সফলভাবে জটিল অস্ত্রোপচার সম্পন্ন করে ফের নজির তৈরি করল কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ। জনৈক রোগীর পায়ের হাড়ে বাসা বেঁধেছিল টিউমার। ক্রমশ ভঙ্গুর হতে শুরু করেছিল হাড়। পায়ের হাড় ভেঙেছে, এই ভেবে প্লাস্টার করে ছেড়ে দিয়েছিলেন গ্রামের চিকিৎসক। ফলে প্লাস্টার বাঁধা অংশে টিউমার আরও বড় আকার নিয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল। টিউমার সমেত আস্ত পা-টাই বাদ দিতে হত। কিন্তু সেখানে চমৎকার করলেন কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের অর্থোপেডিক বিভাগের ডাক্তাররা। কোমরের হাড় কেটে বসিয়ে দিলেন পায়ে। কেটে বাদ দিয়ে দিলেন টিউমার। পা বেঁচে গেল রোগীর। উল্লেখ্য, কলকাতা মেডিক্যাল এর আগেও একাধিক জটিল অপারেশনে সাফল্য পেয়েছে। এবারের সার্জারি ছিল জটিলতম। কোমরের হাড় কেটে পায়ে প্রতিস্থাপিত করার সার্জারি সাধারণত নামী বেসরকারি হাসপাতালগুলিতেই হয়। তাতে খরচও হয় লাখ লাখ টাকা। একে বলে লিম্ব স্যালভেজ সার্জারি। কলকাতা মেডিক্যাল সেখানে বিনামূল্যে জটিল অপারেশন করে সাফল্য পেয়েছে। পা বেঁচেছে পেশায় স্বর্ণশিল্পী মহাদেব সামন্তের। তাক লাগানো অস্ত্রোপচারটি করেছেন অর্থোপেডিক বিভাগের অধ্যাপক ডাঃ কৌশিক বন্দ্যোপাধ্যায়, সহকারী অধ্যাপক ডাঃ সৈকত সাউ ও টিম। ডাঃ সাউ বলেছেন, “এই অস্ত্রোপচার প্রাইভেটে করতে খরচ পড়ত প্রায় চার থেকে ছ’লক্ষ টাকা। এখানে হয়েছে বিনামূল্যে। রোগীকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তিনি ভাল আছেন।” মহাদেববাবুর ভাই অনিমেষবাবু বলেছেন, “স্ত্রী ও তিন বছরের একটা বাচ্চা আছে দাদার। পরিবারটা বেঁচে গেল।” চিকিৎসকদের কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন তিনি।
প্রসঙ্গত, মাসকয়েক আগে ডান পা ভেঙে গিয়েছিল বছর ছত্রিশের মহাদেববাবুর। গ্রামীণ চিকিৎসক এক্স-রে রিপোর্ট দেখার পরেও প্লাস্টার করে দেন। টিউমারের উপর প্লাস্টার করায় ফল হয় ভয়ঙ্কর। জায়গাটি ঢাকা ছিল বলে দেখা যাচ্ছিল না। ফলে নিশ্চুপে বাড়তেই থাকে টিউমার। ভয়ঙ্কর যন্ত্রণা শুরু হয় মহাদেববাবুর। পায়ের প্লাস্টার খোলার পরে দেখা যায়, টিউমার ছড়িয়ে পড়েছে পায়ের হাড়ে। টিউমার সমেত পা বাদ দেওয়া ছাড় কোনও গতি ছিল না। মহাদেববাবুকে কলকাতা মেডিক্যালে নিয়ে গেলে সেখানে মেডিক্যাল বোর্ড বসানো হয়। ঝুঁকি নিয়ে অপারেশন করারই সিদ্ধান্ত নেন ডাক্তাররা। স্থির হয়, কোমরের হাড় ‘ইলিয়াক ক্রেস্ট’ কেটে প্রতিস্থাপিত করা হবে টিবিয়ার ক্ষতিগ্রস্ত অংশে। কারণ ওই হাড়টি কাটার পর মাত্র ছ’মাসের মধ্যে ফের আগের আকার ফিরে পায়। ১৯শে মে হাসপাতালে ভর্তি হন ব্যবসায়ী। ২৩শে মে তিন ঘণ্টা ধরে অস্ত্রোপচার হয়। প্রথমে ডান পায়ের টিবিয়ার কোষ থেকে টিউমার বাদ দেওয়া হয়। যে হাড়ে টিউমার ছড়িয়ে পড়েছিল সেটি হাইস্পিড যন্ত্রে গুঁড়ো করে দেওয়া হয়। বাকিটা পুড়িয়ে দেওয়া হয় থার্মো ইলেকট্রিক কটারির মাধ্যমে। ফাঁকা অংশটি পূর্ণ করা হয় কোমরের হাড় দিয়ে। সেটি ধরে রাখতে প্লেট বসানো হয়। গোটা পর্বে পায়ের স্যাফিনাস নামক শিরা যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, প্রতিমুহূর্তে তা লক্ষ্য রাখেন চিকিৎসকরা। তাঁরা বলছেন, মৃত কোষ জমতে জমতে টিউমার তৈরি হয় হাড়ে। চিকিৎসার পরিভাষায় একে বলে ‘জায়ান্ট সেল টিউমার’। সাধারণ এই ধরনের টিউমার বিনাইন হয় (ক্যানসার নয়)। তবে দীর্ঘ সময় ধরে মৃত কোষ জমে তার বৃদ্ধি হলে ম্যালিগন্যান্সি (ক্যানসার আক্রান্ত কোষ) আসতে পারে। উল্লেখ্য, জায়ান্ট সেল টিউমার ২০ থেকে ৪৫ বছর বয়সীদের হতে পারে। পায়ের হাড়ে টিউমারের বৃদ্ধি হতে থাকে। যে অংশে টিউমার বাসা বাঁধে তার আশপাশের কোষ নরম হতে শুরু করে। ভঙ্গুর হতে শুরু করে পায়ের হাড়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানাচ্ছে, চার থেকে পাঁচ শতাংশ ক্ষেত্রে জায়ান্ট সেল টিউমার হল প্রাইমারি টিউমার। কিন্তু চিকিৎসা না হলে তা ম্যালিগট্যান্ট টিউমারে বদলে যেতে পারে। তখন ক্যানসার কোষ বের করতে হাঁটু ও ঊরুর হাড় বাদ দেওয়ার দরকার পড়ে। এমনকী দরকার হলে অস্ত্রোপচারে পা-ও বাদ যেতে পারে। তবে চিকিৎসকরা বলেন, মেগা প্রস্থেসিস পদ্ধতিতে অস্ত্রোপচার করলে পা কাটা আটকানো যেতে পারে। এই পদ্ধতি হল, যে হাড়ে ক্যানসার ছড়াচ্ছে সেটি কেটে বাদ দিয়ে একটি কৃত্রিম যন্ত্র বসানো। তবে কোমরের হাড় পায়ে প্রতিস্থাপন করার জটিল পদ্ধতির ঝুঁকি আজ পর্যন্ত খুব কমই নেওয়া হয়েছে। সেখানেই কলকাতা মেডিক্যালের চিকিৎসকরা নতুন দৃষ্টান্ত গড়লেন।