দুর্গাপুজো শেষ। বিজয়ী দশমীর আবহে বাঙালির মনে ভাসছে বিষাদের সুর। শুরু হয়েছে গিয়েছে আগামী বছরের পুজোর অপেক্ষা। এপ্রসঙ্গে জেনে নেওয়া যাক একটি তাৎপর্যপূর্ণ তথ্য। কেবল আনন্দোৎসব নয়, দুর্গাপুজোর একটি বিরাট অর্থনৈতিক দিকও রয়েছে বাংলায়। রাজ্যে অন্তত ৪০,০০০ কোটি টাকার লেনদেন হয় এবং, যা প্রায় তিন লক্ষ লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করে। কলকাতার ৩,০০০টি পুজো-সহ রাজ্য জুড়ে ৪০,০০০টিরও বেশি ক্লাব, গোষ্ঠী পুজোর সাথে যুক্ত। প্রতি বছর এই দুর্গোৎসবকে ঘিরে তিন-চার মাস ধরে যে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চলে তা রাজ্যের সামগ্রিক অর্থনীতিকে একটা বড় প্রভাব ফেলে। এপ্রসঙ্গে ফোরাম ফর দুর্গোৎসব-এর (এফএফডি) চেয়ারম্যান পার্থ ঘোষ জানিয়েছেন, “উৎসব, জাঁকজমকের সঙ্গে ৪০,০০০ কোটি টাকার লেনদেন জড়িত এবং রাজ্য জুড়ে কমপক্ষে দুই-তিন লক্ষ লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়। এই প্রক্রিয়াটি পুজোর প্রায় তিন-চার মাস আগে থেকে শুরু হয়ে যায়।” এফএফডি’র ছত্রছায়ায় ৪০০টি পুজো কমিটি রয়েছে। পুজো কমিটিগুলি মাইক্রো-অর্থনীতির সহায়ক হিসাবে কাজ করে। পার্থ ঘোষ ৫২ বছর ধরে পুজো সংগঠনের সাথে যুক্ত এবং দক্ষিণ কলকাতার শিব মন্দির সার্বজনীন দুর্গা পুজোর একজন সংগঠক। তাঁর মতে, পাঁচ দিনব্যাপী এই উৎসবে বিভিন্ন ভাবে মানুষ জড়িত। কেউ প্যান্ডেল তৈরি করেন, কেউ প্রতিমা তৈরি করেন। ইলেকট্রিশিয়ান, নিরাপত্তারক্ষী, পুরোহিত, ঢাকি থেকে প্রতিমা পরিবহনের সাথে জড়িত শ্রমিক এবং ভোগ এবং খাবারের ব্যবস্থার সাথে একাধিক মানুষ যুক্ত থাকেন।
পাশাপাশি, এফএফডি’র সভাপতি কাজল সরকারের মতে, দুর্গা পুজোকে ঘিরে ফ্যাশন, পোশাক, পাদুকা, প্রসাধনী এবং বিবিধ খুচরো ব্যবসার ক্ষেত্রগুলি মানুষের ক্রয়-বিক্রয়ে উৎসাহিত হয়। এই সময় সাহিত্য ও প্রকাশনা, ভ্রমণ, হোটেল-রেস্তোরাঁ এবং চলচ্চিত্র ও বিনোদন জগতও ভাল ব্যবসা করে। পাঁচ দিনের উৎসবে হঠাৎ করেই এই ক্ষেত্রগুলিতে ব্যবসা বেড়েছে। ‘‘আমাদের অনুমান হল এই বছর দুর্গোৎসবকে ঘিরে লেনদেন ৫০,০০০ কোটি টাকা পর্যন্ত হতে পারে।’’ কাজল বাবুর মতে, “করোনার দুই বছর পরে মানুষ এই বছর নতুন উদ্দীপনার সঙ্গে মণ্ডপে মণ্ডপে যাচ্ছেন। কর্পোরেট সংস্থাগুলিও এই সময় স্পন্সরশীপের জন্য উদার। তারা কমপক্ষে ৫০০ কোটি টাকা খরচ করেছে। উৎসব ঘিরে মানুষের মধ্যে উৎসাহ যত বেশি থাকে ক্রয়-বিক্রয় ততোই বৃদ্ধি পায়”, সংবাদসংস্থা পিটিআইকে জানিয়েছেন কাজল সরকার। কাজলবাবু বোসপুকুর শীতলা মন্দির পূজা কমিটির সাথেও জড়িত৷ অনেকেই মনে করছেন, ইউনেস্কোর স্বীকৃতি আগামী বছরগুলিতে বাঙালির দুর্গোৎসবকে আরও সমৃদ্ধ করবে৷ এই বছর রাজ্যের ৪০,০০০টি পুজো কমটিকে ৬০,০০০ টাকা করে রাজ্য সরকারের অনুদান দেওয়া নিয়ে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি যতই কটাক্ষ করলেও বিশেষজ্ঞরা অধিকাংশই মনে করেন, এই সাহায্য রাজ্যের সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখতে ইতিবাচক ভূমিকা নেবে।
এবিষয়ে অর্থনীতিবিদ দেবনারায়ণ সরকার জানিয়েছেন, “২০১৩ সালে অ্যাসোচেমের সমীক্ষায় দেখা গেছে, দুর্গা পুজো ২৫,০০০ কোটি টাকার শিল্প এবং অনুমান করা হয়েছিল যে এটি প্রায় ৩৫ শতাংশ করে বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমরা যদি এটি বিবেচনা করি তবে ‘পুজো শিল্প’ এখন প্রায় ৭০,০০০ কোটি টাকা স্পর্শ করবে। পুজোর অর্থনীতির মূল্য নির্ধারণের জন্য আমাদের সঠিক অধ্যয়নের বা গবেষণার প্রয়োজন।” সংবাদ সংস্থা পিটিআইকে দেবনারায়ণ সরকার বলেন, “জাতীয় অর্থনীতিতে দুর্গা পুজোর অবদান ব্রাজিলের অর্থনীতিতে রিও ডি জেনিরো কার্নিভাল এবং জাপানের চেরি ব্লসম উৎসবের অবদানের সমান বা বেশি।” ব্রিটিশ কাউন্সিল ২০১৯-এ দুর্গা পুজোকে ঘিরে সৃজনশীল অর্থনীতির ম্যাপিং করে একটি সমীক্ষা চালায়, যেখানে দেখা যায়, দুর্গা পুজো রাজ্যের জিডিপির ২.৫৮ শতাংশ। ব্রিটিশ কাউন্সিল, পূর্ব এবং উত্তরপূর্ব ভারতের ডিরেক্টর দেবাঞ্জন চক্রবর্তী বলেন, “আমরা রাজ্য সরকারের জন্য ২০১৯ সালে গবেষণাটি করেছিলাম। তাতে দেখা গেছে, রাজ্যে দুর্গা পুজোকে কেন্দ্র করে সৃজনশীল শিল্পের মোট মূল্য প্রায় ৩৩,০০০ কোটি টাকা (USD 4.5 বিলিয়ন)৷ এটি দুটি জিনিস প্রতিষ্ঠা করেছে- ভবিষ্যতে অনুরূপ গবেষণার জন্য একটি বেসলাইন মান এবং অন্যান্য উৎসব বা প্রকৃতপক্ষে পশ্চিমবঙ্গের সমগ্র সৃজনশীল অর্থনীতি এবং অন্যান্য রাজ্যেও অনুরূপ গবেষণা চালানোর জন্য এটি একটি পদ্ধতি।” অহামারীর পরে, অনুমান করা হচ্ছে যে এই বছর পূজার অর্থনীতির আকার ব্রিটিশ কাউন্সিলের কিছু বছর আগে যা অনুমান করেছিল তার চেয়ে অনেক বেশি। পিটিআইকে এমনই জানিয়েছেন রাজ্যের শিল্পমন্ত্রী শশী পাঁজা।