দেশজুড়ে শুরু হয়েছে তোলপাড়। নানান মহলে উঠেছে নিন্দার ঝড়। বিতর্কের মুখে মোদী সরকার তথা শাসকদল বিজেপি। অতিসম্প্রতিই প্রকাশ্যে এসেছে যে, উত্তরপ্রদেশের দ্বাদশ শ্রেণীর ইতিহাসের পাঠ্যবই থেকে মুঘল সাম্রাজ্যের অধ্যায় বাদ দিয়েছে যোগী আদিত্যনাথ সরকার। ন্যাশনাল কাউন্সিল অব এডুকেশনাল রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং(এনসিইআরটি)-এর পরামর্শ মেনেই এই সিদ্ধান্ত বলে প্রশাসন জানিয়েছে। এ নিয়ে ইতিমধ্যেই তুঙ্গে শোরগোল। শিক্ষায় গৈরিকীকরণের অভিযোগ তুলে সরব হয়েছেন বিশিষ্টরা। মোদী সরকারকে কটাক্ষে বিঁধেছে বিরোধী দলগুলি। শুধু মুঘল নয়, শুধু উত্তর প্রদেশেও নয়, সারা দেশেই ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ইতিহাস বই থেকে মুছে দেওয়া হয়েছে একাধিক বিষয়। বিজেপির সাফাই, দশকের পর দশক ধরে ভারতীয় ঐতিহ্য গৌরবের পরিবর্তে সেগুলি নাকি ব্রিটিশদের জয়গান গেয়েছে! সঙ্ঘ পরিবার, বিজেপি ও মোদীর সরকারের দৃষ্টিতে এই প্রয়াসই নাকি ‘নতুন, সঠিক, ভারতীয় ও হিন্দু ইতিহাস’! সেই ইতিহাস থেকে কেবল মুঘলদের কীর্তিকলাপই বাদ দেওয়া হয়নি, বাদ পড়েছে গান্ধী-হত্যার এযাবৎ স্বীকৃত ব্যাখ্যা। মহাত্মা গান্ধীর হত্যাকারী নাথুরাম গডসে যে ‘পুনের ব্রাহ্মণ’, বাদ দেওয়া হয়েছে সেই পরিচয়ও। তাঁর মৃত্যুর পর রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘের (আরএসএস) মতো হিন্দুত্ববাদী সংগঠনদের ‘নিষিদ্ধ’ করার প্রসঙ্গও ইতিহাসের পাঠ্যবইয়ে এখন খুঁজে পাবে না ছাত্রছাত্রীরা। পাবে না ২০০২ সালের গুজরাট দাঙ্গা-সম্পর্কিত বহু তথ্যও। এমনকি গুজরাটের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে ‘রাজধর্ম’ পালন সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীর পরামর্শও নতুন ইতিহাসে স্থান পায়নি। চলতি শিক্ষাবছর (২০২৩–২৪) থেকে দেশজুড়ে স্কুলপড়ুয়ারা মুখোমুখি হবে এই ইতিহাসের। ভারতের ন্যাশনাল কাউন্সিল অব এডুকেশনাল রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং (এনসিইআরটি) এ পরিবর্তন ঘটিয়েছে। কোভিডকালে শিক্ষার্থীদের ওপর থেকে চাপ কমানোর সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এ পরিবর্তনকে এনসিইআরটি কর্তৃপক্ষ যুক্তিপূর্ণ বলেই দাবি করেছে। সংস্থার পরিচালক ডি এস সাকলানি সর্বভারতীয় ইংরেজি দৈনিক দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে এ প্রসঙ্গে বলেছেন, এ বছর নতুন কিছুই করা হয়নি। গত বছর যা কিছু করা হয়েছে, তা রূপায়িত হবে চলতি শিক্ষাবর্ষ থেকে।
উল্লেখ্য, এই পরিবর্তনের তালিকায় শুধু ইতিহাসের বই-ই নয়, বদল ঘটানো হয়েছে নাগরিক বিজ্ঞান বা সিভিকস, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও হিন্দি পাঠ্যক্রমেও। হিন্দি সাহিত্য থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে বেশ কিছু কবিতা ও অনুচ্ছেদ, যা নতুন ভারতের উপযুক্ত নয়। নাগরিক বিজ্ঞান থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে ‘বিশ্ব রাজনীতিতে আমেরিকার আধিপত্য’ ও ‘ঠান্ডা যুদ্ধ’-এর মতো বিষয়। বদলে দেওয়া হয়েছে ‘স্বাধীনতার পর ভারতীয় রাজনীতি’ অধ্যায়। পাল্টানো হয়েছে ‘জনপ্রিয় আন্দোলনের উত্থান’ ও ‘এক পক্ষের আধিপত্যের যুগ’ নামের দুটি অধ্যায়ও। দশম ও একাদশ শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে বদলে দেওয়া হয়েছে ‘গণতন্ত্র এবং বৈচিত্র্য’, ‘জনপ্রিয় সংগ্রাম ও আন্দোলন’, ‘গণতন্ত্রের চ্যালেঞ্জ’ এবং ‘গণতান্ত্রিক রাজনীতি’ অধ্যায়ে। এনসিইআরটির বই দেশের যেসব স্কুলে পড়ানো হয়, সেন্ট্রাল বোর্ড অব সেকেন্ডারি এডুকেশন (সিবিএসই) ও উত্তর প্রদেশসহ বিভিন্ন রাজ্য সরকার পরিচালিত বোর্ড যারা এনসিইআরটির পাঠ্যপুস্তকে স্বীকৃতি দেয়, সর্বত্রই এসব নতুন তথ্য পড়ানো হবে, যাতে ছাত্রাবস্থাতেই পড়ুয়ারা দেশের ‘প্রকৃত সত্য’ সম্পর্কে জানতে পারে ও ‘ঔপনিবেশিক মানসিকতার বন্ধনমুক্ত’ হয়। সেই লক্ষ্যে এনসিইআরটি ২০১৭ সালে পাঠ্যপুস্তকে প্রথম পরিবর্তন এনেছিল। দ্বিতীয়বার আনা হয় ২০১৯ সালে। এবার কি কোভিডের দোহাই দিয়ে তৃতীয় দফার পরিবর্তন আনা হল? উঠছে প্রশ্ন। মোদী সরকারের কোপের মুখে পড়েছে গান্ধী-হত্যা-সম্পর্কিত ইতিহাসে। মুছে দেওয়া হয়েছে গুজরাট দাঙ্গার যাবতীয় তথ্য। দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস এক প্রতিবেদনে তুলে ধরেছে, কীভাবে বিভিন্ন পাঠ্যক্রম থেকে মুছে দেওয়া হয়েছে সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি ও গান্ধী-হত্যা-সম্পর্কিত অংশগুলো। যেমন “পাকিস্তান হচ্ছে মুসলমানদের জন্য, ভারতও তেমনি শুধু হিন্দুদের দেশ হওয়া উচিত। এই মতে যাঁরা বিশ্বাসী ছিলেন কিংবা যাঁরা মনে করতেন, হিন্দুদেরও প্রতিহিংসা চরিতার্থ করা উচিত, গান্ধীজিকে তাঁরা পারতপক্ষে পছন্দ করতেন না।…হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের জন্য গান্ধীজির প্রচেষ্টা তাঁকে মারতে হিন্দু উগ্রপন্থীদের প্ররোচিত করেছিল। বেশ কয়েকটা চেষ্টাও হয়েছিল।…গান্ধী হত্যা সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ম্যাজিকের মতো কাজ দেয়। যেসব সংগঠন সাম্প্রদায়িক ঘৃণা ছড়াচ্ছিল, তাদের বিরুদ্ধে ভারত সরকার দ্রু…