কথায় আছে বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা আর পুলিশে ছুঁলে ছত্রিশ ঘা। কিন্তু সেই পুলিশই ‘নবদিশা’ নামের এক অভিনব প্রকল্প চালাচ্ছে, যা তাদের মানবিক মুখকে জনগণের সামনে এনেছে। প্রসঙ্গত, পুলিশের প্রাথমিক দায়িত্ব নাগরিক জীবনে নিরাপত্তা এবং আইন শৃঙ্খলা বজায় রাখা। কিন্ত এই কাজ পুলিশের একার পক্ষে কি করা সম্ভব? মানুষের কাছাকাছি পৌঁছবার মহতী উদ্দেশ্যে কম্যুনিটি পুলিশিং-এর অঙ্গ হিসেবে ১৯৯৮ সালে রোটারি ক্লাবের সহযোগিতায় শুরু হল প্রতিটি থানায় সাপ্তাহান্তিক ছোটদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং চিকিৎসার ব্যবস্থা। এই প্রকল্পের নামই ‘নবদিশা’।
পরে একে একে লায়ন্স ক্লাব, জাতীয় স্তরের প্রতিষ্ঠান বিক্রমশীলা এডুকেশন রিসোর্স সোসাইটি এই নবদিশা শিক্ষা প্রকল্পে যুক্ত হয়। বিক্রমশীলা টাটা ট্রাস্ট এবং পরবর্তী কালে উইপ্রো, জিনিয়াস কনসাল্ট্যান্ট লিমিটেড এবং ভিসুভিয়াস ইন্ডিয়া লিমিটেডের সহযোগিতায় কলকাতার ১০টি থানায় এই প্রকল্প রূপায়ণে কলকাতা পুলিশের সঙ্গে একযোগে কাজ করে চলেছে। পরবর্তীকালে আরও কয়েকটি এনজিও যথাক্রমে উইমেন ইন্টার লিংক ফাউন্ডেশন, মায়া ফাউন্ডেশন, সিনি, হাটখোলা মেডিক্যাল ব্যাঙ্ক, এরকম আরও কিছু সংস্থা এই প্রকল্পে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়।
সাধারণত স্কুল-ছুট পথবাসী এবং বস্তির পিছিয়ে পড়া শিশুদের এই শিক্ষা কেন্দ্রে প্রাথমিক পাঠক্রমে লেখাপড়া শেখাবার পর সরকারি স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হয়। প্রায় ২২ বছর এই প্রকল্পটি চলছে। এখানে অনেকেই স্কুলের গণ্ডি পার করে কলেজের পড়াশুনো শেষ করেছে। এখন নিয়মিত যারা বিদ্যালয়ে যাচ্ছে তাদের কোচিংয়ের ব্যবস্থা আছে। এদের বাৎসরিক খেলাধুলো, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সবকিছুতেই কলকাতা পুলিশের কম্যুনিটি পুলিশিং উইং সহযোগিতা করে থাকে।
একদা অপরাধপ্রবণ এলাকাতেও এই সেন্টার চলার ফলে যে সব কিশোর, কিশোরীরা অপরাধী হয়ে যেতে পারত তারা কিন্তু সুনাগরিক হিসেবে গড়ে উঠছে। জাতীয় অপরাধ পঞ্জী (এনসিআরবি)-র তথ্য অনুযায়ী কলকাতায় কিশোর-কিশোরী অপরাধীর সংখ্যা হাতে গোনা। কলকাতার থানাগুলিতে ৩৬টি শিক্ষা কেন্দ্রের মাধ্যমে পুলিশের এই অভিনব নবদিশা প্রকল্প চলছে। এখনও পর্যন্ত প্রায় ১৬০০ শিশু এর আওতায় এসেছে। শিক্ষার পাশাপাশি মায়া ফাউন্ডেশন এবং মাতৃসংঘ জনকল্যাণ আশ্রমের সহযোগিতায় এইসব শিশুদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং চিকিৎসার ব্যবস্থা করে থাকে কলকাতা পুলিশ।
কলকাতা পুলিশের কম্যুনিটি পুলিশের এই মহতী প্রচেষ্টার কথা রাষ্ট্রসংঘের অন্তর্জাতিক রিপোর্ট ‘স্টেট অফ ওয়ার্ল্ড চিলড্রেন ২০০৩’-এ গুরুত্বের সঙ্গে মুদ্রিত হয়েছে। সেখানে কলকাতা পুলিশের মানবিক মুখের প্রশংসা করে ‘চাইল্ড ফ্রেন্ডলি পুলিশ ফোর্স’ কথাটি বলা হয়েছে। শুধু নবদিশা নয়, বয়স্ক নাগরিকদের জন্য ‘প্রণাম,’ কিশোর কিশোরীদের কম্পিউটার ও ভোকেশনাল ট্রেনিংয়ের জন্য ‘কিরণ’, রক্তদানের জন্য ‘উৎসর্গ’, পাড়া ফুটবল, মেয়েদের জন্য ‘দামিনী’—এমন আরও অনেক প্রকল্প বাস্তবায়নে কলকাতা পুলিশের কম্যুনিটি পুলিশ ইউনিট এবং পুলিশ কমিশনার সহ ভারপ্রাপ্ত সব আইপিএস এবং অন্যান্য সদস্যবৃন্দ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকেন।