বিজেপির তোলা যাবতীয় দুর্নীতির অভিযোগ, কুৎসা উড়িয়ে দিয়ে পঞ্চায়েত ভোটে রাজ্যের সর্বত্র উঠেছে সবুজ ঝড়। আবারও ভরাডুবি হয়েছে গেরুয়া শিবিরের। চব্বিশের লোকসভা নির্বাচনের আগে যা বঙ্গ বিজেপির জন্য অশনি সংকেত। রাজনৈতিক মহলের একাংশ বলছেন, পঞ্চায়েতের চেয়েও পদ্ম সাংসদদের বেশি চিন্তিত হওয়া উচিত নিজেদের এলাকায় দলের ফলাফল নিয়ে। সেই ফল যা বলছে, তাতে দলের কোনও সাংসদের এলাকাতেই বিজেপি উল্লেখযোগ্য ভাল ফল করতে পারেনি। মন্দের ভাল জগন্নাথ সরকার এবং সৌমিত্র খাঁ। তাঁদের দু’টি আসন যথাক্রমে রানাঘাট এবং বিষ্ণুপুরে বিজেপি তা-ও খানিকটা মানরক্ষা করেছে। খুব খারাপ ফলাফলের তালিকায় আছেন রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার, প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ, লকেট চট্টোপাধ্যায়। ‘কঠিন পরিস্থিতি’ নিশীথ প্রামাণিক, জন বার্লা, শান্তনু ঠাকুর, সুভাষ সরকারের।
রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারের বালুরঘাট আসনের পুরোটা দক্ষিণ দিনাজপুরের মধ্যে নয়। কিছুটা শহর এলাকাও রয়েছে। তবে গ্রামীণ ভোটই বেশি। পঞ্চায়েতের ফল বলছে, নিজেদের দখলে থাকা লোকসভা আসন হিসাবে ফল ভাল হয়নি। গ্রাম পঞ্চায়েতে দলের উপস্থিতি থাকলেও পঞ্চায়েত সমিতিতে তেমন সাফল্য নেই। জেলা পরিষদে কোনও আসনেই জয় মেলেনি। অন্যদিকে, প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি এবং বর্তমান সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি দিলীপ ঘোষের আসন মেদিনীপুরেও পঞ্চায়েত ভোটের ফল তথৈবচ। পঞ্চায়েত সমিতির মোট ২১২ আসনের মধ্যে তৃণমূলের দখলে ১৯৯। বিজেপির ১১। পঞ্চায়েত সমিতির সবগুলিই তৃণমূলের দখলে। গ্রাম পঞ্চায়েতের মোট আসন ১৩২৬টি। তার মধ্যে তৃণমূল জিতেছে ১০৪৭টি। বিজেপি ২১৭টি। সাংসদ দিলীপের এলাকায় জেলা পরিষদের কোনও আসন পায়নি বিজেপি।
নিশীথ প্রামাণিক এখন কেন্দ্রের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী। তাঁর জেলা কোচবিহারে জেলা পরিষদ দখল করা যাবে বলে আশা ছিল বিজেপির। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দলের ফল করুণ। জেলা পরিষদের ৩৪টি আসনের মধ্যে কোচবিহার লোকসভা এলাকায় ২৩টি। তার মধ্যে তৃণমূলের দখলে ২২টি আসন। নিশীথের দলের দখলে মাত্র একটি। মাথাভাঙ্গা ২ নম্বর ব্লকের জেলা পরিষদের ৬ নম্বর আসনটি জিতেছে বিজেপি। কোচবিহার জেলা পরিষদেও মাত্র দু’টি আসন জিতেছে তারা। আলিপুরদুয়ারের সাংসদ জন বার্লাও এখন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। সংখ্যালঘু মন্ত্রকের প্রতিমন্ত্রীর জেলাতেও বিজেপি খুব ভাল ফল করবে বলে আশা করেছিল। মনে করা হয়েছিল জেলা পরিষদের দখল মিলবে। কিন্তু বাস্তবে ৪টি গ্রাম পঞ্চায়েতই শুধু দখলে। কোনও পঞ্চায়েত সমিতি মেলেনি। বিরোধীশূন্য জেলা পরিষদের ১৮টি আসনই তৃণমূলের দখলে।
কেন্দ্রের জাহাজ প্রতিমন্ত্রী শান্তনু ঠাকুর শুধু মতুয়া অধ্যুষিত বনগাঁর সাংসদ নন। তিনি মতুয়া মহাসঙ্ঘের প্রধানও। তাঁর এলাকায় মতুয়া অধ্যুষিত বিধানসভা চারটি। বনগাঁ উত্তর, বনগাঁ দক্ষিণ, বাগদা এবং গাইঘাটা। এই চারটি বিধানসভায় জেলা পরিষদের ৯ আসনের সবক’টিই জিতেছে তৃণমূল। পঞ্চায়েত সমিতির ১২৪টি আসনের মধ্যে ১১২টি তাদের দখলে গিয়েছে। আর এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সুভাষ সরকারের বাঁকুড়া লোকসভা এলাকায় মাত্র একটি পঞ্চায়েতে জয় পেয়েছে বিজেপি। মেলেনি কোনও পঞ্চায়েত সমিতি, জেলা পরিষদের আসন। হুগলির সাংসদ লকেট চট্টোপাধ্যায়ের এলাকায় বলাগড়, পান্ডুয়া, চুঁচুড়া, মগড়া, পোলবা-দাদপুর, ধনিয়াখালি, সিঙ্গুর ছ’টি পঞ্চায়েত সমিতিই তৃণমূল দখল করেছে। ২৫৪টি পঞ্চায়েত সমিতির আসন। বিজেপি জিতেছে ৬টিতে। জেলা পরিষদের ১৮টি আসনের সবগুলিই তৃণমূলের। জেলা পরিষদের ৫৩ আসনের মধ্যে বিজেপি দু’টি জিতলেও তা লকেটের এলাকায় নয়।
রায়গঞ্জের সাংসদ তথা প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী দেবশ্রী চৌধুরী এবার রাজ্য বিজেপির পঞ্চায়েত নির্বাচন পরিচালন কমিটির শীর্ষে ছিলেন। কিন্তু তাঁর নিজের লোকসভা এলাকায় দলের ফলই ‘হতাশাজনক’। উত্তর দিনাজপুর জেলার দুটি মহকুমা রায়গঞ্জ ও ইসলামপুর এলাকার মধ্যে একমাত্র রায়গঞ্জ, কালিয়াগঞ্জ, হেমতাবাদ, করণদিঘি এলাকায় বিজেপির ফলাফল আগের বারের থেকে আসনের সংখ্যার নিরিখে সামান্য হলেও বেড়েছে। কিন্তু চোপড়া, ইসলামপুর, গোয়ালপুকুর, চাকুলিয়া এলাকায় সে ভাবে খাতাই খুলতে পারেনি গেরুয়া শিবির। গোটা জেলায় ৯৮টি গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে বিজেপি পেয়েছে ন’টি। আর ন’টি পঞ্চায়েত সমিতির সবক’টিই দখল করেছে তৃণমূল। জেলা পরিষদ তো বিরোধীশূন্য। আবার জয়ন্তকুমার রায়ের জলপাইগুড়িতে ডাবগ্রাম ফুলবাড়ি, সদর, মেখলিগঞ্জ সর্বত্রই হেরেছে দল। গোটা জেলায় বিজেপির ঝুলিতে ৮টি গ্রাম পঞ্চায়েত। কোনও পঞ্চায়েত সমিতি বা জেলা পরিষদের আসনেই জয় মেলেনি।
দার্জিলিংয়ে পঞ্চায়েত নির্বাচন ছিল দু’টি স্তরে। স্বশাসিত জিটিএ থাকায় এখানে জেলা পরিষদ নেই। পাহাড়ের ফল নিয়ে বিজেপির খুব আশাও ছিল না। ২৩ বছর পরে পাহাড়ের পঞ্চায়েত নির্বাচনে বিজেপি জোট গড়েছিল জনমুক্তি মোর্চা, জিএনএলএফ, হামরো পার্টির সঙ্গে। অন্য দিকে, তৃণমূলের সঙ্গে ছিল অনীত থাপার প্রজাতান্ত্রিক মোর্চা। দার্জিলিংয়ের ৫৯৮টি গ্রাম পঞ্চায়েতে অনীতের প্রজাতান্ত্রিক মোর্চা একাই দখল করেছে ৩৪৯টি আসন। পাঁচটি আসন জিতে গ্রামীণ দার্জিলিংয়ে খাতা খুলে ফেলেছে তৃণমূলও। অন্য দিকে, বিজেপি পেয়েছে ৫৯টি আসন। পঞ্চায়েত সমিতির মোট ১৫৬টি আসনের মধ্যে বিজেপি পেয়েছে ১৯টি আসন। এদিকে, গত লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি মালদহ উত্তর জিতলেও সেখানে জেলা পরিষদে মিলেছে ৪টি আসন। সাংসদ খগেন মুর্মুর এলাকা বামনগোলা, হবিবপুরে তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু ফল হয়নি। গাজোল, চাঁচোল, হরিশ্চন্দ্রপুর বা রতুয়া বিধানসভাতেও বিজেপির ঝুলিতে নেই জেলা পরিষদের কোনও আসন।
আদিবাসী প্রধান ঝাড়গ্রাম লোকসভা এলাকায় কুড়মি ভোট ভাগাভাগি হয়ে যাওয়ায় বিজেপি তেমন ভাল ফল করতে পারেনি। জেলা পরিষদে কোনও আসনে জেতেনি। কোনও পঞ্চায়েত সমিতি বা গ্রাম পঞ্চায়েত দখলে নেই। পুরুলিয়ার সাংসদ জ্যোতির্ময় মাহাতোর জেলায় পঞ্চায়েত নির্বাচনে বিজেপি ১১টি গ্রাম পঞ্চায়েত দখল করতে পারলেও একটিও পঞ্চায়েত সমিতি পায়নি। জেলা পরিষদে পেয়েছে দু’টি আসন। তবে সৌমিত্র খাঁয়ের বিষ্ণুপুর লোকসভা এলাকায় ন’টি গ্রাম পঞ্চায়েতে সংখ্যাগরিষ্ঠতা ও একটি জেলা পরিষদ আসন জিতেছে বিজেপি। বর্ধমান দুর্গাপুর লোকসভা এলাকায় সেখানকার সব জেলা পরিষদ আসন তৃণমূলের দখলে। পঞ্চায়েত সমিতি ও গ্রাম পঞ্চায়েতের ক্ষেত্রেও তাই। রানাঘাটের সাংসদ জগন্নাথ সরকারের লোকসভা এলাকার কৃষ্ণগঞ্জে মোট গ্রাম পঞ্চায়েত আসন ১৪১টি। সেখানে বিজেপি পেয়েছে ৬৬টি আসন। হাঁসখালিতে মোট গ্রাম পঞ্চায়েত আসন ২৯২টি। বিজেপি পেয়েছে ১২২টি।