রীতিমতো রুদ্ধশ্বাস হয়ে রইল এবছরের উইম্বলডন ফাইনাল। দীর্ঘ ৪ ঘণ্টা ৪২ মিনিটের লড়াইয়ের পর ঘটল নিষ্পত্তি। নোভাক জোকোভিচের বিজয়রথ থামালেন তরুণ প্রতিভা কার্লোস আলকারাজ। রবিবার প্রথম সেট হেরে গেলেও দুরন্তভাবে ফিরে এলেন তিনি। পাঁচ সেটের লড়াইয়ে জোকোভিচকে হারিয়ে নিজের দ্বিতীয় গ্র্যান্ড স্ল্যাম জিতলেন স্পেনের খেলোয়াড়। মাস দেড়েক আগেই ফরাসি ওপেনের সেমিফাইনালে জোকোভিচের কাছে হেরেছিলেন। সেই হারের বদলা নিলেন আলকারাজ। টানা চার বার জেতার পরে পঞ্চম বারে হারতে হল জোকোভিচকে। রজার ফেডেরারের আট উইম্বলডনের নজির ছুঁতে পারলেন না ‘জোকার’। উইম্বলডনে টানা ২৮ ম্যাচ অপরাজিত ছিলেন তিনি। শেষ হেরেছিলেন ২০১৭ সালের কোয়ার্টার ফাইনালে টমাস বার্ডিচের কাছে। টানা পাঁচ বার উইম্বলডন জিতে রজার ফেডেরারকে ছুঁয়ে ফেলার সুযোগ ছিল সার্বিয়ার তারকার সামনে। অন্যদিকে চলতি বছর ভাল খেললেও গ্র্যান্ড স্ল্যাম জিততে পারেননি আলকারাজ। মাস দেড়েক আগে ফরাসি ওপেনের সেমিফাইনালে জোকোভিচের বিরুদ্ধে চোট ভুগিয়েছিল তাঁকে। তবে এই ম্যাচে তার পুরনাবৃত্তি ঘটল না।
এদিন বারবার সমস্যায় পড়েন জোকোভিচ। গোটা ম্যাচে অন্তত চার বার পিছলে পড়লেন তিনি। তাতে বড় চোট লাগতে পারত তাঁর। পড়লেন আলকারাজও। হাওয়ার জন্যও সমস্যা হচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত ৪ ঘণ্টা ৪২ মিনিটের লড়াইয়ে ১-৬, ৭-৬ (৮-৬), ৬-১, ৩-৬, ৬-৪ গেমে ৩৬ বছরের জোকোভিচকে হারালেন ২০ বছরের আলকারাজ। বিশ্বের এক নম্বর খেলোয়াড় হলেও গ্র্যান্ড স্ল্যাম ফাইনালে স্নায়ুর চাপ ধরে রাখা কঠিন ছিল আলকারাজের পক্ষে। অন্তত প্রথম সেটে সেটাই দেখা গেল। নইলে কেন খেলার শুরুটা নিজে না করে জোকোভিচকে করতে দিলেন তিনি! প্রথম গেমেই জোকোভিচের সার্ভিস ভাঙার সুযোগ পেয়েছিলেন আলকারাজ। কিন্তু পারলেন না। দ্বিতীয় গেমে আবার নিজের সার্ভিস ধরে রাখতে সমস্যায় পড়লেন স্পেনের খেলোয়াড়। তাঁর সার্ভিস ভেঙে ২-০ এগিয়ে গেলেন জোকার। আলকারাজের পরের সার্ভিসও ভেঙে দিলেন জোকোভিচ। দেখে বোঝা যাচ্ছিল, কতটা চাপের মধ্যে রয়েছেন আলকারাজ। তাঁর মনোবল বাড়ানোর চেষ্টা করল গোটা সেন্টার কোর্ড। আলকারাজ প্রতিটি পয়েন্টে হাততালি দিলেন ব্র্যাড পিট, ড্যানিয়েল ক্রেগের মতো হলিউড তারকা। তার পরেও প্রথম সেটে মাত্র একটি গেম জিতলেন আলকারাজ। ৬-১ প্রথম সেট জিতে নিলেন জোকার। মাত্র ৩৪ মিনিট সময় নিলেন তিনি।
এরপর দ্বিতীয় সেটে ছন্দে ফিরলেন আলকারাজ। দ্বিতীয় গেমেই জোকোভিচের সার্ভিস ভেঙে দিলেন তিনি। চতুর্থ গেমে আলকারাজের সার্ভিস ভেঙে খেলায় ফিরলেন জোকোভিচ। পরের কয়েকটি গেমে দু’জনেই নিজেদের সার্ভিস ধরে রাখেন। ফলে খেলা গড়ায় টাইব্রেকারে। সেখানেও একটা সময় ৫-৪ এগিয়ে ছিলেন জোকোভিচ। ঠিক সেই মুহূর্তে সময়ের মধ্যে সার্ভিস না করার জন্য জোকোভিচকে সতর্ক করেন চেয়ার আম্পায়ার। সেই কারণে হয়তো কিছুটা হলেও মনঃসংযোগে ব্যাঘাত হয় জোকারের। কারণ, পরের তিনটি পয়েন্টে সহজ শট মারতে গিয়ে ভুল করে বসেন নোভাক। তার সুবিধা পান আলকারাজ। ৮-৬ টাইব্রেকার জিতে দ্বিতীয় সেট জিতে যান তিনি। তৃতীয় সেটের শুরু থেকে আরও আত্মবিশ্বাসী খেলা শুরু করলেন আলকারাজ। ছন্দ হারাচ্ছিলেন জোকোভিচ। সেন্টার কোর্টে হাওয়া কিছুটা সমস্যায় ফেলছিল তাঁকে। কয়েকটি শটে নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারেননি সার্বিয়ার তারকা। অন্য দিকে প্রথম দুই সেটে ড্রপ শট সমস্যায় ফেলছিল আলকারাজকে। এই ড্রপ শটই তাঁর শক্তি। কিন্তু হাওয়ার কারণে কিছুতেই ঠিক ঠাক জায়গায় মারতে পারছিলেন না। বার বার নেটে গিয়ে লাগছিল। তৃতীয় সেট থেকে ড্রপ শট ঠিক মতো মারতে শুরু করলেন আলকারাজ। প্রথম গেমেই জোকোভিচের সার্ভিস ভেঙে দেন আলকারাজ। তার পর নিজের সার্ভিস ধরে রাখেন। চতুর্থ গেমে জোকারের কাছে সুযোগ ছিল আলকারাজের সার্ভিস ভাঙার। কিন্তু পারেননি তিনি। প্রতিটি গেমে লম্বা র্যালি খেলা শুরু করেন তাঁরা। প্রথম দুই সেটে জোকোভিচ সার্ভিস করছিলেন আলকারাজের ব্যাকহ্যান্ড লক্ষ্য করে। তার ফলে সমস্যায় পড়ছিলেন আলকারাজ। কিন্তু তৃতীয় সেট থেকে অনেক বেশি আলকারাজের ফোরহ্যান্ডে সার্ভিস শুরু করেন জোকোভিচ। ফলে রিটার্ন করতে সুবিধা হচ্ছিল আলকারাজের। জোকোভিচের ভুলের সুযোগ নিচ্ছিলেন তিনি। প্রথম সেটে জোকোভিচ যে ভাবে দাপট দেখিয়ে জিতেছিলেন, তৃতীয় সেটে সেটাই করলেন স্পেনীয় তারকা।
এরপর ম্যাচের সব থেকে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হল তৃতীয় সেটের পঞ্চম গেমে। ২৬ মিনিট ধরে চলল একটি গেম। ৩২টি পয়েন্টের খেলা হল। প্রথম সার্ভিসে বার বার সমস্যা হচ্ছিল জোকোভিচের। তার ফলে পয়েন্ট তুলতে পারছিলেন না তিনি। এক বার জোকোভিচ এগোচ্ছিলেন তো পরের পয়েন্টেই আলকারাজ এগিয়ে যাচ্ছিলেন। গোটা গেমে ১৩ বার ডিউস (৪০-৪০) হয়। সেই গেমেই আরও এক বার সময় নষ্টের জন্য জোকোভিচকে সতর্ক করেন আম্পায়ার। সেই সময় আম্পায়ারের সঙ্গে তাঁর কিছুটা তর্ক হয়। টানা র্যালি হওয়ায় কিছুটা ক্লান্ত দেখাচ্ছিল জোকোভিচকে। কিন্তু কেউ হাল ছাড়ছিলেন না। সাত বার ব্রেক পয়েন্ট পান আলকারাজ। শেষ পর্যন্ত জোকোভিচের সার্ভিস ভেঙে এগিয়ে যান আলকারাজ। তার পরে আর সেই সেটে রোখা যায়নি আলকারাজকে। জোকোভিচের পরের সার্ভিস ভেঙে ৬-১ সেট জিতে এগিয়ে যান তিনি। তৃতীয় সেটের পরে সাত মিনিটের একটি বিরতি নেন জোকোভিচ। ফরাসি ওপেনের সেমিফাইনালেও দ্বিতীয় সেটের পরে বিরতি নিয়েছিলেন তিনি। তত ক্ষণে আলকারাজের বিরুদ্ধে খেলা ১-১ ছিল। পরের দু’টি সেট জিতে ম্যাচ জিতে যান জোকার। এ বারেও তাঁর সমর্থকেরা আশা করেছিলেন, তেমনই কিছু চমৎকার দেখাবেন জোকোভিচ। ফিরে এসে শুরুটা সে রকমই করলেন। চতুর্থ সেটের পঞ্চম গেমে আলকারাজের সার্ভিস ভাঙলেন তিনি। সেই সেটে আর জোকোভিচের সামনে দাঁড়াতে পারেননি আলকারাজ। নবম গেমে আবার তাঁর সার্ভিস ভেঙে ৬-৩ সেট জিতে যান তিনি। শেষ তথা পঞ্চম সেটে গড়াল খেলা। নির্ণায়ক সেটে দ্বিতীয় গেমেই আলকারাজের সার্ভিস ভাঙার সুযোগ পেয়েছিলেন জোকোভিচ। ঠিক মতো ভলি মারতে পারলেই এগিয়ে যেতেন তিনি। কিন্তু সোজা নেটে সেই ভলি মারলেন জোকার। সুযোগ পেয়ে নিজের সার্ভিস ধরে রাখলেন আলকারাজ। কিন্তু জোকোভিচ নিজের সার্ভিস ধরে রাখতে পারলেন না। বোঝা যাচ্ছিল, খেলা থেকে ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছেন জোকোভিচ। মানসিক ভাবেও কোথাও একটা সমস্যা হচ্ছিল তাঁর। শেষ পর্যন্ত ৬-৪ ব্যবধানে সেট পকেটে পুরে নেন আলকারাজ। সেইসঙ্গে জিতে নেন জীবনের দ্বিতীয় গ্র্যান্ড স্ল্যাম তথা প্রথম উইম্বলডন খেতাব।