বাংলার মুখ্যমন্ত্রী পথে শপথ নেওয়ার পর থেকেই রাজ্যের স্বাস্থ্যক্ষেত্রের উন্নয়নে বিশেষভাবে উদ্যোগী হয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। একাধিক বার সফলতার নজির গড়েছে রাজ্যের হাসপাতালগুলি। এবার বড় সাফল্য পেল কাটোয়া মহকুমা হাসপাতাল। শহরের সুপরিচিত মেডিক্যাল কলেজগুলি যা করতে পারে, এই মহকুমা হাসপাতালটিও তা করে দেখিয়েছে। একদা বাংলার মহকুমা হাসপাতালগুলিতে জটিল কোনও অপারেশন করার মতো পরিকাঠামো সেভাবে ছিল না। কিন্তু এখন ছবিটা ভিন্ন। জেলার সরকারি হাসপাতাল ও মহকুমা হাসপাতালগুলিও জটিল ও বিরল অপারেশনে রেকর্ড গড়ছে। কাটোয়া মহকুমা হাসপাতালও সেদিক থেকে বিরল দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে। ভ্যাজাইনোপ্লাস্টির মতো জটিল সার্জারিতে কৃত্রিম যোনি ও জরায়ু তৈরি করে এক তরুণীকে নতুন জীবন দিল তারা। কাটোয়ার মতন মফস্বল শহরে স্বল্প পরিকাঠামোর সরকারি হাসপাতালে ২৯ বছরের এক তরুণীর নিও ভ্যাজাইনোপ্লাস্টি অপারেশন করেছেন কাটোয়া মহকুমা হাসপাতালের চিকিৎসকরা। ডাঃ বিশ্বরূপ তা বলেছেন, ভ্যাজাইনোপ্লাস্টি অপারেশন করে কৃত্রিম যোনি ও জরায়ু প্রতিস্থাপন করা হয়। এই অপারেশন খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। কৃত্রিম জননাঙ্গ শরীরে প্রতিস্থাপন করার পরে তা ঠিকমতো কাজ করবে কিনা সেটাও দেখতে হয়। এর জন্য অনেক আধুনিক পরিকাঠামো দরকার হয়। সেই দুরূহ কাজটিই সফলভাবে সম্পন্ন করেছেন চিকিৎসকরা।
আসা যাক রোগীর কথায়। দুর্গাপুর অশোক অ্যাভিনিউর বাসিন্দা বাসন্তী চট্টোপাধ্যায়ের বিয়ের মাস তিনেক পর পরিবারের লোকেরা জানতে পারেন, যে ওই তরুণীর শরীরে এমন কিছু সমস্যা আছে, যার ফলে তিনি মা হতে অক্ষম। স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ বিশ্বরূপ তা-এর সঙ্গে যোগাযোগ করেন বাসন্তীর পরিবারের লোকজন। ডাক্তরাবাবু তরুণীকে পরীক্ষা করে জানতে পারেন, নারীত্বের পরিচয়বাহক সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গই তার রয়েছে, শুধু নেই যৌনাঙ্গ। সেই সঙ্গে অপরিণত জরায়ু। এমন পরিস্থিতিতে কৃত্রিমভাবে জননাঙ্গ তৈরি করে তা তরুণীর শরীরে প্রতিস্থাপন করা ছাড়া আর অন্য কোনও উপায় নেই। তরুণীর পরিবার নার্সিংহোমে ভর্তি করার কথা ভাবলেও ডাক্তারবাবুই তাঁদের কাটোয়া মহকুমা হাসপাতালে ভর্তি করতে বলেন। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় এই শারীরিক জটিলতাকে বলা হয় ‘মুলেরিয়ান অ্যাজেনেসিস’। জিনগত ভাবে এবং শারীরিক বৈশিষ্ট্যে তিনি নারী হলেও, অনুপস্থিত তাঁর যৌনাঙ্গ। একে বলা হয় ‘কনজেনিটাল ম্যালফরমেশন’। জরায়ু যেখান থেকে তৈরি হয় সেই মুলেরিয়ান চ্যানেল বা ডাক্ট এ ক্ষেত্রে তৈরি হয় না। ফলে যৌনাঙ্গের গঠনও থাকে অসম্পূর্ণ । সাধারণত পাঁচ হাজারের মধ্যে একজনের হয় এই বিরল রোগ। এমন সমস্যা থাকলে ডাক্তাররা ভ্যাজাইনোপ্লাস্টি করারই সিদ্ধান্ত নেন। ডাক্তারি পরিভাষায় ভ্যাজাইনোপ্লাস্টির অর্থ হল ভ্যাজাইনা বা যোনির প্লাস্টিক সার্জারি। একে ভ্যাজাইনাল ক্যানালের প্লাস্টিক সার্জারিও বলা হয়। অপরিণত যোনি বা ক্যানেলের গঠনের খামতি থাকলে সার্জারি করে সেই ঘাটতি মেটানো হয়। আর জন্ম থেকেই যাঁদের যোনি নেই, কখনও ঋতুস্রাব হয়নি, ইন্টারকোর্স কোনও ভাবেই সম্ভব নয়, ডাক্তারি পরিভাষায় যা ‘ব্লাইন্ড ভ্যাজাইনা’ নামে পরিচিত।
এপ্রসঙ্গে ডাক্তার বিশ্বরূপ তা বলছেন, এই ধরনের বিরল রোগের অস্ত্রোপচার করতে গেলে যে ধরনের মেডিক্যাল সেট আপ দরকার তা নামী মেডিক্যাল কলেজগুলোতেই থাকে। কিন্তু জেলার মহকুমা হাসপাতাল এমন অপারেশন করে বিরল দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে। অস্ত্রোপচারও সফল হয়েছে চিকিৎসকদের তৎপরতায়। তরুণীর শারীরিক অবস্থা এখন স্থিতিশীল বলেই জানিয়েছেন ডাক্তাররা। বাসন্তী চট্টোপাধ্যায়ের দিদি চন্দ্রাণী চট্টোপাধ্যায় বলেন, “আমার বোনের অপারেশন নার্সিংহোমে করার কথা বলেছিলাম, কিন্তু ডাক্তারবাবু আমাদের বলেন, কাটোয়া মহকুমা হাসপাতালে অস্ত্রোপচার করলে রোগীকে আনবেন। চিকিৎসক বিশ্বরূপ তা-এর কথা মত মহকুমা হাসপাতালে ভর্তি করি। অপারেশন ভাল হয়েছে, আমার বোন এবার মা হতে পারবে। হাসপাতালের স্বাস্থ্য পরিষেবা খুবই ভাল।” হাসপাতাল সুপার সুশান্ত বরণ দত্তের কথায়, আগে এমন রোগী ভর্তি হলে জেলা বা কলকাতার হাসপাতালে রেফার করা হত। কিন্তু এখন তা হয় না। পরিকাঠামো আরও উন্নত হলে, আরও ভাল পরিষেবা দেওয়া যাবে বলেই আশাবাদী সুশান্তবাবু।