দেশজুড়ে বিজেপির সাংগঠনিক ফের একবার প্রকাশ্যে এসেছে। সাম্প্রতিক সময়ে দেশের একাধিক পদ্ম-শাসিত রাজ্যে বদল হয়েছে মুখ্যমন্ত্রী। ব্যতিক্রম হয়নি ত্রিপুরার ক্ষেত্রেও। শনিবার ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী পদ থেকে বিপ্লব দেবের ইস্তফা এবং মানিক সাহাকে সেই জায়গায় বসানোর পর একটা ব্যাপার স্পষ্ট। তা হল, ভোটের নির্ধারিত সময়ের মাত্র ন’মাস আগে নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহ, জেপি নাড্ডারা বোঝাতে চাইলেন, বিপ্লব সম্পূর্ণ ব্যর্থ। ত্রিপুরায় প্রথম বিজেপি সরকার গঠনের পর বিপ্লবকে কাজ করার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। বিপ্লব তা যথাযথ ভাবে করতে পারেনি। তাই তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হল। অর্থাৎ বিজেপির উদ্দেশ্য ভাল ছিল। প্রসঙ্গত, নরেন্দ্র মোদীর এই কৌশল বহুদিনের। মুখ বদল করে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা যে মোকাবিলা করা যায় তা ২০০৭ সালের গুজরাত ভোটে প্রথম দেখিয়েছিলেন তিনি। সৌরাষ্ট্রে কয়েক ডজন বিধায়ককে বসিয়ে দিয়ে নতুন প্রার্থী দিয়েছিলেন মোদী। তার পর সেই ফর্মুলা বিভিন্ন রূপে বিভিন্ন স্তরে ব্যবহার করা হয়েছে। ত্রিপুরাতেও তা দেখা গেল। এ নিয়ে রাজনৈতিক মহলে চলছে জোল আলোচনা।
উল্লেখ্য, গেরুয়াপরিবারে বহুদিন ধরে রয়েছেন বিপ্লব। বাজপেয়ী জমানায় কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রীতা ভার্মার আপ্তসহায়ক ছিলেন তিনি। জিম ট্রেনারের কাজও করতেন। সেই বিপ্লবকে ২০১৬ সালে ত্রিপুরা বিজেপির সভাপতি করে আগরতলায় পাঠিয়েছিলেন মোদী-শাহ। তার পর ভোটে জিতে বিপ্লবকে মুখ্যমন্ত্রী করেছিলেন তাঁরা। বিপ্লবের যোগ্যতা নিয়ে তখনও প্রশ্ন ছিল দলের মধ্যে। কিন্তু সমস্যা হল, তার থেকে ভাল কাউকে আর তখন খুঁজে পায়নি বিজেপি। এখন বিপ্লবকে মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে সরানোর অর্থ অনেকের কাছেই পরিষ্কার। তা হল, আসন্ন ভোটে হেরে যাওয়ার আশঙ্কা জাঁকিয়ে বসেছে বিজেপিতে। তাঁরা হয়তো বুঝতে পারছেন, পরিস্থিতি খুব একটা সুবিধাজনক নয়। গত নির্বাচনে সিপিএমকে সরিয়ে বিজেপি যখন ক্ষমতায় আসে তখন তাদের জোট শরিক ছিল আইপিএফটি। জনজাতি ভিত্তিক দল ছিল আইপিএফটি। কিন্তু সেই পার্টিরই অস্তিত্ব নেই। এখন মাথা তুলেছে প্রদ্যোত কিশোর দেববর্মনের তিপ্রা মথা। রাজবাড়ির ছেলে তথা প্রাক্তন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদ্যোত নতুন দল গড়ে কয়েক মাসের মধ্যে স্বশাসিত জেলা পরিষদ দখল করেছে। দুমাস আগে আস্তাবল মাঠে যে সমাবেশ প্রদ্যোত করেছিলেন তা একপ্রকার ঐতিহাসিক। তাঁর সঙ্গে বিজেপির এখনও বোঝাপড়া হয়নি। মৌলিক অনেক ব্যাপারে তাঁরা রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান করছেন। বিজেপি বুঝতে পারছে বিধানসভায় তিপ্রা মথা এক চতুর্থাংশ আসনে জয়ের জায়গায় রয়েছে। সিপিএমের এখন ষোলটি আসন রয়েছে। সুদীপ রায় বর্মন কংগ্রেসে যাওয়ার পর কী প্রভাব হবে তা কৌতূহলের। কারণ আগরতলা শহরের গোটা পাঁচেক আসনে সুদীপ ফ্যাক্টর। সব মিলিয়ে ভোটের অঙ্কে বিজেপির কাছে ত্রিপুরা অনিশ্চিত। প্রসঙ্গত, সুদীপকে বিজেপি ছাড়া করার পিছনে একা বিপ্লব দায়ী বলে মনে করছেন অনেকে। সম্ভবত তাই মুখ বদল করে মুখ বাঁচানোর চেষ্টা করছে পদ্মশিবির।
উল্লেখ্য, বিপ্লব মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর মানিক সাহাকে রাজ্য সভাপতি করা হয়েছিল। রাজনীতিতে যাঁর অভিজ্ঞতা খুবই সীমিত। দলের রাজ্য সভাপতি পদে থাকলেও আগরতলা জানে মানিকের ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা বিশেষ নেই। ভোটে কখনও জেতেননি। নিজস্ব জনভিত্তিও সীমিত। বিপ্লবের মতোই তাঁর পূর্ব প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা একেবারে নেই। তাই বহুজনের মতে, এই বদল স্রেফ বদলের জন্যই করা হল। এতে নীতি বদল, কাজের বদল বা প্রশাসনিক পরিবেশে বদলের সম্ভাবনা কম। রাজ্য বিজেপির অনেকে ঘরোয়া আলোচনায় বলছেন, মানিক সাহা রাজ্যসভা থেকে ইস্তফা দেবেন। সেই শূন্য পদে বিপ্লবকে পাঠানো হবে। তাতে বিপ্লবের সম্মানজনক পুনর্বাসন হতে পারে। আবার কেউ কেউ দাবি করছেন, বিপ্লবকে রাজ্য সভাপতিও করা হতে পারে। এবিষয়ে দলের এক রাজ্য নেতার কথায়, বিপ্লবকে যদি রাজ্য সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হয় তাহলে বুঝতে হবে সংগঠনের নেতা হিসেবে বিপ্লব যে আগ্রাসী লড়াই করেছিলেন সিপিএমের বিরুদ্ধে, সেই মেজাজটাকে ফিরিয়ে আনতে চাইছে বিজেপি। কিন্তু কর্মীদের অনেকের বক্তব্য হল, সেই সম্ভাবনা কম। কারণ, বিপ্লবের বিরুদ্ধে সংগঠনের মধ্যে থেকেই আপত্তি রয়েছে। দলের একাংশের নেতা-কর্মী মনে করেন, গত সাড়ে চার বছরে বিপ্লব ব্যক্তি প্রচারকে অন্যমাত্রায় নিয়ে গিয়েছেন। বিপ্লব দেব মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন না। তিনি মুখ্যমন্ত্রীর চরিত্রে অভিনয় করতেন। সারাদিন চুল আঁচড়ানো আর বাহারি রঙের পাঞ্জাবি পরা ছাড়া কিছু নজরে পড়ত না। ত্রিপুরার তথ্য সংস্কৃতি দফতরকে নিজের পেয়াদায় ভরিয়ে দিয়েছিলেন বিপ্লব। সেখানে আর্থিক অনিয়মের অভিযোগও রয়েছে।
পাশাপাশি, আগরতলার বাইরে গেলেই হেলিকপ্টারে উড়তেন মুখ্যমন্ত্র…