ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের সেলুলার জেল। বিপ্লবীদের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের নিশান লেগে আছে সেই কারাগারের দেওয়ালে দেওয়ালে। দেশকে স্বাধীন করার স্বপ্ন নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তেন বহু তরুণ। শাস্তি হিসেবে মিলত ফাঁসি বা দ্বীপান্তর। সেইসব যন্ত্রণার নির্মম ইতিহাসের সাক্ষী সেলুলার জেল। ঊনিশ শতকে কয়েদী উপনিবেশে প্রথম আসেন মহাবিদ্রোহের বীর সেনানীরা। তারপর ওয়াহাবী আন্দোলনের বন্দীরা। এবারে একে একে কাকোরী ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত ও আলিপুর বোমা মামলার বিপ্লবীরা। বিশের দশকে স্বাধীনতার আওয়াজ তীব্রতর হয়ে ওঠে। কলকাতা হাইকোর্টে বিচার শুরু হয় তাদের। ছোটোখাটো অপরাধে জড়িতরাও দ্বীপান্তরিত হতে থাকে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ৩৪৮টি ছোটো বড়ো দ্বীপের সমন্বয়ে আন্দামান নিকোবর গঠিত। স্বাধীনতার দাবিতে বিদ্রোহ যখন ব্রিটিশের রাতের ঘুম কেড়েছে, তখন শাসকগোষ্ঠী শাস্তি হিসেবে বরাদ্দ করত যাবজ্জীবন। কালাপানি পার করে দুর্গম পরিবেশে ফেলে আসা হত বিপ্লবীদের। কপালে জুটল চাবুকের ঘা আর অভাবনীয় কায়িক শ্রম। ১৮৫৮ সালের মার্চ পরবর্তী সময়ে মূলত আন্দামানকে ব্যবহার করা হতো কয়েদী উপনিবেশ হিসেবে। ১৯০৬ এর দিকে জেল হিসেবে এর উদ্বোধন হয়। সংলগ্ন পাহাড়কে পূর্ব দিক থেকে কেটে, সমুদ্র থেকে ষাট ফুট উঁচুতে এই জেল গঠন করা হয়। প্রাথমিকভাবে সাত আটশো কয়েদী থাকার ব্যবস্থা করা হয়। খরচ হয়েছিল আনুমানিক দশ লক্ষ। ভবন দুই ভাগে বিভক্ত ছিল। ডানদিকে থাকতো কয়েদীরা। বামদিকে অফিসাররা। জেলে ছিল না কোনো ডর্মেটরির ব্যবস্থা। প্রতিটি প্রকোষ্ঠই স্বতন্ত্র। তাই এর নাম হয়েছিল ‘সেলুলার জেল’। এক একটি প্রকোষ্ঠ ১৩.৫×৭ ফুট করে ছিল। নির্মাণে লেগেছিল প্রায় ৩ কোটি ইঁট। সম্পূর্ণ আলাদা ছিল প্রকোষ্ঠগুলো। কেউ কারো মুখ দেখতে পেত না। বাঙালির পাশের প্রকোষ্ঠে রাখা হতো মাদ্রাজী বা ওড়িশিকে। ভাষার তারতম্যে কথা বোঝা যেত না বিশেষ।
সেলের দেওয়ালে টোকা মেরে বাঙালিরা প্রচলন করেছিল সরল টরেটক্কার ভাব বিনিময় মাধ্যম। উঁচু উঁচু প্রকোষ্ঠগুলোয় একটিই ঘুলঘুলি থাকত। নোনা বাতাসের দেশ আন্দামান। প্রচুর মশা। আট-দশমাস বর্ষা। কয়েদীদের পরনে থাকতো পাটের কুটকুটে পোষাক। চামড়ায় ঘা হয়ে যেত। সারত না সহজে। তার উপর চলত অমানবিক অত্যাচার। তেলের ঘানিতে বলদের বদলে জুড়ে দেওয়া হতো কয়েদীদের। খিদে ও তেষ্টায় ঘানি টানতে না পারলে ঘানির সাথেই টানা হয়ে যেত তারা। রক্তাক্ত হত দেহ। মলমূত্র ত্যাগের জন্য ছিল একটিই হাঁড়ি। শৌচকর্মের প্রয়োজনে একটিন নোনাজল। পানের জন্য বরাদ্দ জল থেকে এক ফোঁটা বেশি মিলত না। খাবারে মিশে থাকত ইঁদুর বা আরশোলার মল। বারীন ঘোষ, উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারীদের জঙ্গল পরিষ্কার, রাস্তা বানানোর জন্য বাইরে পাঠানো হত। তারা ক্লান্ত শরীরে ফিরে ঐ খাবারটুকুও পেত না। অবশেষে খাদ্য বস্ত্রের জন্য অনশন করে বন্দীরা। অনশন বন্ধ করতে জোর করে নল ঢুকিয়ে দেওয়া হয়, ডাক্তার দিয়ে। মোহিত মৈত্র সহ কিছু কয়েদীর ফুসফুসে দুধ ঢুকে যায়। নিউমোনিয়ায় মৃত্যু হলে তাদের অন্ত্যেষ্টি করা হয় হাঙরের মুখে ছেড়ে। অত্যাচারে অনেকে উন্মাদ হয়ে যায়। কারো পিঠে আছড়ে পড়ে পাঠান সেনার শতাধিক চাবুক। এখন এই সেলুলার জেল পর্যটন কেন্দ্র। সেন্ট্রাল টাওয়ারের নীচে তাকালে দেখা যায় ৫৮৫ জন বীর সেবকের নাম। যাদের ৩৯৮ জনই বাঙালি। যা নিঃসন্দেহে গৌরবের।