছে টাটকা। সিপিএম অবশ্য বলছে, জেলে থাকার সময়ে ওঁদের অনেক ভাবে প্রলোভন দেখানো হয়েছিল। কিন্তু কেউ দল পাল্টাননি। প্রসঙ্গত, সিপিএমের মধ্যে এই আলোচনা ছিল যে, নেতাই মামলায় জেলবন্দিদের জন্য দল সে ভাবে লড়ছে না। আইন-আদালতে দলের যে তৎপরতা থাকা দরকার, তা নেই। কিন্তু দেখা যায়, সুশান্ত ঘোষ পশ্চিম মেদিনীপুরের জেলা সম্পাদক হওয়ার পরে তাতে নাড়াচাড়া পড়ে। যে সুশান্ত নিজে বেনাচাপড়া কঙ্কালকাণ্ডে জেলবন্দি ছিলেন। যিনি প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের বিরুদ্ধে ডায়েরি লিখে দল থেকে সাসপেন্ডও হয়েছিলেন। উল্লেখ্য, যে সময়ে নেতাইয়ের ঘটনা ঘটেছিল, তখনও লালগড় ছিল পশ্চিম মেদিনীপুরে। পরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জমানায় ঝাড়গ্রাম পৃথক জেলা হয়। আর বর্তমান নেতাই ঝাড়গ্রাম জেলার মধ্যে পড়ে।
উল্লেখ্য, সুশান্তের জেলা সম্পাদক হওয়াটাও সিপিএমের ইতিহাসে কার্যত মাইলফলক হয়ে রয়েছে। সিপিএমের অন্দরে সকলেই জানতেন, তৎকালীন রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র চাননি সুশান্ত জেলা সম্পাদক হোন। তাঁর পছন্দ ছিলেন তাপস সিংহ। কিন্তু জেলা সম্মেলনে ভোটাভুটিতে বিপুল ভাবে হেরে যানতাপস। অনেকে বলেন, সুশান্তকে জেলা সম্পাদক করতে বর্তমান রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিমের বড় ভূমিকা ছিল। সেই সুশান্তকেও বুধবার দেখা যেতে পারে ‘ইনসাফ যাত্রায়’। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে, কেন নতুন করে পুরনো লাইনে হাঁটতে চাইছে সিপিএম? এটা কি দলকে চাঙ্গা করার কৌশল? সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তী বলেন, ‘‘এখন তো দেখছি তৃণমূল বিজেপিকে হার্মাদ বলছে আর বিজেপি তৃণমূলকে! একটা শব্দ কী হতে পারে, তা এখন ওরাও বুঝছে। ফুল্লরা মণ্ডল, ডালিম পাণ্ডে, অনুজ পাণ্ডেদের অনেক চেষ্টা করেও, বছরের পর বছর জেল খাটিয়েও বশে আনতে পারেনি। তাঁরা মানুষের সঙ্গেই আছেন। তাই তাঁরা যে ইনসাফ যাত্রায় হাঁটবেন, পাশে থাকবেন এটাই স্বাভাবিক। এতে কারও গায়ে জ্বালা ধরলে কিছু করার নেই।’’ পাল্টা কটাক্ষ করেছেন কুণাল ঘোষ। ‘‘সিপিএম যত পুরনো রক্তাক্ত দিনের স্মৃতি উস্কে দেবে, তত ওদের ক্ষতি। তাই বলব, হার্মাদ হইতে সাবধান’’, তোপ তৃণমূল মুখপাত্রের।
