পর্যটনশিল্পের প্রসারে বড়সড় পদক্ষেপ নিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সোমবার পুরুলিয়ায় প্রশাসনিক বৈঠক ফিল্ম সিটি নিমার্ণের কথা ঘোষণা করলেন মমতা। রাজ্যের পর্যটন বিভাগ ও পুরুলিয়া জেলা প্রশাসনের সহায়তায় ফিল্ম সিটি গড়তে বেসরকারি বিনিয়োগে ১০ একর জমি দেবেন বলে ওই বৈঠক থেকেই জানিয়ে দেন মুখ্যমন্ত্রী। ওই প্রশাসনিক পর্যালোচনা সভায় থাকা রাজ্যের পর্যটনমন্ত্রী ইন্দ্রনীল সেনের সঙ্গে কথা বলে এই কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন। ওই বৈঠকেই পর্যটনে যুক্ত থাকা একটি সংস্থা মুখ্যমন্ত্রীকে জানিয়ে দেন তারা এই ফিল্ম সিটি গড়বেন। এই কাজে মুখ্যমন্ত্রী চেম্বার অফ কমার্সকে এগিয়ে আসার বার্তা দেন। তিনি বলেন, “রূপসী পুরুলিয়ার এত সৌন্দর্য। বিগত কয়েক বছরে এখানে বহু ছবির শুটিং হয়েছে। এখনও ধারাবাহিকভাবে হচ্ছে। তাই ফিল্ম সিটি গড়ার জন্য ১০ একর জমি দেব।” শুধু ফিল্ম সিটি গড়াই নয় একে ঘিরে ফিল্ম ট্যুরিজমের প্রসার ঘটবে। যার ফলে বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি আরও উন্নত হবে বলেই মনে করছে বিশেষজ্ঞ মহল।
পাশাপাশি, এদিনের বৈঠকে একাধিকবার শিল্পশহর রঘুনাথপুরে জঙ্গলসুন্দরী কর্মনগরীর ৭২ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের কথা বলতে শোনা গিয়েছে মমতাকে। জঙ্গলমহলের এই দূরের জেলার সঙ্গে কলকাতার যোগাযোগ ব্যবস্থায় আরও উন্নতিতে ব্রিটিশ আমলে পরিত্যক্ত অবস্থায় থাকা ছরড়ায় ছোট বিমানবন্দর চালু করতে চান মুখ্যমন্ত্রী। দীর্ঘদিন ধরেই এই কাজটি প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে। এদিন মমতা বলেন, “ছরড়ায় বিমানবন্দর হবে। পুরুলিয়ার কমিউনিকেশন বাড়ানোর প্রয়োজন।” সেই সঙ্গে তিনি পর্যটনের প্রসারে হোম স্টে আরও বাড়ানোর কথা বলেছেন। এই জেলায় ‘মাটির সৃষ্টি’ প্রকল্পে জেলা প্রশাসন পর্যটনকে জুড়ে দেওয়ায় প্রকল্পস্থলগুলি একটি করে ট্যুরিজমের সাইট সিয়িং হয়ে গিয়েছে। এখানেও হোম স্টে করা যাবে বলে এই বৈঠকে পর্যটন বিভাগ থেকে প্রস্তাব দেওয়া হয়। আসলে এই ফিল্ম সিটি, হোম স্টে-র মধ্য দিয়ে রূপসী পুরুলিয়াকে শুধু দেশে নয় বিদেশী পর্যটকদের কাছেও পর্যটনের গন্তব্য করে তুলতে চাইছেন মুখ্যমন্ত্রী। পুঞ্চায় জৈন স্থাপত্য পাকবিড়রার মন্দিরকে হেরিটেজ ঘোষণা করতে ওই ট্যুরিজম প্রকল্পে প্রশাসনিক বৈঠক থেকেই দু’কোটি টাকা বরাদ্দ করে দেন মমতা। পর্যটন বিভাগ থেকে এক কোটি এবং তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ থেকে এক কোটি টাকা দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।
প্রসঙ্গত, পুরুলিয়ায় সর্বপ্রথম ফিল্ম ইউনিটের তাঁবু পড়ে ১৯৭৯ সালে। পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’-র ছবির শ্যুটিং হয়েছিল জয়চন্ডী পাহাড়ে। আড়শা এলাকার দৃশ্যপটকে কাজে লাগিয়েছিলেন সত্যজিৎ। তারপর দীর্ঘ দিন বিরতির পর ১৯৯৯ সালে বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর ‘উত্তরা’ ছবির শুটিং হয়। এরপর এই জেলায় নিয়মিত হয়ে যায় শ্যুটিং। ‘মন্দ মেয়ের উপাখ্যান’, ‘জানালা’, হিন্দি ছবি ‘ওহ’-এর শ্যুটিং হয়। মহাশ্বেতা দেবীর ১৩টি গল্প নিয়ে স্বল্প দৈর্ঘ্যের ছবি করেছিলেন বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত। এছাড়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৩টি গল্প নিয়ে ত্রয়োদশী ছবির শুটিং করেছিলেন তিনিই। তাঁর আরেকটি ছবি ‘টোপ’-এর শ্যুটিং হয়। শ্যুটিং হয় রণবীর সিংহ, সোনাক্ষী সিনহার হিন্দি ছবি ‘লুটেরা’-এরও।
উল্লেখ্য, রাজ্যে তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর সেই তালিকা আরও দীর্ঘ হয়েছে। রাজ চক্রবর্তীর ‘প্রলয়’, ‘দুই পৃথিবী’, পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়ের ‘লড়াই’, গৌতম ঘোষের ‘শূন্য অঙ্ক’, তাঁর স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবি ‘সময়ের প্রীতিমালা’, কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘সিনেমাওয়ালা’, ‘লক্ষ্মী ছেলে’ অপর্ণা সেনের ‘আরশিনগর’, ‘ঘরে বাইরে আজ’ এবং ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্তের ‘বিসমিল্লা’, সুব্রত সেনের ‘প্রজাপতি’ ছবির শ্যুটিংও হয়েছে পুরুলিয়ার মাটিতেই। এছাড়া কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের ‘মেঘে ঢাকা তারা’র ছবির শ্যুটিং হয় এই জঙ্গলমহলেই। এমনকী, ইতালীয় পরিচালক ইতালো স্পিনেল্লির ‘গাঙ্গোর’ ছবিরও শুটিং হয় পুরুলিয়ায়। “আউটডোর শ্যুটিং-র একটি বড় জায়গা পুরুলিয়া। এটা সমগ্র বিশ্বেই প্রতিষ্ঠিত। এখানে যদি ইনডোর শুটিংয়ের জায়গা হয় তাহলে দেশ-বিদেশের পরিচালকরা আরও বেশি করে পুরুলিয়ায় আসবেন”, জানিয়ছেন স্থানীয় শিল্পী হিসেবে অভিনয় করা স্বরূপ দত্ত, সুদিন অধিকারীরা। মুখ্যমন্ত্রীর এই পদক্ষেপ নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই আশাবাদী শিল্পমহল।