একুশের ভোটে ভরাডুবির পর থেকেই বঙ্গ-বিজেপির অন্দরে চলছে মুষল পর্ব। সোশ্যাল মিডিয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ, হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ ত্যাগ, কলকাতায় কেন্দ্রীয় মন্ত্রী শান্তনু ঠাকুরের নেতৃত্বে বৈঠক, বনগাঁয় চড়ুইভাতি, কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সঙ্গে যোগাযোগ, লোকাল ট্রেন থেকে কলকাতার রাজপথে পোস্টার— নানা ভাবে দলের একাংশের বিরুদ্ধে সরব দলেরই অন্য অংশ। এরই মধ্যে একের পর এক উপনির্বাচন, পুরভোটে হারের মুখ দেখেছে দল। আর এর ফলস্বরূপ নবান্ন দখলের স্বপ্নে বিধানসভার নির্বাচনের আগে দীর্ঘ সময় গেরুয়া শিবির ঠিক যতটা চাঙ্গা ছিল, এখন ঠিক ততটাই ঠান্ডা। যেটুকু উত্তাপ, তা ঘরোয়া যুদ্ধের। একের পর এক ঘটনায় সেই গৃহযুদ্ধ সামনে এসে যাচ্ছে। ২০২১ সালের মে মাস থেকে ২০২২-এর ফেব্রুয়ারি পার। হিসাব বলছে, ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধের বয়স দশ মাস পার হল।
প্রসঙ্গত, ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধটা শুরু হয় বিধানসভা নির্বাচনের ফল ঘোষণার পরেই। পদ্মের ক্ষমতায় যাওয়া নিশ্চিত ধরে নিয়ে দলে দলে যাঁরা গেরুয়া শিবিরে এসেছিলেন, বিধানসভা ভোটের পরে তাঁদের বড় অংশই এখন দল ছেড়েছেন। কেউ তৃণমূলে ফেরার সুযোগ পেয়েছেন, কেউ এখনও অপেক্ষায় রয়েছেন। এমন নেতা-কর্মীদের দলে নেওয়া এবং মুখ হিসাবে তুলে ধরে ভোটে লড়া ঠিক হয়েছিল কি না তা নিয়েই প্রথমে বিবাদ শুরু হয়। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের দিকে আঙুল তোলেন কেউ। কেউ আবার দিলীপ ঘোষের বিরুদ্ধে বিষোদগার করেন। এরই মধ্যে মুকুল রায়ের তৃণমূলে প্রত্যাবর্তন, কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা থেকে বাদ পড়া বাবুল সুপ্রিয়ের দলত্যাগ এবং পরে তৃণমূলে যোগদানে নতুন করে ধাক্কা খায় গেরুয়া শিবির। আর এই সময়টায় দু’দুবারের সাংসদ বাবুলের সঙ্গে সরাসরি মন্তব্য-যুদ্ধে নেমে পড়েছিলেন তৎকালীন রাজ্য সভাপতি দিলীপ।
দিলীপের পরে সুকান্ত মজুমদার রাজ্য বিজেপির সভাপতি হতেই একের পর এক বিতর্কে সামনে এসে গিয়েছে দলের অন্দরের যুদ্ধ। আবার প্রায় রোজ ভোরেই প্রাতর্ভ্রমণে বার হয়ে খুঁটিনাটি সব কিছু নিয়ে মন্তব্য করে দলের অন্দরের লড়াই বেআব্রু করে দিচ্ছেন দিলীপও। রাজ্য বিজেপির অনেকেই বলছেন, যে ক্ষেত্রে দল চুপ থাকার নীতি নিয়েছে অনেক সময়ে সেটা নিয়েই নিজের মতো করে কথা বলে ফেলছেন দিলীপ। এর ফলে দলে পারস্পরিক বোঝাপড়া আঘাত পাচ্ছে। দলের এই বেহাল দশা নিয়ে বিরক্ত জেলাস্তরের নেতারাও। সম্প্রতি দলের বৈঠকে যোগ দিতে আসা এক জেলা নেতা বলেন, ‘একের পর এক ঘটনায় মুখ পুড়ছে আমাদের। জেলায় তৃণমূলের সঙ্গে লড়ছি আমরা আর রাজ্যের নেতারা শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ঘরে বসে নিজেদের মধ্যে লড়াই চালাচ্ছেন।’
ওই নেতা একের পর এক উদাহরণ দিয়ে দেখালেন সম্প্রতি তৈরি হওয়া বিভিন্ন ঘটনার পরম্পরা। সেই তালিকায় যেমন ছিল কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা হারানো নিয়ে রানাঘাটের সাংসদ জগন্নাথ সরকারের মুখ খোলার বিষয়, তেমনই ছিল খড়্গপুরে হিরণ চট্টোপাধ্যায়ের বৈঠক বয়কট করা থেকে বার বার দলেরই একাংশের বিরুদ্ধে তোলা অভিযোগের কথা। তাঁর মতে, ‘গোলমাল সব দলেই থাকে। কিছু দিন আগেই তো তৃণমূলে কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, কুণাল ঘোষেরা বিবাদে জড়িয়েছিলেন। কিন্তু ক’দিন কাটতে না কাটতেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গোটাটা মিটেয়ে দেন। আসলে আমাদের দলে বাঘে, গরুকে এক ঘাটে জল খাওয়ানোর মতো কেউ নেই। এমন কোনও নেতা নেই, যাঁর কথায় সবাই বিবাদ ভুলে একসঙ্গে কাজ করবেন।’
দলের শীর্ষনেতারা যে অনেক বিষয়েই ঐকমত্য হচ্ছে না সেটা গত ২৮ ফেব্রুয়ারি বিজেপির ডাকা বাংলা বনধের দিনে প্রকট হয়ে যায়। ২৭ ফেব্রুয়ারি ভোটগ্রহণ মিটে যেতেই বনধ ডাকেন সুকান্ত। পরের দিন সেই বন্ধ সফল করতে যখন বিভিন্ন জায়গায় দলীয়কর্মীরা পথে তখন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী অন্য কথা বলেন। দুপুরেই বন্ধ প্রত্যাহার করে নেওয়ার আর্জি জানিয়ে তিনি দাবি করেন, আচমকা বনধ ডাকায় সাধারণ মানুষের সমস্যা হচ্ছে। এর পরেই সুকান্ত বলেন, এ ব্যাপারে শুভেন্দুর সঙ্গে তাঁর কোনও কথাই হয়নি। বিকেলে সাংবাদিক বৈঠকে তিনি শুভেন্দুর বক্তব্য প্রসঙ্গে বলেন, ‘আচমকা বনধ ডাকা ছাড়া উপায় ছিল না। আমরা হঠাৎ করেই ডেকেছি। কারণ, যে কারণে বনধ সেই ভোটে সন্ত্রাস নিয়ে তো আর সাত দিন পরে বনধ ডাকা যায় না।’
সমস্যার সমাধান সে দিন হয়ে যায়নি। ওই বিতর্কের জের এখনও চলছে। গত শনিবার দলের ডাকা বিশেষ সাংগঠনিক বৈঠকে হাজির ছিলেন না শুভেন্দু। সেখানেও ওঠে বনধ প্রসঙ্গ। তাতে আচমকা না ডেকে ধীরে সুস্থে এবং সময় দিয়ে বন্ধ ডাকা উচিত বলে মন্তব্য করেন দিলীপ। এখানেই থামেননি। তাঁর সঙ্গে আলোচনা ছাড়া সুকান্তের বনধ ডাকা নিয়ে সমালোচনার পাশাপাশি নাম না করে অনুপস্থিত শুভেন্দুকেও খোঁচা দেন। বৈঠকে উপস্থিত এক নেতার দাবি সেখানে দিলীপ বলেন, ‘আচমকা বনধ ডাকলে অসুবিধা হয়। কিন্তু দল যখন এক বার তা ডেকেছে তখন সেই কর্মসূচীকে সকলের মান্যতা দেওয়া উচিত।’
তবে বিজেপিতে নিজেদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি লড়াইটা শুরু হয় সম্প্রতি নতুন রাজ্য কমিটি ঘোষণার পরে। যা আরও বেড়ে যায় বিভিন্ন জেলার নতুন সভাপতিদের নাম ঘোষণায়। একের পর এক বিধায়ক দলের সাংগঠনিক হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ ছাড়তে শুরু করেন। তাতে যোগ দেন দলের সাংসদ তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী শান্তনু ঠাকুর। একটা সময়ে বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠীতে থাকা সায়ন্তন বসু, রাজু বন্দ্যোপাধ্যায়, রীতেশ তিওয়ারি, জয়প্রকাশ মজুমদারদেরও নেতা হয়ে ওঠেন শান্তনু। কলকাতায় সরকারি গেস্ট হাউসে বৈঠক, বনগাঁয় বনভোজন একের পরে এক কর্মসূচিতে দলের ভিতরের লড়াই সামলাতেই ব্যস্ত হয়ে যেতে হয় সুকান্তকে। সেই সময়ে রাজ্যের বাইরে ছিলেন লকেট। উত্তরাখণ্ডে ভোট মিটলে বাংলায় ফিরেই সেই বিতর্কে নতুন মাত্রা যোগ করা শুরু করেন তিনি। যার জের এখনও চলছে।