টাটার ন্যানো গাড়ির কারখানা গড়তে গায়ের জোরে সিঙ্গুরের চার ফসলি জমি অধিগ্রহণ করেছিল বামফ্রন্ট সরকার। কৃষকদের পাশে দাঁড়িয়ে যার বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিলেন বাংলার অগ্নিকন্যা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই সিঙ্গুর আন্দোলনই ৩৪ বছরের জগদ্দল পাথর সরিয়ে মমতাকে ক্ষমতার অলিন্দ পৌঁছে দিয়েছিল। পরবর্তীকালে সুপ্রিম কোর্টও এক ঐতিহাসিক রায় দিয়ে সিঙ্গুরের কৃষকদের জমি ফিরিয়ে দেয়। যদিও বামেদের সুরে সুর মিলিয়ে বিজেপিও এখন সিঙ্গুর নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী ও শাসক দল তৃণমূলকে আক্রমণ শানিয়ে যাচ্ছে। তাদের দাবি, সিঙ্গুর থেকে টাটাদের চলে যাওয়া রাজ্যের শিল্পায়নের পথে বড় ধাক্কা। কিন্তু সম্প্রতি কেন্দ্রের রিপোর্টে এমনই এক তথ্য সামনে চলে এল, যা কার্যত সিঙ্গুর নিয়ে মমতা ও তৃণমূলের অবস্থানকেই সমর্থন করছে। যার ফলে স্বাভাবিকভাবেই অস্বস্তিতে গেরুয়া শিবির।
প্রসঙ্গত, দেশজুড়ে এখন নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের পাশাপাশি আনাজপাতি ও চাল, ডাল, গমের দামও হু হু করে বেড়ে চলেছে। আলু, আদা, টম্যাটোর মতো সবজি তো বটেই, দিনদিন দাম বাড়ছে চাল, ডাল, তেল, আটারও। এই পরিস্থিতিতে কী করে কমবে নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্যবস্তুর দাম, তা বুঝে উঠতে হিমশিম খাচ্ছে কেন্দ্র। কৃষি, খাদ্য, উপভোক্তা বিষয়ক, অর্থমন্ত্রকের আধিকারিকরা ঘনঘন বৈঠক করছেন। কেন্দ্রের রিপোর্ট বলছে, এই দামবৃদ্ধির নেপথ্যে রয়েছে চাহিদার তুলনায় কম জোগান এবং কেন্দ্রের এক আইন যা কার্যত খাদ্যবস্তুর হোর্ডিং বা মজুতদারি বাড়িয়ে দিয়েছে। অথচ সেই আইনের দৌলতে যে এমন একতা পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে সেটা মমতা দেড় দুই বছর আগেই জানিয়ে দিয়েছিলেন। এমনকি সেই আইন যাতে প্রত্যাহার করা হয় তার জন্য বার বার কেন্দ্রকে অনুরোধ করার পাশাপাশি রাজনৈতিক ভাবেও সরব হন।
কিন্তু তখন মমতা ও বাংলাকে ‘টাইট’ দেওয়ার লক্ষ্যে মোদী সরকার ও বিজেপি তাতে কর্ণপাত করেনি। কিন্তু এখন সেই আইনের মাসুল গুনছে গোট দেশ এবং গেরুয়া শিবিরও। এর পাশাপাশি কেন্দ্রের রিপোর্ট একথাও বলছে, দেশে আনাজপাতি সহ চাল, ডাল, তেল, আটার দাম বৃদ্ধির নেপথ্যে রয়েছে তার কম উৎপাদন, আর সেই কম উৎপাদন হচ্ছে চাষের জন্য ক্রমশ জমি কমে যাওয়ায়। কেন্দ্রের রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০২২ সালে এই সময়ে খরিফ মরশুমে ধান চাষের এলাকা ছিল ১৩১ লক্ষ হেক্টর। এবার তা ১২৩ লক্ষ হেক্টর। মুগ, বিউলি, অড়হরের মতো ডালের ক্ষেত্রেও কমেছে চাষের এলাকা। গতবার এই সময়ে চাষ হয়েছিল ৭৭ লক্ষ হেক্টর জমিতে। এবার ৬৬ লক্ষ। গতবারের চেয়ে খরিফে এখনও পর্যন্ত ৯.৭৭ লক্ষ হেক্টর কম জমিতে খাদ্যশস্যের চাষ হচ্ছে। গতবার এই সময়ে ৬০৮.২ লক্ষ হেক্টরে চাষ হয়েছিল। এবার তা ৫৯৮.৪৩ লক্ষ হেক্টর।
স্বাভাবিক ভাবেই চাষের এলাকা কমলে উৎপাদনও হবে কম। আর উৎপাদন কম হলে জিনিসের দাম বাড়বেই। তাই মোদি সরকার এখন হাজার চেষ্টা করলেও দাম নিয়ন্ত্রণে আনতে পারবে না। অর্থনীতিবিদ থেকে কৃষি বিশেষজ্ঞরা বার বার বলেছেন, আকাশে শিল্প বা বাড়ি তৈরি হয় না ঠিকই। কিন্তু তা ২,৩ বা ৪ ফসলি জমির ওপর তৈরি করাও ঠিক নয়। তা করতে হবে অনুর্বর, পতিত বা এক ফসলি জমিতে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে ২, ৩ বা ৪ ফসলি জমির ওপর তা তৈরি হচ্ছে আর মার খাচ্ছে কৃষিকাজ। দেশের জনসংখ্যা বাড়ছে, সেই অনুপাতে বাড়ছে খাদ্যের চাহিদাও। সেই খাদ্য যদি উৎপাদনই না হয় তাহলে তার দাম কমবে কীভাবে? এই কথাটাই কিন্তু সিঙ্গুর আন্দোলনের সময় থেকে বারবার বলে এসেছেন মমতা। তিনি কখনই শিল্পের বিরোধী ছিলেন না। শুধুমাত্র কৃষকদের কাছ থেকে জোর করে ও ৪ ফসলি জমির অধিগ্রহণের বিরোধিতা করেছিলেন। সিঙ্গুর এখনও ৪ ফসলি কৃষি জমি সমৃদ্ধ এলাকা।