পিতৃপক্ষের অবসান ঘটিয়ে শুরু হয়ে গিয়েছে দেবীপক্ষ। শারদোৎসবের আবহে মেতে আপামর বাঙালি। আজ, মহালয়ার লগ্নে জেনে নেওয়া যাক বাংলার আরও এক সাবেকি দুর্গাপুজোর কথা। প্রায় ১৫০ বছরের পুরনো মালদহের হবিবপুরের কেন্দপুকুর ভাঙাদিঘি এলাকার পুজো। পুরোহিতের মন্ত্রে নয়, এখানে আদিবাসীদের নিজস্ব মন্ত্রেই নিষ্ঠার সঙ্গে এখানে পূজিত হন মহামায়া। ধুমধাম করে আগের নিয়ম-নীতি মেনেই দেবীর আরাধনা করেন আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষেরা। মালদহের হবিবপুর ব্লকটি আদিবাসী অধ্যুষিত। পুজোর চার দিন এখানে পংক্তি ভোজনের আয়োজন করে থাকেন আদিবাসী সমাজের মানুষেরা। ব্রাহ্মণ পুরোহিতের বদলে একজন প্রবীণ আদিবাসী তাঁদের নির্দিষ্ট ধর্মীয় রীতি মেনে দেবী দুর্গাকে পুজো করেন। আর মাত্র কয়েকদিনের মাথায় দেবীর বোধন। হবিবপুরের ভাঙাদিঘিতে এখন জোরকদমে চলছে পুজোর তোড়জোড়।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সীমান্তবর্তী এই ভাঙাদিঘি গ্রামে প্রায় ২০০ আদিবাসী পরিবারের বসবাস। এখানে দেবীর আরাধনার জন্য পাকা মণ্ডপ নেই। টিনের ছাউনির তলায় বেদী রয়েছে। সেখানেই পুজো হয়। এলাকার প্রবীণ আদিবাসী ব্যক্তিদের কথায় জানা গেল, প্রায় ১৫০ বছর আগে এই পুজো শুরু করেছিলেন লব হাঁসদা। দেবী দুর্গার স্বপ্নাদেশ পেয়েই নাকি তিনি এই পুজো শুরু করেছিলেন। তখন অখণ্ড ভারত থাকাকালীন বাংলাদেশের নাচোল থানার হাকরোল গ্রামে থাকতেন লব হাঁসদা। ঘট পুজোর মাধ্যমে শুরু হয়েছিল পুজো। পরবর্তী সময়ে দেশভাগের পর ভারতে চলে আসেন লব হাঁসদা। বসবাস শুরু করেন এই হবিবপুরের কেন্দপুকুরের ভাঙাদিঘি গ্রামে। মহামায়ার আরাধনা বন্ধ করেননি তিনি। লব হাঁসদার প্রচলিত সেই দুর্গাপুজোই আজ সর্বজনীন দুর্গোৎসবে পরিণত হয়েছে। আদিবাসীরাই এই পুজোর প্রধান উদ্যোক্তা।
এপ্রসঙ্গে প্রয়াত লব হাঁসদার উত্তরসূরী বাবুলাল হাঁসদা জানিয়েছেন, তাঁদের পরিবারের এই পুজো আজ গোটা গ্রামের পুজো। আগে ঘট পুজো হত। তবে এখন সময় বদলেছে। গত ২০ বছর ধরে মাটির মূর্তি গড়ে পুজো হয়। ব্রাহ্মণ পুরোহিতকে পুজো করতে ডাকা হয় না। পুজো হয় আদাবিসীদের মন্ত্রোচারণের মাধ্যমে। নিয়ম মেনে ষষ্ঠী, সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী ও দশমী এই ক’দিন দেবী দুর্গার আরাধনা হয়। এই চারদিন আদিবাসীদের নিজস্ব মন্ত্রে আদিবাসী ভাষাতেই পুজো করা হয় দেবী দুর্গাকে। চারদিনই নিরামিষ ভোগ দেওয়া হয় দেবীকে। নবমীতে খিচুড়ি ভোগ করা হয়। “বাপের বাড়িতে এই পুজো হয়নি কোনওদিন। শ্বশুরবাড়িতেই এই পুজোর রেওয়াজ রয়েছে। পুজোর চারদিন নতুন জামা কাপড় পড়ে আনন্দে করি সকলে। দেবীকে পান দিয়ে বরণ করি। ভোগ দিই”, জানিয়েছেন গ্রামের জনৈকা গৃহবধূ কাবলী মুর্মু। আদিবাসীদের এই পুজোর উদ্যোক্তা সুনীল সোরেন জানান, ”এই পুজো এখন গোটা গ্রামের পুজো। এই উৎসবে সকলেই সামিল হন। আদিবাসীরা নতুন পোশাক কেনেন।” দেবী দুর্গার এই পুজোকে ঘিরে আদিবাসীদের মনে এক প্রগাঢ় ভক্তি রয়েছে। আজ পর্যন্ত কখনও দেবী তাঁদের কষ্টে রাখেননি বলেই মনে করেন তাঁরা। ফলত, দেবী দুর্গা অত্যন্ত জাগ্রত বলেই বিশ্বাস করেন গ্রামবাসী।