বিতর্ক চলছিলই। ফের একবার দেশবাসীর হাসির খোরাক হয়ে উঠলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। পাশাপাশি প্রতিবেশী দেশের মাটিতে গিয়েও মুখ পুড়ল তাঁর। প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের জন্যে জেলে যাওয়ার দাবি করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। সেই দাবি যে পুরোপুরিই মিথ্যাচার; তা ফের একবার প্রমাণিত হল। গত বছরের ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষ্যে ঢাকা সফরে গিয়ে মোদী দাবি করেছিলেন, ওপার বাংলার মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে তিনি সত্যাগ্রহ করেছিলেন এবং সে জন্যে তাকে জেলও খাটতে হয়েছিল। মোদীর এহেন দাবির পরিপ্রেক্ষিতে তথ্যের অধিকার আইনে করা এক প্রশ্নের উত্তরে প্রধানমন্ত্রীর দফতর স্পষ্ট জানিয়েছে, তাদের কাছে মুক্তিযুদ্ধের কারণে মোদীর গ্রেফতারি এবং জেল যাওয়া সংক্রান্ত কোনো তথ্যই নেই। স্বভাবতই এ নিয়ে শুরু হয়েছে তুমুল বিতর্ক। উঠেছে বিদ্রূপের রোলও। আগামী ৫ই সেপ্টেম্বর ভারতে আসছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। হাসিনার ভারত সফরে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে নানাবিধ জরুরি বিষয়ে একাধিক চুক্তি স্বাক্ষর হওয়ার কথা রয়েছে। তার আগেই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে মোদীর এহেন মিথ্যাচার প্রকাশ্যে আসায় অস্বস্তিতে কেন্দ্র।
উল্লেখ্য, ২০২১ সাল ছিল মুজিববর্ষ অর্থাৎ শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী। পাশাপাশি সেবছর ছিল প্রতিবেশী দেশের স্বাধীনতা ও মুক্তির ৫০ বছর পূর্তি। এছাড়ি ভারত ও বাংলাদেশ কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ৫০ বছরও সম্পূর্ণ হয়েছিল। এসব কারণেই মোদীর বাংলাদেশ সফর ঐতিহাসিক দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ফলে এমন একটি সফরে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর এহেন আচরণে বিপাকে পড়েছে ঢাকাও। ওই সফর চলাকালীন মোদী ঢাকা পৌঁছে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। জাতীয় স্মৃতিসৌধ পরিদর্শন করার পর তিনি বলেন, তার বয়স যখন ২০-২২ বছর, তখন তিনি ও তার বহু সহকর্মী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে সত্যাগ্রহে সামিল হয়েছিলেন। সে জন্য তাকে জেলে যেতে হয়েছিল। তখন থেকেই মোদীর দাবিকে কেন্দ্র করে বিতর্কের শুরু হয়। অনেকেই মোদীর দাবির সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তবে এই প্রথম নয়, এর আগেও এমন দাবি করেছিলেন মোদী। অটলবিহারী অসুস্থ থাকায় যখন মোদী অটলবিহারী বাজপেয়ীর হয়ে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান গ্রহণ করছিলেন তখন তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের জন্যে সত্যাগ্রহের দাবি করেছিলেন। নিজের লেখা সংঘর্ষমা গুজরাত বইতেও মোদী এমন দাবি করেছেন। বইটির ২০০০ সালের সংস্করণের পুস্তানীর লেখক পরিচিতির অংশে, মোদীর কৃতিত্ব হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে বাংলাদেশ সত্যাগ্রহে অংশগ্রহণের কারণে তিহার জেলে কারাবাসের কথা।
প্রসঙ্গত, মুক্তিযুদ্ধের কারণে মোদীর জেলে যাওয়া দাবির সত্যতা যাচাই করতে জনৈক জয়েশ গুরনানি নামের এক ব্যক্তি ২০২১ সালের ২৭শে মার্চ তারিখে আরটিআই করেন। তথ্যে অধিকার আইনের মাধ্যমে গুরনানি পাঁচটি বিষয়ে জানতে চেয়েছিলেন। সেগুলি হল, মোদী নামে সে সময় কোন থানায় অভিযোগ দায়ের করা হয়েছিল, কী অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছিল, গ্রেফতারি সংক্রান্ত প্রাসঙ্গিক নথি বা মেমো, জেল থেকে মোদীর মুক্তির নথি এবং যে জেলে মোদীকে রাখা হয়েছিল, সেই জেলের নাম। গুরনানির প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে গিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর দফতর। তারা প্রশ্ন সংক্রান্ত বিষয়ে কিছুই জানায়নি। কেবল জানায়, রেকর্ডে পাওয়া তথ্যগুলি হাইপারলিংক পিএম’স স্পিচেস-এর অধীনে পিএমও-র ওয়েবসাইটে পাওয়া যেতে পারে। সেই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর দফতর জানিয়েছে, ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই তারা মোদীর সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য সংরক্ষণ করে।
যদিও ৪ঠা মে, ২০২১ গুরনানি ফের আবেদন করেছিলেন তাকে কেন তথ্য জানানো হচ্ছে না। অতঃপর প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের উত্তরে সন্তুষ্ট না হয়ে মুখ্য তথ্য কমিশনার ওয়াই কে সিনহার কাছেও আবেদন করেছিলেন গুরনানি। ২০২২ সালের ১৮ই আগস্ট ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে তার শুনানি হয়, কিন্তু কোন লাভ হয়নি। কোন তথ্যই উঠে আসেনি। তবে আর একটি চাঞ্চল্যকর তথ্য নতুন করে সামনে এসেছে। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবিতে ১৯৭১ সালের ১-১১ই আগস্ট একটি সত্যাগ্রহের ডাক দিয়েছিল জনসংঘ। কিন্তু জনসংঘের প্রতিবাদ সমাবেশ (৯ই আগস্ট, ১৯৭১, ইউএসএসআর বন্ধুত্ব চুক্তির) ভারত-রাশিয়া বন্ধুত্ব চুক্তির বিরোধিতায় পরিণত হয়েছিল। আদপে জনসংঘ জনমত গড়ে তুলতে চেয়েছিল। তাদের দাবি ছিল, ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করছে। যুদ্ধের জন্য ভারতের প্রস্তুতি ছিল না বলে জনমত গঠন করতে নেমেছিল জনসংঘ। উদ্দেশ্য ছিল রাজনৈতিক প্রাসঙ্গিকতা আদায়। ১৯৭১-এর ১২ই আগস্ট দিল্লীতে জনসভায় ভাষণ দেন অটলবিহারী বাজপেয়ী। ওই বক্তৃতায় ভারত-রাশিয়া চুক্তিকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে দিল্লী-মস্কোর ষড়যন্ত্র বলে অভিযোগ করেন বাজপেয়ী। বাংলাদেশের স্বীকৃতি অস্বীকার করার চক্রান্ত বলেও দাগিয়ে দেন। অতএব পড়শি দেশে গিয়ে সেদেশের মানুষের আবেগ ও সমর্থন আদায় করতে ইতিহাসের অপলাপ করেছেন মোদী, তা কার্যত পরিষ্কার। এতে বিশ্বদরবারে ফের প্রশ্নের মুখে পড়েছে ভারতের মর্যাদা। আর তাতেই দেশজুড়ে বইছে নিন্দার ঝড়।