বাংলা প্রবাদ বিষয়ক বিভিন্ন গবেষণাগ্রন্থ থেকে জানা যায়, ব্যবসার অংশীদার বৈষ্ণবচরণ শেঠের সঙ্গে একটি ডুবে যাওয়া জাহাজে বোঝাই-করা দস্তা কিনেছিলেন গৌরীকান্ত সেন। কিন্তু পরে দেখতে পান আসলে দস্তার তলায় লুকিয়ে রুপো পাচার করা হচ্ছিল ওই জাহাজে। দস্তার দরে রুপো পেয়ে রাতারাতি ধনী হয়ে যান গৌরী। এবং দানধ্যান শুরু করেন। কন্যাদায়গ্রস্ত পিতামাতার জন্য নাকি তাঁর দরজা সব সময় খোলা থাকত। আবার জমিদারের ঋণ শোধ করতে না পেরে জেলে যাওয়া প্রজাদের রক্ষা করতেও এগিয়ে আসতেন গৌরী। একটা সময়ে লোকমুখে তাঁর দান-গৌরব ছড়িয়ে পড়ে গোটা বাংলায়। প্রবাদ তৈরি হয়ে যায়— ‘লাগে টাকা, দেবে গৌরী সেন।’ এহেন প্রবাদপুরুষের এক উত্তরপুরুষ দিব্যেন্দু সেন এই কলকাতাতেই থাকেন। তাঁরও টাকা নিয়েই কারবার। তবে গৌরী সেনের মতো দানধ্যান করার ক্ষমতা নেই। অন্য উপায়ে পূর্বপুরুষের মতো বিপদে মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারেন।
টাকা, সে ছেঁড়া-পোড়া হোক বা নোংরায় অচল, দিব্যেন্দুর কাছে তা আসল হলেই চালু! তাঁর ব্যবসাটাই হল, অচল নোট মেরামত করে ব্যাঙ্কে চালিয়ে দেওয়া। মাঝে ‘বাটা’ (কমিশন) হিসেবে হয় রোজগার। তবে ইদানিং এই কারবারের বাজার ভাল নয়। অনলাইন লেনদেন বেড়ে যাওয়ায় টাকা অচল হওয়া নাকি অনেক কমে গিয়েছে। উল্লেখ্য, গৌরী সেনের বংশধর হিসেবে পরিচিত অনেকেই আছেন উত্তর কলকাতার আহিরীটোলায়। তাঁদের অনেকেরই ছিল অচল টাকা চালানোর কারবার। কিন্তু বাজার মন্দা হওয়ায় একে একে সকলেই অন্য ব্যবসায় চলে গিয়েছেন। হাল ধরে রেখেছেন দিব্যেন্দু। বড়বাজারের সোনাপট্টিতে মনোহর দাস স্ট্রিটে এক গয়নার দোকানের টুলে বসে চলে তাঁর ব্যবসা। স্বাধীনতার পরে পরেই দাদু জিতেন্দ্রকুমার সেন শুরু করেন এই ব্যবসা। তখন রিজার্ভ ব্যাঙ্কের লাইসেন্স লাগত। সাধারণ মানুষের থেকে সংগ্রহ করা নষ্ট-হওয়া নোট রিজার্ভ ব্যাঙ্ক থেকে বদলে আনার ব্যবসা।
দিব্যেন্দুর বাবা অসীমকুমার সেনও একই ব্যবসা করেন। পরে দিব্যেন্দুর দাদা সন্দীপও। কাকাদের পরিবারেও ছিল এই ব্যবসা। কিন্তু একে একে সবাই ছেড়ে দিয়েছেন। দিব্যেন্দু বলেন, কোন নোট কতটা ছেঁড়া, ফাটা বা পোড়া, তার উপরে নির্ভর করে কত টাকার বিনিময়ে তাঁরা সেটা কিনবেন। সেই সব নোটই আসে দিব্যেন্দুর মতো ব্যবসায়ীদের হাতে। এর পরে বাড়িতে এনে ছেঁড়া নোট জুড়ে বা নানা ভাবে সারাই করে তা ব্যাঙ্কে নিয়ে যেতে হয়। ব্যাঙ্কও যে পুরো অর্থ দেবে, তার কোনও মানে নেই। বদলের কিছু নিয়মও রয়েছে। সেই মতো দামেই কিনতে হয় দিব্যেন্দুদের। কারণ, ব্যাঙ্ক কত টাকা দেবে সেটা আগাম বুঝতে না পারলেই ঠকতে হবে। এখন অবশ্য রিজার্ভ ব্যাঙ্কে যেতে হয় না। আগের মতো ব্যবসা করতে শীর্ষ ব্যাঙ্কের লাইসেন্সও লাগে না। বিভিন্ন ব্যাঙ্কের কিছু শাখা এই কাজ করে। তেমন শাখা জেলায় জেলায় রয়েছে। তাই আগের মতো পুরনো নোট আর আসে না কলকাতায়। ফলে ব্যবসা ছোট হচ্ছে।