রাজ্যের চার জেলা— ঝাড়গ্রাম, পশ্চিম মেদিনীপুর, বাঁকুড়া এবং পুরুলিয়ার ২৩টি ব্লক নিয়েই জঙ্গলমহল। মিথ ছিল যে এই এলাকায় কুড়মিদের হাতেই রয়েছে জয়ের চাবিকাঠি। আর তাতে বিশ্বাস করে প্রায় সব রাজনৈতিক দলই কুড়মি জনজাতির নেতাকে প্রার্থী করে গিয়েছেন এ যাবৎকাল পর্যন্ত হয়ে আসা নির্বাচনে। শাসক থেকে বিরোধী— সমস্ত দলের নেতৃত্বই কুড়মি নেতাদের দেখানো পথে পা বাড়ানো ছাড়া কিছু ভাবতেই পারতেন না। কিন্তু এবারে সেই কুড়মিরাই আলাদা ভাবে পঞ্চায়েতের ভোটযুদ্ধে নেমেছিল। আর সেই ভোটই সব কিছু ওলটপালট করে দিল। অশান্তির বিরুদ্ধে, মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে, অবরোধ বিক্ষোভের নামে হয়রানি আর ভোগান্তি ঠেকাতে তাদের পরিবর্তে জঙ্গলমহলের বাসিন্দারা বেছে নিলেন বাংলার মেয়েকেই যিনি তাঁদের লক্ষ্মীর ভাণ্ডার দিয়েছে, খাদ্যসাথী দিয়েছেন, সবুজসাথী দিয়েছেন, স্বাস্থ্যসাথী দিয়েছে, কন্যাশ্রী দিয়েছে, রূপশ্রী দিয়েছেন, জয় জোহর দিয়েছেন।
প্রসঙ্গত, হাওয়াটা বেশ জোরদার ভাবেই উঠেছিল। বস্তুত বেশ ছক কষে সেই হাওয়াটা ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। সবটাই ছিল গেরুয়া শিবিরের ছক। দিনের পর দিন ধরে চলছিল রাস্তা অবরোধ, ট্রেন অবরোধ। আর সবটাই তৃণমূলের বিরুদ্ধে। রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে। এমন একটা হাওয়া তুলে দেওয়া হয়েছিল যেন জঙ্গলমহল জুড়ে তীব্র বিক্ষোভ চলছে। মানুষ খেতে পারছে না। পরণের কাপড় জুটছে না। ছেলেমেয়েরা স্কুলে যেতে পারছে না। তরুণ-তরুণীদের হাতে কাজ নেই। কিন্তু এত কিছু করেও শেষরক্ষা আর হল না। জঙ্গলের জনতাই কার্যত তা হতে দিলেন না। জঙ্গলমহলে মাত্র ৪টি গ্রাম পঞ্চায়েত গিয়েছে তাদের দখলে। জঙ্গলের জনতাই তাঁদের চূড়ান্ত ভাবে প্রত্যাখান করেছে। আর যেহেতু কুড়মিরা নিজেরা প্রার্থী দিয়েছিল নিজেদের মতো করে তাই কুড়মি ভোট না পেয়ে মুখ থুবড়ে পড়েছে বাম, বিজেপি আর কংগ্রেস।
পরিসংখ্যান বলছে, পুরুলিয়ায় কুড়মি অধ্যুষিত ১৩০০টি গ্রাম রয়েছে। তার মধ্যে ৪০০ গ্রামে কুড়মি সমর্থিত নির্দল ছিল। তার মধ্যে ২০০ গ্রামে প্রার্থীরা জিতেছে। সম্পূর্ণভাবে ওই ১৩০০ গ্রামে কুড়মি সমর্থিত নির্দল থাকলে ফল আরও অনেক ভালো হতো। যদিও পুরুলিয়ায় ৩৫ শতাংশ কুড়মি ভোটার রয়েছে। ঝাড়গ্রামে আছে ৩৬ শতাংশ কুড়মি ভোট। অথচ কুড়মিদের প্রাপ্তি থেমে গিয়েছে দুই জেলায় মাত্র ২টি করে গ্রাম পঞ্চায়েত দখল করেই। অন্যদিকে, কুড়মিদের ওপর নির্ভরশীন না থেকে তৃণমূল সর্বত্রই জয়ের মুখ দেখেছে। কুড়মি সমাজের নেতারা এখন মানছেন, তাঁদের ভুল পথে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল। সব থেকে বড় ভুল ছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে কুৎসা ছড়িয়ে বেড়ানো। ভুল ছিল রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করা। জঙ্গলের জনতা ভাল আছেন মমতা জমানায়। তাঁরা নতুন করে আর জঙ্গলে আগুন লাগাতে চান না। তাই কুড়নিরা যে আগুন নিয়ে খেলেছেন তা সজোরে প্রত্যাখান করেছেন তাঁরা।