২০১৪ সালে দেশবাসীকে একগুচ্ছ প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল বিজেপি। দেশের প্রধানমন্ত্রীর কুর্সিতে বসেছিলেন স্বপ্নের ফেরিওয়ালা মোদী। তারপর প্রায় এক দশক পার হতে চলল। কিন্তু অধিকাংশ প্রতিশ্রুতিই পরিণত হয়েছে জুমলায়। ইস্তাহারেই আটকে থেকে গেছে মোদীর ফেরি করা স্বপ্ন। ২০১৪ সালের ইস্তাহারে বিজেপি দাবি করেছিল, তারা ক্ষমতায় এলে দ্রব্য মূল্য আম জনতার নাগালে নিয়ে আসা হবে। মূল্য বৃদ্ধিই ছিল অন্যতম বড় রাজনৈতিক ইস্যু। কিন্তু মোদী আমলে জিনিসের দাম তো কমেইনি, বরং ২০২২ সালের এপ্রিলে রিটেলে মূল্য বৃদ্ধি পৌঁছল ৭.৮ শতাংশে যা বিগত আট বছরে সর্বোচ্চ।
অন্যদিকে, হোলসেলের ক্ষেত্রে ওই একই সময় তা পৌঁছে গেল ১৫.০৮ শতাংশে। যা গত নয় বছরে সর্বাধিক। বেড়েছে আম জনতার সংসার চালানোর খরচ। এক বেসরকারি সমীক্ষক সংস্থার রিপোর্ট বলছে, মানুষ সংসার চালাতে সঞ্চয় ব্যয় করতে আরম্ভ করেছেন। ২০২৩ সালে প্রথম ছয় মাসে, ভারতীয়রা বিগত ত্রিশ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম সঞ্চয় করেছে। নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে জমানো টাকা খরচ করছে দেশবাসী। মূল্য এতটাই বেড়ে গিয়েছে যে, বহু মানুষ সামান্য প্রয়োজন মেটানোর জিনিসটুকুও কিনতে পারছেন না। বেশ কিছু রিপোর্ট, সমীক্ষা বলছে, মোদী আমলে দারিদ্রতা এবং অসাম্যতা বৃদ্ধি পেয়েছে।
আবার ক্ষমতায় আসা আগে বিজেপি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, প্রতি বছর ২ কোটি চাকরি হবে। তরুণরা চাকরি পাবেন। নতুন কাজের সুযোগ হবে। গ্রামীণ এলাকায় কর্মসংস্থান বাড়বে। কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য উৎপাদন শিল্প ও পর্যটনে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হবে। কিন্তু আদতে মোদী আমলে শেষ চার-সাড়ে চার দশকে সবচেয়ে বেশি বেকারত্ব দেখল দেশ। বিশেষজ্ঞদের মতে, সরকার কেবল প্রোডাকশন লিংকড ইন্টেন্টিভ স্কিমের আওতায় কাজ দিতে ব্যস্ত। ক্ষুদ্র শিল্প ও কৃষিক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের বন্দোবস্ত না করতে পারলে, দেশে কর্ম সংস্কৃতির পরিবেশ সৃষ্টি করা যাবে না।
২০১৯-এর লোকসভা ভোটের আগে মোদী, এক সাক্ষাৎকারে পকোড়ার দোকান দেওয়া কথা বলেছিলেন। তাঁর প্রশ্ন ছিল পড়োরার দোকান কেন কর্মসংস্থান হিসেবে গণ্য হবে না? এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়েছিল। চাকরিপ্রার্থীরা ‘আচ্ছে দিন পকোড়া শপ’ নামে দোকান খুলেছিলেন। মোদী আমলেই ২০১৭-১৮-তে পঁয়তাল্লিশ বছরে দেশের বেকারত্বের হার সর্বোচ্চ জায়গায় পৌঁছেছিল। সেই সময় তিনি দেশবাসীকে পকোড়া ভাজার পরামর্শ দিচ্ছিলেন। আবার, চলতি বছর কেন্দ্রীয় বাজেটে একশো দিনের কাজের জন্যে বরাদ্দ কমানো হয়েছে। অথচ গ্রামীণ ভারতের অর্থনীতি দাঁড়িয়ে রয়েছে একশো দিনের কাজের উপর। সেখানে সরকারের এহেন পদক্ষেপের যৌক্তিকতা খুঁজে পাননি অর্থনীতিবিদরা।
এদিকে, স্মার্ট সিটি মিশনের আওতায়, ২০১৫ সালের জুনে বলা হয়েছিল দেশে একশোটি স্মার্ট সিটি তৈরি করা হবে। সে’সব শহরে অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধা থাকবে, জীবন যাপন অনেক বেশি স্বাচ্ছন্দ্যের হবে। পানীয় জল, যোগাযোগ, বিদ্যুৎ, ইত্যাদি পরিষেবা উন্নত হবে। পরিবেশ রক্ষার দিকটিও থাকবে। ঠিক হয়েছিল, স্মার্ট সিটি মিশনের আওতায় উন্নত শহরগুলিতে আরও উন্নততর করে গড়ে তোলা হবে। নতুন তৈরি হাওয়া শহরগুলিকে এই আওতায় নেওয়া হবে না। কিন্তু স্মার্ট সিটির সংজ্ঞা অদ্যাবধি স্পষ্ট নয়।
২০২১ সালে স্মার্ট সিটি মিশনের মেয়াদকাল বাড়িয়ে ২০২৩-এর জুন অবধি করা হয়। ফের তা বাড়িয়ে আগামী বছরের জুনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কিন্তু কাজ একটুও এগোচ্ছে না। একশোর মধ্যে কুড়িটিরও কাজ সম্পূর্ণ হয়নি। দেরাদুন স্মার্ট সিটি মিশনের আওতায় ২০১৫ থেকে ২০২২-র মধ্যে ১৪০০ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। কিন্তু উত্তরাখণ্ডের সমস্যা মেটেনি। বর্জ্র নিষ্কাষণের সমস্যা মেটেনি, জানবসতি বাড়ছে দ্রুত গতিতে, বস্তি তৈরি হচ্ছে আজও। বিজেপি ইস্তাহারে দাবি করেছিল, দশ বছরে স্মার্ট সিটিগুলি ২৫ কোটি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে। কিন্তু কিছুই হয়নি।
২০১৪ সালের মে মাসে মোদী পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে বলছিলেন, ‘আমি মা গঙ্গার সেবা করতে চাই।’ পরের মাসে কুড়ি হাজার কোটি টাকার নামামী গঙ্গে প্রকল্প হাতে নেয় মোদী সরকার। উদ্দেশ্য, গঙ্গাকে বাঁচানো। সাফ কথায়, দূষণ ও আবর্জনা মুক্ত করা। কিন্তু ২০১৮ তে জানানো হয়ে ২০২০ তেও দূষণ মুক্ত গঙ্গার স্বপ্ন সার্থক হবে না। গত বছর জুলাইতে সমানে আসে, গঙ্গা অনেক বেশি দূষিত হয়ে পড়েছে। উত্তরপ্রদেশের দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ ২০১৯ সালে জানায়, প্রয়াগরাজের কাছে গঙ্গার উচ্চপ্রবাহ ও নিম্নপ্রবাহ অত্যন্ত দূষিত হয়ে পড়েছে। এটি স্নানের অনুপযোগী। করোনার দ্বিতীয় ঢেউতে উত্তরপ্রদেশের গঙ্গায় শব ভেসে যাওয়ার দৃশ্য আজও ভারতবাসীর মনে তাজা।