মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার পর নানাবিধ দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে তাদের বিরুদ্ধে। উঠেছে মুহুর্মুহু নিন্দার ঝড়। তার মধ্যে অন্যতম হল ব্যাপম কেলেঙ্কারি। মধ্যপ্রদেশে সরকারের অধীনস্থ সংস্থা মধ্যপ্রদেশ প্রফেশনাল এক্সামিনেশন বোর্ড, সরকারি চাকরির নিয়োগসহ ইঞ্জিনিয়ারিং ও মেডিকেলের প্রবেশিকা পরীক্ষা ইত্যাদি পরীক্ষাগুলো আয়োজন করে থাকে। চলতি কথায়, সংস্থার নাম হল, ব্যবসায়িক পরীক্ষা মণ্ডল। সংক্ষপে ব্যাপম। এই সংস্থার মাধ্যমেই মধ্যপ্রদেশে নানা বিধ নিয়োগসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে বিভিন্ন দুর্নীতির কারবার চলত। রীতিমতো জাঁকিয়ে বসেছিল বেনিয়ম, টাকার বিনিময়ে সরকারি চাকরি বিক্রি হত। তদন্তে উঠে এসেছিল, গোটা চক্রে বিজেপির মন্ত্রী, বিধায়ক, সাংসদ, বিজেপি সরকার ঘনিষ্ঠ আমলা থেকে শুরু করে বিজেপির নেতা-নেত্রী, কেউ বাদ নেই। প্রবেশিকা পরীক্ষার নামে চূড়ান্ত পর্যায়ে দুর্নীতি হয়েছে। যে ডাক্তার রোগী দেখছেন, আদপে তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষাতেই বসেননি। ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে চাকরি করছেন, অথচ তিনি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েনইনি। পড়া দূরস্থ, প্রবেশিকা পরীক্ষাতেই বসেননি। ২০১৫-২০২২ সালের মধ্যে সাত বছরে ব্যবসায়িক পরীক্ষা মণ্ডলের কলঙ্ক মুছতে দুবার নাম পরিবর্তন করা হয়েছে। ২০১৫ সালে নাম হয়েছিল প্রফেশনাল এক্সামিনেশন বোর্ড এবং তারপর ২০২২ সালে নাম হয় কর্মচারি চয়ন আয়োগ (স্টাফ সিলেকশন বোর্ড)। ব্যাপম কেলেঙ্কারির মাধ্যমে ব্যাপম দ্বারা পরিচালিত নিয়োগ ও প্রবেশিকা পরীক্ষা মিলিয়ে ১৩ ধরনের পরীক্ষায় দুর্নীতি হয়েছিল। মেডিকেলের প্রবেশিকা পরীক্ষা ও মধ্যপ্রদেশ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে সরকারি কর্মচারী নিয়োগের পরীক্ষায় ব্যাপক বেনিয়ম হয়েছিল। খাদ্য দপ্তরের ইন্সপেক্টর, পরিবহণ কনস্টেবল, পুলিশ কর্মী, স্কুল শিক্ষক, দুগ্ধ সরবরাহ দপ্তরের আধিকারিক এবং বনরক্ষী ইত্যাদি পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে দুর্নীতির ঘটনা প্রকাশে আসে। পরীক্ষাগুলির ফলাফলে কারচুপি করে টাকার বিনিময়ে অযোগ্য লোকেদের নিয়োগ করা হয়েছিল।
প্রসঙ্গত, নিয়োগ পরীক্ষার সঙ্গে যুক্ত সরকারি আধিকারিকদের উৎকোচ দেওয়া, উত্তরপত্র জাল করা, ছদ্মবেশ ধরে ভুয়ো পরীক্ষার্থীদের পরীক্ষায় বসানো, পরীক্ষার্থীদের বসার ব্যবস্থায় হেরফের করা ইত্যাদি নানাভাবে বেনিয়মের মাধ্যমে অর্থের বিনিময়ে নিয়োগ করা হয়েছিল। গোটা প্রক্রিয়া অর্থাৎ দুর্নীতির নেপথ্যে ছিল ব্যাপম বোর্ড। বোর্ডের সদস্য থেকে শুরু করে আধিকারিক সকলেই এই দুর্নীতিতে অভিযুক্ত। এবং অংশীদারী বললেও অত্যুক্তি হয়না। আনন্দ রাই হলেন এই কেলেঙ্কারির পর্দা ফাঁসের নায়ক। ২০০৯ সালে তাঁর দায়ের করা একটি পিআইএলের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাপম কেলেঙ্কারির তদন্ত শুরু হয়। তিনি দুর্নীতিবাজদের টার্গেটে পরিণত হন, নিয়মিত প্রাণনাশের হুমকি পেতে শুরু করেন। এমনকী মধ্যপ্রদেশ টিচার এলিজিবিলিটি টেস্টের প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার কিছুদিন পরে, ২০২২ সালের এপ্রিল মাসে মধ্যপ্রদেশ পুলিশের অপরাধ দমন শাখা দ্বারা তাকে গ্রেফতার করেছে। ২০১১ সালে বিজেপি শাসিত ডবল ইঞ্জিন রাজ্য মধ্যপ্রদেশের শিবরাজ সিংহ চৌহান সরকার তদন্ত কমিটি গঠন করেন। মধ্যপ্রদেশের মেডিক্যাল এডুকেশনের যুগ্ম পরিচালকের নেতৃত্বে ওই তদন্ত কমিটি অনুসন্ধান শুরু করে। ১০০-এর বেশি সংখ্যক মানুষকে হেফাজতে নেওয়া হয়েছিল, কিন্তু কাউকেই অভিযুক্ত করা হয়নি। ২০১৫ সালে হাইকোর্টে জমা দেওয়া এসটিএফের রিপোর্ট অনুসারে, রহস্যজনকভাবে জেল হেফাজতে ২৩ জনের মৃত্যু হয়েছিল যা প্রথমে গোপনে রাখা হয়েছিল বা তাদের প্যারোলে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল।
বিগত ২৬ আগস্ট, ২০১৩ সালে মধ্যপ্রদেশ সরকার একটি বিশেষ টাস্ক ফোর্স গঠন করে৷ নির্বাচনের ছয় মাস আগে ২০১৩ সালে মধ্যপ্রদেশের বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিংহ চৌহান ঘোষণা করেন, সিবিআই তাকে ব্যাপম কেলেঙ্কারিতে ক্লিনচিট দিয়েছে। ২০১৫ সালের জুন পর্যন্ত প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী লক্ষ্মীকান্ত শর্মাসহ ২০০০ জনের বেশি সন্দেহভাজনকে প্রতারণার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ আটক করা হয়েছিল৷ ২০১৫ সালের জুলাই মাসে ব্যাপম কেলেঙ্কারির তদন্তভার সিবিআইয়ের হাতে স্থানান্তরিত করা হয়। চলতি বছর অর্থাৎ ২০২২ সালের জুলাই মাসে ইন্দোরের সিবিআই আদালত ২০০৯ সালের ব্যাপম কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত পাঁচজনকে দোষী সাব্যস্ত করে সাত বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেছে। উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে একজনকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
দেখে নেওয়া যাক, ব্যাপম কেলেঙ্কারির ইতিবৃত্ত :
১৯৯০-এর দশকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম বেনিয়মের ঘটনা প্রকাশ্যে আসে। এফআইআর দায়ের করা হয়।
২০০৯-১১: ডাঃ আনন্দ রাই পিআইএল দায়ের করেন৷ মধ্যপ্রদেশ সরকার কমিটি গঠন করে। মধ্যপ্রদেশের মেডিক্যাল এডুকেশনের জয়েন্ট ডিরেক্টরের সভাপতিত্বে, পিএমটি পরীক্ষায় বেনিয়মের তদন্ত শুরু হয়।
২৬শে আগস্ট, ২০১৩: মধ্যপ্রদেশ সরকার পুলিশের স্পেশাল টাস্ক ফোর্স তৈরি করে। মামলাটি সিবিআইয়ের হাতে হস্তান্তরের আবেদন খারিজ করেন মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ চৌহান।
৫ই নভেম্বর ২০১৪: মধ্যপ্রদেশ হাইকোর্ট কংগ্রেস নেতা দিগ্বিজয় সিংয়ের সিবিআই তদন্তের আবেদন খারিজ করে দেয়। আদালত, পর্যবেক্ষণের জন্যে তিন সদস্যের বিশেষ SIT গঠনের নির্দেশ দেয়।
২০১৪-২০১৫: সিট-এর তত্ত্বাবধানে এসটিএফ কেলেঙ্কারির বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়৷ মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিংহ চৌহানের পদত্যাগের দাবি ওঠে। এসটিএফ-এর হাতে তথ্য আসে, মধ্যপ্রদেশের রাজ্যপাল রাম নরেশ যাদব এবং তার ছেলে এই কেলেঙ্কারিতে জড়িত রয়েছেন।
৯ইজুলাই, ২০১৫: ভারতের অ্যাটর্নি জেনারেল সুপ্রিমকোর্টকে জানান তদন্তভার সিবিআইয়ের হাতে হস্তান্তরের ক্ষেত্রে কোন সমস্যা নেই। সুপ্রিমকোর্ট ব্যাপম মামলা সিবিআইয়ের হাতে হস্তান্তরিত করার নির্দেশ দেয়।
মার্চ, ২০১৬: মধ্যপ্রদেশের ব্যাপম বোর্ড এমপিপিইবি আইন, ২০০৭ আইনের আওতায় আট বছরেরও বেশি বিলম্বে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বোর্ডের পরিচালক ও নিয়ন্ত্রকের নিয়োগের ক্ষেত্রে বেনিয়ম হয়েছে, সেই সঙ্গে স্বজনপোষণ ও নির্দিষ্ট লোকেদের পদ পাইয়ে দেওয়া হয়েছে।
১৩ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৭: সুপ্রিমকোর্ট কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত ৬৩৪ জন ডাক্তারের পদ বাতিল করেছে।
মার্চ, ২০১৭:
ক্যাগ রিপোর্ট:
১. কেলেঙ্কারির খবর প্রকাশ্যে আসার পরেও, ব্যাপম পরিচালিত পরীক্ষাগুলির জন্য কোন সুনির্দিষ্ট নিয়ন্ত্রক কাঠামো ছিল না।
২. ব্যাপম পরিচালিত পরীক্ষার সংখ্যা তথা বিস্তারিত কোন তথ্য নথিভুক্ত করা হত না। যা নিয়োগে অস্বচ্ছতার সাক্ষ্য বহন করে।
৩. ক্যাগকে মধ্যপ্রদেশ সরকার ব্যাপমের রেকর্ডগুলিকে পরীক্ষা করার অনুমতি দেয়নি।
ফেব্রুয়ারি, ২০২২: মধ্যপ্রদেশের টিচার এলিজিবিলিটি টেস্টের প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়, সেই সঙ্গে পুলিশ কনস্টেবল নিয়োগের পরীক্ষায় বেনিয়মের অভিযোগ সামনে আসে। মুখ্যমন্ত্রীর ওএসডি লক্ষ্মণ সিং মারকাম এই ঘটনায় জড়িত বলে অভিযোগ ওঠে।
৩০ জুলাই, ২০২২: ইন্দোরের সিবিআই আদালতে ২০০৯ সালের ব্যাপম কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত পাঁচজনকে দোষী সাব্যস্ত করে, সাত বছরের কারাদণ্ডের দণ্ডিত করে। প্রমাণের অভাবে ছাড়া পেয়ে যান একজন।